'তারুণ্যবান্ধব' ইশতেহারে সত্য-মিথ্যার জোড়াতালি

আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারকে ‘তারুণ্যবান্ধব’ ঘোষণা করেছে। তারুণ্যের গুণগত উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে যুব বিভাগ, যুব বাজেট, যুব গবেষণা কেন্দ্র, যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তরুণ উদ্যোক্তা নীতি, ইয়ুথ প্ল্যান, যুব স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণ, তরুণ কর্মসংস্থান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাসহ ইশতেহারে বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ তার বিগত মেয়াদে যা যা সাফল্য দাবি করেছে এবং সেগুলোর ভিত্তিতে ভবিষ্যতে যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নে যেসব পথ ও পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছে, সেগুলো নিয়ে সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

১. ‘তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি উপজেলায় প্রসারিত করা হবে বলা হয়েছে। অথচ এখনো পর্যন্ত সীমিত পর্যায়ে দেশের যেসব স্থানে এই কর্মসূচি চালু হয়েছে, সেটুকুই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রত্যাশিত সফলতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। সে ক্ষেত্রে এ কর্মসূচি দেশব্যাপী প্রসারিত করার মাধ্যমে তরুণদের বেকারত্ব হ্রাসের প্রতিশ্রুতি কতখানি বাস্তবসম্মত, সেটা নিয়ে সন্দেহ পোষণের সুযোগ রয়েছে।

২. ‘বেকারত্বের হার ২০২৩ সালে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা’র কথা বলা হয়েছে। অথচ চলমান বছরের ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী এক উপদেষ্টার বরাতে দাবি করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ৪.২ শতাংশ’। অর্থনীতিবিদদের মতে ৫ ভাগের নিচে বেকারত্বকে শূন্য বেকারত্ব বলা হয়ে থাকে। তার আগে অবশ্য সরকারের নির্বাহী প্রধানের বরাতে জানা গেছে, ‘সাত বছরে প্রায় ১০ কোটি ৬৫ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে’ (২৯ জুন, ২০১৬)। অন্যদিকে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শ্রমশক্তি জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার; যদিও সরকার সব সময় দাবি করে, বাংলাদেশে বেকারসংখ্যা মাত্র ২৫ লাখ ৮৭ হাজার! এটা কীভাবে সম্ভব? আবার যদি এই তথ্য সত্য দাবি করা হয়, সে ক্ষেত্রে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিরই–বা কী দরকার?

৩. তারুণ্যকে মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত করতে ‘প্রতিটি জেলায় একটি করে সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের সুস্থ বিনোদনের লক্ষ্যে প্রতিটি জেলায় একটি করে ‘যুব স্পোর্টস কমপ্লেক্স’ এবং প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ‘যুব বিনোদন কেন্দ্র’ গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ধরে নেওয়া হয়েছে, সুস্থ বিনোদনের অভাবই মাদকাসক্তির মূল কারণ এবং মাদকাসক্ত মানুষকে কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিতে পারলেই তাদের আসক্তি থেকে মুক্ত করা যাবে। একদিকে মাদকাসক্তি নির্মূলের এসব পুরোনো প্রথাগত পদ্ধতির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে আমরা জানি সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের মাদকবিরোধী অভিযানে স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি কেবল ‘ইয়াবা’ নামক মাদকের বাজার বার্ষিক ৪৮ হাজার কোটি টাকায় (২৬ মে, ২০১৬) পরিণত করার কুশীলবদের কাউকে সেরা করদাতার পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়েছে (৫ নভেম্বর, ২০১৮)। কাউকে আবার ‘গরিবের বন্ধু’ (১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযোগ করেছে (মে ০৭, ২০১৭), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর দেশের ‘শীর্ষ ১৭ মাদক ব্যবসায়ীকে আড়াল করতে চায়’। ওই অধিদপ্তর ছাড়াও মাদকাসক্তি নির্মূলে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধেও ‘সোর্স মানির বদলে ইয়াবা’ লেনদেনের (১৫ জুলাই, ২০১৭) মতো গুরুতর অনেক অভিযোগ এসেছে। এ রকম বাস্তবে চিহ্নিত মূল হোতাদের বিচারের আওতায় না এনে মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখা, প্রতিনিয়ত প্রচুর পরিমাণ জব্দকৃত মাদকদ্রব্য বাহকসহ ধরলেও সেসবের পেছনের ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানতে না দেওয়া সংশ্লিষ্ট সংকট সমাধানের প্রচেষ্টায় প্রশ্নের উদ্রেক করে। মাদকাসক্তিসংক্রান্ত প্রবৃদ্ধিতে বিশ্বে বাংলাদেশ কেন নেতিবাচকভাবে বহুগুণ এগিয়ে আছে এবং এর পেছনে অল্পে তুষ্ট শান্তিবাদী ঐতিহ্যের বাঙালি জাতির শুধু সুস্থ বিনোদনের ঘাটতি, নাকি অন্য আরও কিছু কারণ আছে? এসব সত্যের স্বীকৃতি না দিলে সংকট থেকে উত্তরণ অধরাই থেকে যাবে।

৪. ‘যুবসমাজ যাতে আদর্শিক ভ্রান্তিতে মোহাবিষ্ট হয়ে জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত না হয়, সে জন্য কাউন্সেলিং এবং তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশকে ত্বরান্বিত করা হবে’ উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের অধিকারী বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সংহতি বিনষ্টকরণ প্রচেষ্টায় ভিন্নধর্মী মানুষের আচরিত বিশ্বাসে আঘাত এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্লাডলাইন খ্যাত তৈরি পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকসহ অন্য নারীদের কর্মজীবন নিয়ে অশ্রাব্য কটূক্তি প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। উল্টো ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন দাবিদার ওলামা লীগের মতো দল মৌলবাদী মানসিকতা পোষণপূর্বক ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ বাতিল (৪ মার্চ, ২০১৭), বাঙালির সর্বজনীন উৎসব পয়লা বৈশাখকে ‘অপসংস্কৃতি’ আখ্যা দিয়ে (১০ এপ্রিল, ২০১৬) বন্ধ করার দাবি জানায়। আর সামাজিক সংহতি ও মানুষের অগ্রগতির বিপরীতে এসব প্রচেষ্টায় রত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া না হলে কীভাবে জঙ্গিবাদের মতো মৌলবাদী প্রচেষ্টা ঠেকানো যাবে, তা বোধগম্য নয়।

৫. ‘তারুণ্যবান্ধব’ শব্দবন্ধকে কেবল তরুণদের কর্মসংস্থান কিংবা সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থাপত্রে বন্দী করা সংগত নয়। তরুণেরা কল্যাণকামী এক সমানাধিকারের রাষ্ট্র চায়। শিক্ষার অবমান, বেকারত্বের অভিশাপ এবং ব্যবসায় লোকসানের হতাশাজনিত আত্মহত্যা থেকে যেমন তারা মুক্তি চায়, তেমনি তারা উত্তরোত্তর বেড়ে চলা অপহরণ, গুম, খুন, ধর্ষণ, পুঁজিবাজারের পাপাচার, ব্যাংক–বিমার বিপর্যস্ততা এবং উন্নত মানের গণপরিবহনের সংকট ও পাবলিক পরীক্ষায় ধারাবাহিক প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রবণতা থেকেও মুক্তি চায়। জনগণের অর্থে প্রতিপালিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো এবং সামরিক–বেসামরিক প্রশাসনের একদলদর্শী আচরণ থেকেও তারা মুক্তি চায়।

আওয়ামী লীগের ইশতেহার বিশেষ করে তরুণদের উন্নয়ন প্রয়াসে যেসব অবকাঠামোগত ও বিধানগত ব্যবস্থা এবং প্রায়োগিক পদক্ষেপের কথা বলেছে, তা জনগোষ্ঠীর অন্য কোনো অংশ নিয়ে বলেনি। এ অর্থে এটাকে ‘তারুণ্যবান্ধব ইশতেহার’ দাবি করার সংগত সুযোগ তাদের আছে। কিন্তু তারুণ্য শক্তির উন্নয়নসংক্রান্ত তাদের সে স্বপ্নে সততার সংযোগ ঘটাতে হবে সবার আগে। তা না হলে এসব প্রতিশ্রুতি ও বক্তব্য ফাঁকা বুলিসর্বস্ব ‘নির্বাচনী ইশতেহার’ হিসেবেই অভিহিত হবে।

চারু হক: গবেষক, লেখক।