কোটা সংস্কার

'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' আবারও

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। হেলাল হাফিজের নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় নামের ওই কবিতার পরের লাইনগুলোয় একটা নিরীহ কিন্তু অসাধারণ বার্তা আছে, ৪ জুলাই ২০১৮ সালের প্রথম আলোর প্রধান খবরটি পড়ে যা আমার মনে পড়ে গেল। খবরের শিরোনাম, ‘আন্দোলনে উসকানি দেখছে সরকার’। সরকারি চাকরিতে নিয়োগে যে কোটা পদ্ধতি আছে, তা সংস্কারের দাবিতে বিশাল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে কোটা বিলোপের ঘোষণা দেন। সরকারের বিভিন্ন সূত্র মনে করছে, এরপর এখন যারা কোটা নিয়ে আন্দোলন করছে, তাদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন আছে। এই খবরটা পড়েই কবি হেলাল হাফিজের কবিতাটা মনে পড়ে যাচ্ছে-

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
মিছিলের সব হাত
কণ্ঠ
পা এক নয়।

সেখানে সংসারী থাকে, সংসারবিরাগী থাকে,
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার।
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার...

মিছিলে নানা মতলবের লোক থাকে। নানা ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত এবং সরকারের নানা কৌশলের কারণে বিপর্যস্ত পর্যুদস্ত বিএনপি-জামায়াত যে এই ধরনের আন্দোলনগুলোকে ব্যবহার করতে চাইবে, তা খুবই স্বাভাবিক। আর সরকার সেটা হতে দিতে চাইবে না। সে জন্যই সরকারপক্ষের উচিত হবে বুদ্ধিমান হওয়া, ঠিক কাজটা করা, ঠিক কাজটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার আগেই করে ফেলা, বিরোধী দলকে সুযোগ সন্ধানের ‘সুযোগ’ না দেওয়া।

দেরিতে হলেও সরকার ঠিক কাজটাই করে ফেলেছে। কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনার জন্য কমিটি করে দিয়েছে। ৮ জুলাই এই কমিটি বসবে, ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তাদের সুপারিশ জমা দেবে। এই কাজটা আরও আগে করা হলে ভালো হতো, কিন্তু ভালো কাজ দেরিতে করা হলেও ভালো।

এই কাজটাকে কেন আমি ভালো বলছি!

আমি এই কলামে এর আগে লিখেছি, অনলাইনে লিখেছি, কোটা পদ্ধতির সংস্কার চাই, বিলোপ চাই না। কিছু কোটা অবশ্যই থাকা উচিত। দেশের পশ্চাৎপদ অংশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। সারা পৃথিবীতে ‘ইতিবাচক বৈষম্য’ বলতে একটা কথা আছে, বৈষম্য দূর করার জন্য যে বৈষম্য প্রয়োগ করতে হয়। কাজেই নারী কোটা, উপজাতীয় কোটা থাকা উচিত। জেলা কোটার হার পুনর্বিবেচনা করা যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানো, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর পাশে থাকা জাতি হিসেবে আমাদের চিরকালীন কর্তব্য। সেটা শুধু চাকরির বেলায় নয়, মনে-মানসিকতায়, চলায়-বলায়, জাতীয় জীবনের আরও নানা ক্ষেত্রে। কিন্তু সব মিলিয়ে কোটা বিষয়টাকে সহনীয় এবং সম্মানজনক পর্যায়ে আনতে হবে। এই বিষয়ে যাঁরা বিশেষজ্ঞ, তাঁদের নিয়েই কমিটি হয়েছে, তাঁরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এমন সুপারিশ করবেন, যা সরকার খোলা মনে কার্যকর করবে। এই কাজটাকে তাই আমি ভালো কাজই বলছি। এটা যত তাড়াতাড়ি হয় এবং যত কম জটিলতা সৃষ্টি করে হয়, ততই মঙ্গল।

কিন্তু জটিলতা তো কম হলো না। বহু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাড়িতে যে হামলা হয়েছে, তার ভয়াবহতা আর ক্ষতির নিদর্শন আমাদের স্মৃতিতে স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। ওই সময় আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে যখন শোনা গেল, কোটা পদ্ধতির সংস্কার বা বিলোপের ঘোষণা আসছে, তখন তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকনেতারা কোটা পদ্ধতির সংস্কার চেয়ে বিবৃতিও দিয়েছিলেন। ছাত্রলীগও আনন্দ মিছিল নাকি বিজয় মিছিল করেছিল। সেই আনন্দ কিংবা বিজয়ের মিছিল থেকে এখন হাতুড়িমিছিল বা লাঠিমিছিল কেন হচ্ছে, তা বুঝতে পারছি না। বুঝতে চাইলে বোধ হয় সরকারের বিভিন্ন সূত্রের এই বুঝটাকে বুঝতে হবে, যা বুধবারের প্রথম আলোর প্রথম সংবাদ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে: সরকারের নানা অংশ এই আন্দোলনে দেখছে বিএনপি-জামায়াতের সরকারবিরোধী আন্দোলনের উসকানি।

সেখানেই হেলাল হাফিজের কবিতাটার প্রাসঙ্গিকতা। আর এখানেই আমরা যারা রাস্তার মানুষ, মানুষের সমাজে চলাচল করি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনি, বাজার করতে যাই, দেয়ালের কথা শুনতে পাই, তাদের পর্যবেক্ষণকে মূল্যবান বলে মনে করি। সরকারের উচ্চমহল অনেক সময়েই কঠোর দুর্ভেদ্য বলয়ের মধ্যে থাকেন, তাঁদের কানে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর পৌঁছায় না। প্রাতিষ্ঠানিক যে সূত্রগুলোর মধ্য দিয়ে তাঁরা খবর পান, নানা ধরনের ছাঁকনি বা ফিল্টার সে খবরগুলোকে নিতান্ত পানি বানিয়ে দেয়। তাতে শস্তির স্বস্তি থাকে, খেদের ক্ষোভ থাকে না।

অগণিত তরুণকে জাতীয় উন্নয়নের তরণিতে নিতে পারতে হবে। তারা ও আমরা যেন বলতে পারি, মোরা যাত্রী একই তরণির, সহযাত্রী একই তরণির। রাজপথে তরুণেরা বারবার এসেছে, আসে, আসবে। আমার নিজের কবিতা আছে, ‘মানুষ জাগবে ফের’-
‘নদী প্রবাহিত হয়, তার সবখানে গড়ে না বন্দর। বন্দর গঠিত হয় কোনো এক বাঁকে। বায়ান্নয় একদিন জেগেছিল সব, আবার আসেনি মহাজাগরণ, সুমহান একাত্তরে? আবার আসবে সেই জাগরণী ধবল প্রহর, আবার জন্ম নেবে শেখ মুজিবুর।’

১৯৫২ সালে রাস্তায় তরুণেরা এসেছে, ১৯৬৯ সালের রাজপথ যেন মহাসমুদ্র হয়ে গিয়েছিল, ১৯৭১ সালের মার্চ সম্বন্ধে নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় বলতে হয়, ‘এ রকম বাংলাদেশ কখনো দেখোনি তুমি।’ আমরা ১৯৯০ সালে গণতন্ত্রের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলাম। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী আর মানবতাবিরোধীদের শাস্তির দাবিতে মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল। বর্তমান সরকারের আমলে তিনটা বড় ঢেউ আমরা দেখেছি রাস্তায়। শাহবাগে নেমে এসেছিল লাখ লাখ তরুণ, যুদ্ধাপরাধীদের কঠোরতম সাজার দাবিতে, যাকে বলা হয় গণজাগরণ মঞ্চ। হেফাজতের ডাকেও গ্রামগঞ্জ থেকে কিশোর-তরুণদের আনা হয়েছিল, অনিশ্চিত গন্তব্য-অচেনা ঢাকা শহরে। কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলনে যারা এসেছিল, তাদের মধ্যে আছে সেই তরুণেরা, যাদের ওপরে নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। নির্ভর করছে বলেই তাদের নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। সেই ভাবনার মধ্যে দুর্ভাবনাও আছে। কেবল উসকানিদাতাদের উসকানি নয়, কেবল মতলববাজদের মতলব নয়, আরও একটা দুর্ভাবনা আমাদের ভাবায়।

আমাদের তরুণসমাজ কেন সরকারি চাকরিকেই একমাত্র ভবিতব্য করে তুলছে? সরকারি চাকরিতে এদের খুব অল্পসংখ্যকেরই জায়গা হবে। বাকিরা কোথায় যাবে? বেসরকারি খাতে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা সরকারের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। আর প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ কাজের সন্ধানে বিদেশ যায়, এটিকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, কোটি কোটি তরুণ শিক্ষার্থীর মনের ব্যথা বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। শুধু অভিমান, শুধু মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা হবে এই সময়ের সবচেয়ে বড় ভুল। আর বলপ্রয়োগ হবে আত্মঘাতী। কোটা সংস্কারের প্রশ্নটিকে সরকার সহৃদয়তার সঙ্গে যদি সমাধান করে কোটি শিক্ষার্থীর মুখে হাসি ফোটাতে পারে, তবে এটায় দুটো লাভ আছে-এক. সরকারের লাভ। সরকার জনপ্রিয় হবে। দুই. দেশের লাভ।

বিষণ্ন, পরাজিত তারুণ্য দেশের উন্নতিতে প্রাণ খুলে এগিয়ে আসতে পারবে না। তাদের নানা মহল উসকানি দেবে, মতলববাজেরা কুকর্মে ইন্ধন দেবে। সারা পৃথিবীতে যে নৈরাজ্য চলছে, মাদকাসক্তি, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদের এপিডেমিক এসেছে, তা এদের গ্রাস করে ফেলবে।

হাতুড়ি এই সমস্যাকে প্রকট করে তুলেছে। আন্দোলনের নেতাদের ওপরে ছাত্রলীগের কোনো কোনো কর্মী হামলা করেছেন বলে খবরে প্রকাশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন ছাত্রলীগ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য: ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস। এই কি সেই ছাত্রলীগ? আর কোনো আন্দোলনকারীকেই কোনো পক্ষই কি মারধর করতে পারে? আইন কিংবা নীতিই কি তাতে ভূমিস্যাৎ হয় না?

যাক, কোটা নিয়ে কমিটি গঠিত হয়েছে, সেই কমিটি কাজ করুক, ছাত্ররাও আর কটা দিন ধৈর্য ধরুক। লেট গুড সেন্স প্রিভেইল। জেদ নয়, মতলব নয়, শুভবুদ্ধি জারি থাকুক, শুভবুদ্ধির জয় হোক। আমাদের কোটি তারুণ্যই রাজপথে নেমে ধ্বনি তুলেছে ‘জয় বাংলা’, অপরাজেয় তারুণ্য তো আনবে বাংলার জয়।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক