খাগড়াছড়ির গুইমারার রামেসু বাজারের কয়েকটি দোকানে আগুন দেওয়া হয়। বাজারে পুড়ে যাওয়া একটি মোটরসাইকেল। গতকাল দুপুরে
খাগড়াছড়ির গুইমারার রামেসু বাজারের কয়েকটি দোকানে আগুন দেওয়া হয়। বাজারে পুড়ে যাওয়া একটি মোটরসাইকেল। গতকাল দুপুরে

মতামত

সুপ্রদীপ চাকমা কি অলীক মৃর প্রতিবাদের ঘটনা জানেন, তিনি কী ভাবছেন

খাগড়াছড়ির গুইমারা তখন পুড়ছিল। গতকাল রোববার দুপুরের দিকে তখন খাগড়াছড়ি শহরেই বৈঠকে বসেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম–বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। বৈঠকে ছিলেন জেলা প্রশাসক, পুলিশপ্রধানসহ জেলার শীর্ষ কর্তারা। বারকয়েক ফোন করে উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলতে ব্যর্থ হলাম। পরে তাঁর এক সহযোগী জানান, ‘জরুরি’ বৈঠকে ব্যস্ত আছেন উপদেষ্টা। বৈঠকের পরই কথা বলবেন।

বিকেলের মধ্যেই খবর পাওয়া গেল, গুইমারার মারমা–অধ্যুষিত পাহাড়ি গ্রামে হামলায় তিন পাহাড়ি নিহত হয়েছেন। আহত ১৪ জনের মতো। পুরো গ্রামের শতাধিক বাড়ি ও দোকানপাট পুড়ে ছারখার। গ্রাম পোড়ানো ও মানুষের ওপর হামলার ছবি–ভিডিও অবশ্য অনেক আগ থেকেই ঘুরছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে।

কয়েক দিন ধরেই পাহাড় উত্তপ্ত ছিল অষ্টম শ্রেণির এক পাহাড়ি কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে। সড়ক অবরোধ, প্রতিবাদের মুখে জেলা প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। এমন একটি অবস্থার মধ্যেও কেন এত বড় ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে বিস্মিত খোদ পার্বত্য উপদেষ্টা।

গতকাল রাতে তিনি আমাকে ফোন করে সেই কথাই বলছিলেন। খাগড়াছড়ি উপদেষ্টার নিজের জেলা। তিনি সেখানে উপস্থিত। জারি আছে আইনের কঠোর ধারা। প্রস্তুত ছিল সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পাহাড়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন। বাংলাদেশের যেকোনো এলাকার চেয়ে পাহাড়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এসব বাহিনীর সদস্যসংখ্যা প্রতি নাগরিকের হিসাবে অনেক বেশি। বরাবরই থাকে, এখনো আছে। কিন্তু পাহাড়ে শান্তি আসে না।

পার্বত্য উপদেষ্টা গতকালের ঘটনার জন্য ‘পাহাড়ের প্রশাসন ও স্থানীয় নেতৃত্বের ইমম্যাচিওর (অপরিণত) আচরণকে’ দুষলেন। নিজের অসহায়ত্বের কথাও বললেন। তাঁর কথা, তিনি এ জেলার সন্তান। তাঁর উপস্থিতিতেই এত বড় ঘটনা ঘটল। এটা তাঁর জন্য বেদনাদায়ক।

একজন উপদেষ্টা যখন নিজের এমন অসহায়ত্বের কথা বলেন, তখন সাধারণ মানুষ কোথায় যায়? পরিস্থিতি তপ্ত ছিল, এত বাহিনী ছিল, পুলিশ, সাধারণ প্রশাসন ছিল, তখন প্রকাশ্যে দিনের বেলায় একটি গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হলো। তিনজন মানুষকে হত্যা করা হলো। এসবের পর নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বলা দায়িত্ব এড়ানোর কৌশল বৈ অন্য কিছু নয়।

এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, এখন এ ঘটনার পর একটি ‘উচ্চ পদস্থ তদন্ত কমিটি’ হবে। উত্তেজনা যখন একটু থিতিয়ে আসবে, তখন একটি দায়সারা প্রতিবেদন দেওয়া হবে। সেটি নজরে আসবে বা আসবে না। তিনটি পরিবার (এখন পর্যন্ত নিহত) কিছু আর্থিক অনুদান পাবে। আহত ব্যক্তিদের ‘ভাগ্যেও’ জুটবে কিছু অনুদান। তারপর সরকারের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নিদর্শন দেখানোর যারপরনাই চেষ্টা চলবে। গুইমারা একটি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে চিহ্নিত হবে। পাহাড়ের আগের কয়েকটি সেপ্টেম্বর–স্মৃতি কিন্তু আমাদের এ বাস্তবতার কথাই বলে।

সেপ্টেম্বরের কথাই কেন বলছি? এমন তো নয় যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ, স্থাণু পাহাড়ের বুক চিরে আর অন্য কোনো মাসে রক্তের ঝরনাধারা বয়ে যায়নি। কিন্তু এবারের সেপ্টেম্বরের হিংসা আর প্রাণহানি দেখে একটা আশ্চর্য বিষয় লক্ষ করলাম, তা হলো, সেই ২০১২, গেল বছর আর এবার এই সেপ্টেম্বর মাসেই বড় সহিংসতা দেখল পাহাড়। আর তিন পৃথক বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে একটা মিলও আছে। তিনটি ঘটনাতেই সহিংসতার শিকার পাহাড়ি মানুষ। অমিল এই যে ২০১২ সালে সহিংসতা ছড়িয়েছিল রাঙামাটি থেকে। ওই ঘটনায় কোনো প্রাণহানি হয়নি। কিন্তু গত বছর (২০২৪) ও এবার সহিংসতায় প্রাণ দিতে হলো মানুষকে। পরপর দুবার সহিংসতার শুরুটা খাগড়াছড়ি থেকে।

নিহতদের লাশ গতকাল রোববার সন্ধ্যায় খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়

পাহাড়ের তিন রক্তাক্ত সেপ্টেম্বর

রাঙামাটিতে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সংঘাতের শুরুটা হয়েছিল এক গুজবকে কেন্দ্র করে। গুজবটি ছিল, রাঙামাটি সরকারি কলেজে শ্রেণিকক্ষে বসা নিয়ে পাহাড়ি ও বাঙালি শিক্ষার্থীদের হাতাহাতি হয়েছে। পাহাড়িরা বাঙালি শিক্ষার্থীকে মেরেছে। ব্যস, শহরময় রটে যায় এ কথা। কিন্তু কখন কীভাবে ঘটনার শুরুটা হয়েছিল, কে কাকে মেরেছিল, তা আর পরে জানা যায়নি। শহরময় বাঙালিদের অনেকে দল বেঁধে পাহাড়িদের ওপর হামলা চালায়। একাধিক বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট হয়। শহরের সুপরিচিত চিকিৎসক সুশোভন দেওয়ান হামলায় আহত হন। সজ্জন এই চিকিৎসক চিরতরে একটি চোখ হারান। আহত হন অনেক পাহাড়ি। ঘটনার পর এর কারণ কিংবা দায়ী কারা, তা নিয়ে আর কেউ উচ্চবাচ্য করেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায় ঘটনা ঘটে।

এর ঠিক এক যুগ পর আবারও আক্রান্ত হয় পার্বত্য শহর রাঙামাটি, গত বছরের ২০ সেপ্টেমর। অবশ্য শুরুটা হয়েছিল খাগড়াছড়িতে। সদর উপজেলায় ১৮ সেপ্টেম্বর মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মো. মামুন নামের এক বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পাহাড়ি-বাঙালিদের সহিংসতার গণপিটুনিতে ধনঞ্জয় চাকমা নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। রাতে আবার এ ঘটনায় জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। তাতে নিহত হন দুই পাহাড়ি যুবক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতেই তাঁরা নিহত হন।

এ ঘটনার প্রতিবাদে ২০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাঙামাটিতে ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে প্রতিবাদ মিছিল হয়। মিছিলটি রাঙামাটি শহরের বনরূপা বাজারে পৌঁছালে বাঙালিদের সঙ্গে সংঘাত বাধে। দুই পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করে। পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের মিছিলটি পিছু হটে গেলেও সশস্ত্র বাঙালিদের একটি দল অনিক চাকমা নামের এক কিশোরকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে।

গেল বছরের সেপ্টেম্বর মাসের সহিংসতার পর রাঙামাটি গিয়েছিলাম এবং ঘটনার ওপর প্রতিবেদনও করেছিলাম একাধিক। রাঙামাটির মানুষ এমন পরস্থিতি আগে কখনো দেখেছেন বলে স্মরণ করতে পারেননি। সেই এক যুগ আগে হামলা ছিল সীমিত। কিন্তু গত বছর শহরের মূল সড়কের পাশের কোনো পাহাড়ি দোকান অক্ষত থাকেনি। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় পাহাড়িদের বসত ও দোকানপাট। এটাও রাঙামাটি শহরের মানুষের কাছে ছিল অভূতপূর্ব একটি বিষয়। পাহাড়ি ও বাঙালি অনেকেই এমন কথা বলেছিলেন।

আরও দুটি বিষয় ছিল একেবারে ভিন্ন। যেমন ওই শহরেই আছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ অফিস। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরেই এটি সৃষ্টি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, এই অফিসই হবে পাহাড়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। আগে সহিংসতার সময় দুয়েকবার ইটপাটকেল ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে এই অফিস লক্ষ্য করে। কিন্তু গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর পুড়িয়ে দেওয়া হয় এই কার্যালয়ের বড় অংশ। বারকয়েক ফায়ার সার্ভিসকে ফোন করেও সাড়া পাননি আঞ্চলিক পরিষদের কর্মকর্তারা।

রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সহিংসতা হলেও প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুনও প্রথম দেখেন রাঙামাটি শহরবাসী সেই ভয়ানক ২০ সেপ্টেম্বরে। এ ঘটনার পর সরকারের দুই উপদেষ্টা পার্বত্য চট্টগ্রামে যান। সাধারণত যেটা হয়, এমন ব্যক্তিরা কোনো সহিংসতার স্থানে গেলে অবশ্যই ভুক্তভোগীদের কাছে যান। কিন্তু দুই উপদেষ্টা সেই সময় পাননি। সরকারের এমন নির্লিপ্ততাও আগে পাহাড়বাসী দেখেছে বলে মনে হয় না। পাহাড়ে এত বড় ঘটনার পর সরকার কী উদ্যোগ নিয়েছে? অনীক চাকমাকে হত্যা করা হয়েছে প্রকাশ্যে। সেই প্রকাশ্য হত্যার ভিডিও ভাইরাল হলে কষ্ট করে জনাকয়েক আসামি ধরা হয়। বিচার সম্পন্ন হয়নি। অন্য হত্যাগুলোর কাউকে ধরা হয়েছে, কেউ সাজা পেয়েছে, তার উদাহরণ নেই।

অলীকের দৃষ্টান্ত

এবারের সেপ্টেম্বরে তিনজনকে হত্যা এবং আবাসস্থল পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা যে এমন দিকেই যাবে, তা একপ্রকার নিশ্চিত। তার আগেই দুঃখ প্রকাশ করে দায় সেরেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অনুশোচনা করেছেন পার্বত্য উপদেষ্টা, তা আগেই উল্লেখ করেছি।

কিন্তু এ ঘটনার প্রতিবাদে অলীক মৃ তাঁর রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। অলীক খুব পরিচিত কেউ নন। তিনি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল)। অলীক তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘খাগড়াছড়িতে আদিবাসী কিশোরী ধর্ষণ, আদিবাসীদের ওপর হামলা, আদিবাসীদের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও তিনজন আদিবাসীকে হত্যার ঘটনা নিয়ে এনসিপির নীরবতা এবং ধর্ষণ নিয়ে এনসিপির নেতা হান্নান মাসউদের মিথ্যাচারের প্রতিবাদে পদ থেকে পদত্যাগ করছি। এনসিপির জন্য শুভকামনা।’

এ ঘটনার পর অলীকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি হতাশার কথা বললেন এনসিপিকে নিয়ে। তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন।

অলীক সরকারের কোনো গুরুদায়িত্বে নেই। অলীক পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নন, সমতলের মধুপুরের গারো জাতির মানুষ। কিন্তু দেশের একটি অঞ্চলে একটি সংখ্যালঘু জাতির প্রতি অব্যাহত নিপীড়ন মেনে নিতে পারেননি। পার্বত্য চুক্তির পর পাহাড়ে সহিংসতা কম হয়নি। কিন্তু গেল এক বছরে যা হলো, তা কোনোভাবেই মানা যায় না।

এ সরকারের আমলে ‘মব’ বা দলবদ্ধ সহিংসতাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে দেখা গেছে। এর বিস্তার ঘটেছে পাহাড়েও। পাহাড়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা বেড়েছে। তাতেও নির্বিকার সরকার। এ সরকারের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা কি অলীক মৃর প্রতিবাদের ঘটনা জানেন? তিনি কী ভাবছেন? সরকারের নিস্পৃহতা, কখনো ঘৃণা উসকে দেওয়া, মবকে ‘প্রেসার’ ও ক্ষোভের ধরন বলে চিহ্নিত করার উন্মাদ মন্তব্যের পর তিনি নিশ্চয়ই সরকারে, সংস্কারে থাকবেন। পাহাড়ে লাশ পড়ুক, ঘর পুড়ুক, তাতে কী আসে যায়!

  • পার্থ শঙ্কর সাহা প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক

*মতামত লেখকের নিজস্ব