কম্পিউটারে তালেবান যোদ্ধাদের কার্যক্রম দেখছেন এক তরুণ। খোস্ত প্রদেশ, আফগানিস্তান।
কম্পিউটারে তালেবান যোদ্ধাদের কার্যক্রম দেখছেন এক তরুণ। খোস্ত প্রদেশ, আফগানিস্তান।

মতামত

ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করে আফগানিস্তান কি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হবে

যখন আমি শিশু ছিলাম, তখন আফগানরা বিদেশে তাঁদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলার জন্য পাকিস্তান যেতে বাধ্য হতেন। আজ আমরা আবার এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছি। আমাদের হয়তো কেবল ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য প্রতিবেশী কোনো দেশে যেতে হবে।

গত সপ্তাহে কাবুল, কান্দাহার, হেলমান্দ, বলখসহ কয়েকটি প্রদেশে ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছে। এ পদক্ষেপ সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যদি তালেবান নেতৃত্ব তাঁদের নীতি পুনর্বিবেচনা না করেন, আফগানিস্তান বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।

শিগগিরই আপনি হয়তো আমার লেখা এবং লাখ লাখ আফগান নাগরিকের গল্প পড়তেও পারবেন না। কারণ, আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারব না। পুরো দেশে একটি নিঃশব্দ পরিবেশ বিরাজ করবে।

বলখ প্রদেশে ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার পর বলখের প্রাদেশিক সরকারের মুখপাত্র হাজি জায়েদ এক্সে বলেছেন, যাতে ‘অশ্লীলতা’ রোধ করা যায়, সে জন্য এ নিষেধাজ্ঞা সরাসরি তালেবান নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার নির্দেশে দেওয়া হয়েছে। তবে অনেকেই তাঁর পোস্টের প্রতি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, এই নীতি প্রয়োগের আগে একটি উপযুক্ত বিকল্প নিশ্চিত করা উচিত ছিল।

যদি দেশের সব জায়গায় ইন্টারনেট–সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়, তা আফগান নাগরিকদের জীবনকে অনেকভাবে প্রভাবিত করবে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে। অনলাইন শিক্ষা ও বৃত্তির সুযোগ হারিয়ে যাবে।

অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও, ই-গভর্নমেন্ট পরিষেবা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এবং অনলাইনে কাজ করা মানুষদের কাজও হাতছাড়া হবে। বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যাবে।

আমার পরিবারও এ পরিস্থিতিতে ভোগান্তির মুখে পড়বে। কয়েক বছর ধরে বেকারত্বের সঙ্গে লড়াই করার কারণে আমি ইন্টারনেটে বিভিন্ন উপার্জনের সুযোগ খুঁজে পেয়েছি। এর মধ্যে একটি হলো ইউটিউব চ্যানেল চালু করে দেশের সুন্দর স্থানগুলো দেখানো। আরও গুরুত্বপূর্ণ, ভালো ইন্টারনেট–সংযোগ না থাকলে আমরা বিদেশে থাকা সেসব পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেও সমস্যায় পড়তাম, যাদের সঙ্গে আমরা ফি বছর দেখা করার আশা করি না।

কাবুলের রাস্তায়। আফগানিস্তান

ইন্টারনেট বন্ধ করলে আফগানিস্তান বৈশ্বিক স্তরে আরও পশ্চাৎপদ হয়ে যাবে। এটি হবে নিজেই নিজেকে অঘোষিত একঘরে করে রাখার মতো। এটি আফগানিস্তানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ইতিমধ্যেই কষ্টে থাকা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

এ চরম পদক্ষেপের বদলে আফগানিস্তান চীনের উদাহরণ অনুসরণ করতে পারে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন ১৯৭৮ সালে দেং জিয়াওপিংয়ের প্রবর্তিত সংস্কার ও উন্মুক্ত নীতি গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে। এ নীতির ফলে চীন দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে একটি শিল্পায়িত শক্তি হিসেবে উঠেছে।

২০০০-এর দশকে চীনে ইন্টারনেট ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ার সময় কর্তৃপক্ষ কিছু ঝুঁকি দেখেছিল, কিন্তু তারা দেশকে বিশ্ব সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করার বদলে দেশি ইন্টারনেট অবকাঠামো ও ফিল্টার তৈরি করেছে। ১৪ কোটি চীনা নাগরিককে বিশ্ব সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন না করেই তারা ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়বস্তু ফিল্টার করছে।

আফগানিস্তানে বর্তমানে অবৈধ বা অশ্লীল ভিডিও সেন্সর করা হয়, যাতে নাগরিকেরা এসব দেখতে না পারেন। যদি সরকার মনে করে, এই ফিল্টারগুলো কার্যকর নয়, তবে প্রযুক্তির সাহায্যে এগুলো আরও কার্যকর করা সম্ভব। সবাইকে ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া বাস্তব জীবনে ‘অশ্লীলতা’ রোধ করতে পারবে না।

যদি আফগান সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করার মতো কঠোর পদক্ষেপ নেয় কেবল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে (বিশেষ করে অন্য দেশগুলোকে) আফগানিস্তানকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিতে চাপ দেওয়ার জন্য, তাহলে তা কোনো কাজে আসবে না। বরং এ ধরনের পদক্ষেপ সাধারণ আফগান জনগণকে বিপর্যয়ে ফেলবে। তাঁদের জীবিকা, শিক্ষা, ব্যবসা ও যোগাযোগ সব ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু এতে অন্য দেশগুলো তাদের নীতি বা আফগানিস্তানকে স্বীকৃতি দেওয়ার অবস্থান পরিবর্তন করবে না।

ইন্টারনেট এখন দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ। এটি খাদ্য ও পানির মতো মৌলিক প্রয়োজনের সমান। দুই দশক ধরে নেটিজেন হিসেবে বেঁচে থাকার পর প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে আমাকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্বপুরুষদের মতো জীবন যাপন করতে হবে—এটি ভাবলেই ভয় করে।

এই লেখা লিখতে গিয়ে আমি কয়েক মিনিট পরপর ইন্টারনেট–সংযোগ পরীক্ষা করেছি। আমার ভয় হচ্ছিল, ইন্টারনেট চলে যেতে পারে এবং সেটি হলে আর লেখা পাঠাতে পারব না।

আমাদের গল্পগুলো গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই বিশ্ব আমাদের শুনুক। সংকটের সময়ে আমাদের সহায়তা করুক। একটি পশ্চাৎপদ, বিচ্ছিন্ন ও দারিদ্র্যপীড়িত আফগানিস্তান কারও জন্যই উপকারী নয়।

আফগানরা বিশ্ব সম্প্রদায়ের অংশ হয়ে থাকতে চান, বিশ্ব সংযোগ বজায় রাখতে চান, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতায় সীমাবদ্ধ হতে চান না—এ কথা আফগান সরকারকে বুঝতে হবে।

  • হুজ্জাতুল্লাহ জিয়া কাবুলভিত্তিক সাংবাদিক ও ডেইলি আউটলুক আফগানিস্তান পত্রিকার সিনিয়র লেখক

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ