জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন সরকারি বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের হামলায় বহু মানুষ হতাহত হয়েছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব ঘটনায় অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়েছে। যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেই তালিকায় আছেন সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
বিগত সরকার এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের পাশাপাশি আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক, খেলোয়াড় বা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব, অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মামলা হয়েছে; তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হয়েছেন। এ রকম বেশ কিছু মামলা নিয়ে অনেক দিন ধরেই নানা ধরনের প্রশ্ন ও অভিযোগ উঠছে। এরপরও ঢালাও মামলা দেওয়া এবং সে রকম মামলায় গ্রেপ্তার বন্ধ হয়নি।
সম্প্রতি (১৮ মে) এ রকম ঢালাও মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া। এরপর বৃহস্পতিবার (২৮ মে) একই রকম একটি হত্যাচেষ্টার মামলায় গ্রেপ্তার হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এস এম আনোয়ারা বেগম। নুসরাত ফারিয়া কয়েক ঘন্টা কারাগারে থেকে পরের দিন জামিন পেয়েছেন। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার (২৯ মে) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত আনোয়ারা বেগমকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠান; শনিবার সন্ধ্যায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিনি কারাগারেই ছিলেন।
নুসরাত ফারিয়াকে হত্যাচেষ্টা মামলায় ১৯ মে তাঁকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হলে সেদিন উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত নুসরাত ফারিয়ার জামিনের বিষয়টি নিষ্পত্তি না করে ২২ মে আদেশের দিন ধার্য করেন। এর ফলে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। লক্ষণীয় হলো, কোনো মামলার আসামিকে আদালতে হাজির করার পর আদালত তাঁকে জামিন দিতে পারেন অথবা তাঁর জামিন নামঞ্জুরও করতে পারেন; কিন্তু এগুলোর কোনোটা না করে এভাবে ঝুলিয়ে রাখতে পারেন না। নুসরাত ফারিয়ার ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা একই সঙ্গে বেআইনি এবং বিচারিক হয়রানি।
কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো নুসরাত ফারিয়ার জামিন শুনানির দিন ২২ মে ধার্য থাকলেও তিনি ২০ মে সকালেই জামিন পেয়ে যান। মনে রাখতে হবে, আদালত স্বয়ংক্রিয় বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাউকে জামিন দেন না; এর জন্য আসামি বা আসামির আইনজীবীকে আদালতে আবেদন করতে হয়। এর ফলে যুক্তিসংগতভাবে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, নুসরাত ফারিয়াকে জামিন দেওয়া হবে, এমন নিশ্চয়তা দিয়েই কি কেউ আদালত কর্তৃক ধার্য ২২ মের দুই দিন আগেই জামিনের আবেদন করতে বলেছিল? আদালত, না সরকার, কে এটা আসামিপক্ষকে জানিয়েছিল?
সবচেয়ে অসংগতিপূর্ণ বিষয় হলো আদালত যে মামলায় ১৯ মে নুসরাত ফারিয়াকে জামিন দেয়নি, সেই একই আদালত মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর তাঁকে জামিন দেন। এটা কীভাবে সম্ভব! লক্ষণীয় হলো, নুসরাত ফারিয়াকে গ্রেপ্তারের পর তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সংস্কৃতিজগতের লোকজন ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এ বিষয়ে তাঁদের ‘অসন্তোষের’ কথা জানান। পুরো ঘটনাপ্রবাহ থেকে এমন সন্দেহ হওয়া খুবই স্বাভাবিক, সরকার জনমতের বিষয়টি আমলে নিয়ে নুসরাত ফারিয়াকে জামিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং আদালতের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে।
নুসরাত ফারিয়াকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে, সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘তাহলে এ ঘটনায় দায়ী পুলিশ কর্মকর্তা, কৌঁসুলি ও বিচারককে জবাবদিহির আওতায় কে আনবে? তাঁদের বিরুদ্ধে কি কোনো শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে? তাঁদের কেউ কি ক্ষমা চাইবেন? অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সদস্য কি এ ঘটনায় (এবং অনুরূপ অন্যান্য ঘটনায়) নিজেদের ভূমিকা বা নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আত্মসমালোচনা করবেন? তাঁরা কি শুধু হাত ধুয়ে দায় অন্যের ঘাড়ে চাপাবেন, নাকি উপলব্ধি করবেন যে এ মুহূর্তে তাঁদের ভূমিকা আরও কার্যকর হওয়া উচিত?...’ (সমকাল, ২১ মে ২০২৫)
নুসরাত ফারিয়াকে গ্রেপ্তার এবং তাঁকে বিচারিক হয়রানির ঘটনায় কারও বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানা যায়নি। এর ফলে এ ধরনের হয়রানি বন্ধে সরকার কতটা আন্তরিক, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুজন মোল্লার দায়ের করা হত্যাচেষ্টার মামলায়। আনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে ওই মামলা হয় রাজধানীর সূত্রাপুর থানায়। সূত্রাপুর থানার পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতকে বলা হয়, গত বছরের ১৯ জুলাই রায়সাহেব বাজারের কাছে স্টার হোটেলের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আন্দোলনকারী ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে গুলি চালানো হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এ ঘটনা ঘটান। এতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সুজন মোল্লার চোখে গুলি লাগে। বাঁ চোখ দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। এ ঘটনায় সুজন মোল্লা বাদী হয়ে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সূত্রাপুর থানায় মামলা করেন।’
আনোয়ারা বেগম একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু নুসরাত ফারিয়াকে গ্রেপ্তারের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, আনোয়ারা বেগমকে নিয়ে তেমনটা হয়নি; ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তিরাও তাঁদের অসন্তোষ বা বিব্রত হওয়া কথা জানাননি। এর ফলে নুসরাত ফারিয়ার মতো ‘তাড়াহুড়ো’ করে আনোয়ারা বেগমের জামিনের ব্যবস্থাও হয়নি।
অন্যদিকে আনোয়ারা বেগমের আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, ‘আনোয়ারা বেগম দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপনা করেছেন। ২০২১ সালে তিনি অবসরে যান। অবসরের পর কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না। তাঁকে হয়রানি করার জন্য এই মামলায় তাঁর নাম দেওয়া হয়েছে। তিনি জামিন দিলে পালাবেন না।’ উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে আনোয়ারা বেগমের জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। (প্রথম আলো, ২৯ মে ২০২৫)
আনোয়ারা বেগম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য ছিলেন। এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি কোন কোন শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের অভিযোগ উঠেছে। এ রকম অভিযোগ যদি সত্যি হয়, সেটার প্রতিকার কি তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা দেওয়া? পুলিশ যেভাবে চার বছর আগে অবসর নেওয়া একজন নারী অধ্যাপককে এই মামলায় আটক করল এবং আদালত তাঁকে জামিনবঞ্চিত করল তা কি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য? তাঁকে গ্রেপ্তার করে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর মাধ্যমে কি আইন-আদালত-বিচারব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হলো না?
নুসরাত ফারিয়া একজন অভিনেত্রী বা ‘সেলিব্রিটি’। তাঁর গ্রেপ্তার নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পী এবং চলচ্চিত্র পরিচালকদের কেউ কেউ; এমনকি সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একাধিক প্রভাবশালী নেতা ফেসবুকে এ বিষয়ে স্ট্যাটাস দেন। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই নুসরাত ফারিয়া জামিন পেয়ে যান।
অন্যদিকে আনোয়ারা বেগম একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু নুসরাত ফারিয়াকে গ্রেপ্তারের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, আনোয়ারা বেগমকে নিয়ে তেমনটা হয়নি; প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও তাঁদের অসন্তোষ বা বিব্রত হওয়ার কথা জানাননি। এর ফলে নুসরাত ফারিয়ার মতো ‘তাড়াহুড়ো’ করে আনোয়ারা বেগমের জামিনের ব্যবস্থাও হয়নি।
নুসরাত ফারিয়া এবং আনোয়ারা বেগমের ঘটনাপ্রবাহ থেকে এমনটা প্রতীয়মান হতে পারে, সরকারের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি আদালতও এখন অনেকটাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ জনমত দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে; এরকমটা হলে তা ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করবে; এভাবে চলতে থাকলে বিচারিক হয়রানি বাড়তে থাকবে এবং বিচার বিভাগ হয়ে পড়বে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছেপূরণের হাতিয়ার।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক