
আধুনিক সমাজে শুধু আইন প্রয়োগ নয়, বরং জনগণের আস্থা অর্জন ও অংশীদারিমূলক নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রেক্ষাপটে ‘কমিউনিটি পুলিশিং’ ধারণাটি বাংলাদেশে দিন দিন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ পুলিশ কয়েক বছর ধরে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম সম্প্রসারণে কাজ করছে। বর্তমানে দেশের প্রায় প্রতিটি থানা ও ইউনিয়নে কমিউনিটি পুলিশিং ফোরাম গঠিত হয়েছে। সন্ত্রাস, মাদক, কিশোর গ্যাং, নারী নির্যাতন, সাইবার অপরাধসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যায় জনগণ ও পুলিশের যৌথ উদ্যোগে কাজ চলতে দেখা যাচ্ছে।
তবে বাস্তবতার আলোকে এই কার্যক্রম এখনো প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। রাজনৈতিক মেরুকরণ, অবিশ্বাস এবং অপর্যাপ্ত সম্পদের কারণে জনগণের সঙ্গে পুলিশের কার্যকর অংশীদারি গড়ে উঠতে সময় লাগছে।
কমিউনিটি পুলিশিং ধারণাটি সরাসরি আইনশাস্ত্রের কোনো ধারায় উল্লেখ নেই, তবে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর বেশ কিছু ধারা জনগণের অংশগ্রহণ, সহযোগিতা ও পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভিত্তি তৈরি করছে। যেমন ৪২-৪৪ ধারাতে জনগণের কর্তব্য পুলিশকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, অপরাধী বা জননিরাপত্তার হুমকি সম্পর্কে তাৎক্ষণিক তথ্য দেওয়া এবং প্রয়োজনে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া জনগণকে চুরি, দস্যুতা ও ডাকাতি–সংক্রান্ত অপরাধ ও অন্যান্য কিছু অপরাধ সংঘটনের তথ্য পুলিশের কাছে সরবরাহ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশি কার্যক্রমের ভিত্তি পিআরবি-এর ৩২ বিধিতে পুলিশকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের সহযোগিতা গ্রহণ এবং তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং সেই লক্ষ্যে সহযোগিতা সভার আয়োজন করতে বলা হয়েছে।
৩৩ নম্বর বিধিতে স্থানীয় জনগণের সহিত সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই দুটি বিধি প্রত্যক্ষভাবে কমিউনিটি পুলিশিং সংক্রান্ত কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে (২০০৬ ও ২০১০ সালে) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম চালু ও সম্প্রসারণ করা হয়।
এসব আইনি ভিত্তি কমিউনিটি পুলিশিংকে একটি বৈধ ও কাঠামোবদ্ধ রূপ দান করেছে।
স্থানীয়ভাবে ছাত্র ও জনগণকে যুক্ত করলে কমিউনিটি পুলিশিং আরও কার্যকর হতে পারে। এতে বাল্যবিবাহ কমানো, ইভ টিজিং প্রতিরোধ, সন্ত্রাস দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং মব-সন্ত্রাস রোধে বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব। এই সহযোগিতা কাজে লাগানোর মতো বড় সুযোগ এখন রয়েছে।
কমিউনিটি পুলিশিং বাস্তবায়নে কয়েকটি বড় বাধা আছে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিকেরা এতে যুক্ত হওয়ায় দলীয় প্রভাব ঢুকে পড়েছে। কিছু পুলিশ কর্মকর্তা স্বেচ্ছাচারিতা করেন, ঘুষ ও দুর্নীতি করেন—এ কারণে পুলিশের ওপর মানুষের ভয় ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। যারা কমিউনিটি পুলিশিংয়ে কাজ করেন, তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। ফোরামের নেতা ও সদস্যদের অনেকেই নিজের দায়িত্ব কী, তা ভালো করে জানেন না। অনেকে আবার নিজেরা ফৌজদারি অপরাধের মতো অ-আপসযোগ্য মামলাতেও হস্তক্ষেপ করতে চান।
এ কাজে আলাদা সরকারি বাজেট বা অর্থ বরাদ্দ নেই। লজিস্টিকসেরও অভাব আছে। কিছু অপরাধী নানা কৌশলে কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের সদস্য হয়ে যায়। তাদের অনেকের মাদক প্রতিরোধ, বাল্যবিবাহ রোধ, কিশোর অপরাধ দমন ও সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় সক্ষমতা কম। জুলাই বিপ্লবের পর নতুন রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতাও এ প্রক্রিয়ায় নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
জুলাই বিপ্লবের পরের ২-৩ দিন বাংলাদেশ প্রায় সরকারবিহীন ছিল। সে সময় মানুষ পুলিশের অভাব খুব স্পষ্টভাবে টের পেয়েছে। বিভিন্ন পাড়ায় মানুষ নিজেরাই রাতে পাহারা দিয়েছে। ছাত্ররা রাস্তায় নেমে ট্রাফিক সামলেছে। এসব ঘটনা দেখায় যে অপরাধ দমনে সাধারণ মানুষ পুলিশের কাজে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
স্থানীয়ভাবে ছাত্র ও জনগণকে যুক্ত করলে কমিউনিটি পুলিশিং আরও কার্যকর হতে পারে। এতে বাল্যবিবাহ কমানো, ইভ টিজিং প্রতিরোধ, সন্ত্রাস দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং মব-সন্ত্রাস রোধে বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব। এই সহযোগিতা কাজে লাগানোর মতো বড় সুযোগ এখন রয়েছে।
লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিষ্ঠাতা (পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের দুই দুইবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী) আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থার জনক স্যার রবার্ট পিল ১৮২৯ সালে সাধারণ পুলিশিংয়ের জন্য অসাধারণ ৯টি নির্দেশনা প্রদান করেন। এই ৯ নীতিকে বাংলাদেশ কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে:
১. পুলিশের মূল লক্ষ্য হচ্ছে অপরাধ প্রতিরোধ ও জনশৃঙ্খলা রক্ষা করা।
২. পুলিশ তার ক্ষমতা জনগণের সম্মতি ও সহযোগিতা থেকে লাভ করে।
৩. জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা পুলিশকে আইন প্রয়োগে সফল করে।
৪. জনগণের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারলেই তারা পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করে।
৫. পুলিশকে সব সময় নিরপেক্ষ থাকতে হবে এবং জনমতের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে।
৬. বল প্রয়োগ করা হবে কেবল তখনই যখন সব শান্তিপূর্ণ উপায় ব্যর্থ হয়।
৭. পুলিশ শাসকের মতো নয়—জনগণের বন্ধু ও সেবকের মতো আচরণ করবে।
৮. পুলিশের উদ্দেশ্য হলো অপরাধ সংঘটনের আগে তা প্রতিরোধ করা; কেবল ঘটার পর শাস্তি দেওয়া নয়।
৯. পুলিশের সাফল্য অপরাধ কমার মাধ্যমে প্রমাণিত হবে; গ্রেপ্তার বাড়ার মাধ্যমে নয়।
বাংলাদেশে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যকর করতে কিছু বাস্তব কৌশল প্রয়োজন। এর জন্য এমন সামাজিক ব্যক্তিদের যুক্ত করতে হবে, যাঁরা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ এবং সরকার পরিবর্তন হলেও দেশে থাকবেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। থানা ও ফাঁড়ির পুলিশের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। কমিউনিটি পুলিশিং-অ্যাপ, হটলাইন, অনলাইন রিপোর্টিং ইত্যাদিসহ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। জনগণের সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত প্রচার ও কার্যক্রম চালাতে হবে।
এলাকার অপরাধের ধরন এবং জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য বুঝে সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা ও নীতি করতে হবে।
মো. শাহ্জাহান হোসেন পিপিএম; উপ-পুলিশ কমিশনার; ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ডিভিশন; ডিএমপি।
ই–মেইল: princeofbuilders@gmail.com
*মতামত লেখকের নিজস্ব