Thank you for trying Sticky AMP!!

ভারত নিয়ে কিসিঞ্জার কেন উল্টো গান গাইলেন

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মার্কিন কূটনীতির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাঁকে। গত মে মাসে কিসিঞ্জারের ১০০ বছর বয়স হয়। দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ অবলম্বনে গত ১০ সেপ্টেম্বর এ লেখাটি লিখেন সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক। লেখাটি আবার প্রথম আলোর পাঠকদের সামনে আনা হলো।

হেনরি কিসিঞ্জার

কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, ক্ষমতার পুরোনো বলয়গুলো ক্রমে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে নতুন কিছু দেশ ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

এ রকমই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকা একটি দেশ ভারত সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘ভারতীয়রা এখন যে পররাষ্ট্রনীতির চর্চা করছে, তা খুবই চমৎকার, কারণ সেখানে একটা ভারসাম্য আছে।’ অথচ এই কিসিঞ্জারই ১৯৭১ সালে ভারতের প্রতি চরম বিমুখ ছিলেন। সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে দেখা করতে যান, তখন কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, ভারতীয়রা খুবই আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন।

এখন কী এমন হলো যে সেই কিসিঞ্জারই ভারত সম্পর্কে উল্টো গীত গাইছেন? কারণ, ভারত আর সেই ভারত নেই। তার মানবসম্পদ ও অর্থনীতির উন্নতি হয়েছে। চীনকে বাগে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। এই সুযোগে ভারতও তার পুরোনো সোভিয়েত বলয় থেকে সরে এসে পশ্চিম থেকে যত রকম সুযোগ-সুবিধা নেওয়া যায়, সেসব নেওয়ার চেষ্টা করছে।

জওহারলাল নেহরু যে জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছিলেন, সেটা থেকে ভারত এখনো খুব একটা দূরে সরে যায়নি এবং এই মনোভাব যত দিন অবশিষ্ট থাকবে, পশ্চিমারা ভারতকে খুব আপন ভাবতে পারবে না।

যদিও চীনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত হলে সে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে চায়, পশ্চিমের সঙ্গে তার সম্পর্কটা এখনো মূলত অর্থনৈতিক, স্ট্র্যাটেজিক নয়। কারণ, সে রাশিয়াকে ছাড়তে রাজি নয়।

সে ইউক্রেন আক্রমণকে নিন্দা জানায়নি। রাশিয়া থেকে একদিকে সে যেমন অস্ত্র কেনে, অন্যদিকে তেল কিনে সে প্রচুর লাভও করে। হয়তো এসব কারণেই এ বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে তার প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

গত দুই দশকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এর কারণ হিসেবে একদিকে যেমন আছে তাদের অভিন্ন স্বার্থ এবং অন্যদিকে অত্যন্ত শক্তিশালী ইন্ডিয়ান-আমেরিকান ডায়াসপোরার প্রভাব। এ প্রভাব ভবিষ্যতে বাড়তেই থাকবে এবং এ দুই দেশ আরও ঘনিষ্ঠ হবে। এ কারণেই দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ স্টেফান কোহেন ভারতকে পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, পাকিস্তান সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ছিল, কিন্তু কখনো বন্ধু হয়নি আর ভারতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারে উল্টো।

দুদিক থেকে সুবিধা নেওয়ার এই কৃতিত্ব কিসিঞ্জার মূলত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে দিতে চান। ভারতের সবচেয়ে ভালো কূটনীতিকদের একজন—যিনি ওয়াশিংটন ও বেইজিং দুই জায়গাতেই কাজ করেছেন—৬৮ বছর বয়স্ক সেই জয়শঙ্করই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মূল কারিগর।

এস জয়শঙ্কর পৃথিবীর নতুন মেরুকরণকে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে বিবেচনা করছেন। তিনি ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্তমান পৃথিবীকে চীন-যুক্তরাষ্ট্রে বিভক্ত বিশ্ব হিসেবে দেখেন না। তিনি মনে করেন, এখন অন্তত চারটা বড় শক্তিকে বিবেচনায় রাখতে হবে—যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারত।

এখন সময়টা এমন, যেকোনো একটি বলয়ে ঢুকে বসে থাকলে চলবে না; সবার সঙ্গে সমান মাত্রায় না হলেও অন্তত ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় সম্পর্ক রাখতে হবে, যেন বেছে নেওয়ার মতো কিছু বিকল্প সব সময় হাতে রয়ে যায়।

এস জয়শঙ্কর তাঁর এক বইয়ে লিখেছেন, ‘বহুমেরুর এই পৃথিবী হচ্ছে এক ফ্রেনেমির পৃথিবী।’ ‘ফ্রেনেমি’ হচ্ছে সে-ই, যে একই সঙ্গে ফ্রেন্ড ও এনেমি। তবে তিনি আবার একইভাবে দীর্ঘদিনের অংশীদারত্বকেও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আগে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব থাকার কারণে আদর্শগত যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, ভারত এখন তা ঝেড়ে ফেলেছে। সে এখন মাটির ওপর হাঁটা শিখেছে।

এস জয়শঙ্করের মতে, এই ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক দুটি কারণে আরও দৃঢ় হবে। এর একটি কারণ হচ্ছে চীন থেকে সরে এসে সাপ্লাই চেইনের বৈচিত্র্য বাড়া এবং আরেকটি ডিজিটালাইজেশনের আওতা বৃদ্ধি পাওয়া। জয়শঙ্করের মতে, এটা হচ্ছে ‘নতুন বিশ্বায়ন’, যার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক আস্থার ওপর।

এস জয়শঙ্কর যেটা বোঝাতে চাইছেন, সেটা হচ্ছে ভারতের বিশ্বস্ততা যাচাই করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যদি এখন ভারতকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে বলে, সেটা ঠিক হবে না। কারণ, ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন সুসম্পর্ক প্রায় ৬০ বছরের পুরোনো। তা ছাড়া ১৯৬৫ সালে ভারতের ওপর আমেরিকান অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাই ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

তাই ভারত যে এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে, এতে জয়শঙ্করের কোনো অপরাধবোধ নেই এবং এ রকম আরও সুবিধা নিতে পারলেই তিনি খুশি।

তা ছাড়া তিনি মনে করেন, রাশিয়া আদতে একটা ইউরেশিয়ান দেশ এবং আপাতত পশ্চিমের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এদিকে প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত ক্রমবর্ধমান হারে ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠায় সে রাশিয়ার রিসোর্সগুলো আরও বেশি ব্যবহার করতে চাইছে।

ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারত ও রাশিয়ার স্বার্থ অভিন্ন বলে তারা নিজেদের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক বজায় রাখবেই। এ ছাড়া রাশিয়াকে পাশে পেলে একদিকে যেমন পশ্চিমের চাপ সহ্য করা সহজ হবে, অন্যদিকে চীন ও পাকিস্তান যেন ভারতের পেছনে লাগার সময় রাশিয়ার সমর্থন না পায়, সেটাও নিশ্চিত হবে।

একইভাবে, গত দুই দশকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এর কারণ হিসেবে একদিকে যেমন আছে তাদের অভিন্ন স্বার্থ এবং অন্যদিকে অত্যন্ত শক্তিশালী ইন্ডিয়ান-আমেরিকান ডায়াসপোরার প্রভাব।

এ প্রভাব ভবিষ্যতে বাড়তেই থাকবে এবং এ দুই দেশ আরও ঘনিষ্ঠ হবে। এ কারণেই দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ স্টেফান কোহেন ভারতকে পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, পাকিস্তান সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ছিল, কিন্তু কখনো বন্ধু হয়নি আর ভারতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারে উল্টো।

যাহোক, ভারতের মতো নীতি অনেকেই অনুসরণ করতে চায়, কিন্তু সবার পক্ষে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ, কিসিঞ্জারের মতে, এর জন্য চাই ভারতের মতো মানবসম্পদ ও অর্থনীতি এবং জয়শঙ্করের মতো একজন পররাষ্ট্রবিশেষজ্ঞ। তা না হলে ‘ফ্রেনেমিদের’ সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া সত্যিই কঠিন।

  • সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক পিএসসির সদস্য এবং মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক

    (দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ অবলম্বনে)