ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডার লেনের হাতে এমন দুটি শক্তিশালী হাতিয়ার আছে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বুদ্‌বুদ ফাটিয়ে দিতে পারে।
ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডার লেনের হাতে এমন দুটি শক্তিশালী হাতিয়ার আছে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বুদ্‌বুদ ফাটিয়ে দিতে পারে।

মতামত

ট্রাম্পকে ঘায়েলের দুই গোপন অস্ত্র ইউরোপের হাতে!

যা একসময় কল্পনাও করা যায়নি, সেটাই ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন আর ইউরোপের বন্ধু নয়; বরং প্রতিপক্ষ। ট্রাম্প প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা নীতিতে যে স্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা আছে, তা ইউরোপের নেতাদের আর কোনো দ্বিধায় থাকার সুযোগ দিচ্ছে না। এর চেয়েও গুরুতর বিষয় হলো ইউরোপের ভেতরেই ইউরোপে চলমান পদ্ধতির বিরোধিতা তৈরি করা এখন যুক্তরাষ্ট্রের খোলাখুলি ঘোষিত নীতি। অর্থাৎ এখন আর গোপনে নয়, ওয়াশিংটন প্রকাশ্যেই ইউরোপকে দুর্বল করতে চায়।

এ বাস্তবতার ভেতরেই রয়েছে এক স্পষ্ট বার্তা, ইউরোপ হয় লড়বে, নতুবা ধ্বংস হবে। অর্থনৈতিক, নিয়ন্ত্রক ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতার মতো কিছু শক্তিশালী তুরুপের তাস আছে ইউরোপের হাতে। ইউরোপের নেতারা যদি সতর্কতা ঝেড়ে ফেলে সাহসী ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তবে এসব তাস কার্যকরভাবে খেলানো সম্ভব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বাজি এখন এতটাই বিশাল যে ‘মেগা’ (কট্টর জাতীয়তাবাদী শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান) সমর্থকদের পেনশন পর্যন্ত একটি ভঙ্গুর এআই বুদ্‌বুদের টিকে থাকার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিনিয়োগ এখন মার্কিন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি, যা ভোক্তা ব্যয়ের সমান গুরুত্বপূর্ণ। চলতি বছরের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রায় ৯২ শতাংশ এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাদ দিলে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় নগণ্য, মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। ডোনাল্ড ট্রাম্প যতই সাহসী বক্তব্য দিন না কেন, তাঁর অর্থনৈতিক ভিত্তি মোটেও শক্ত নয়।

ট্রাম্পের রাজনৈতিক জোটও ভঙ্গুর। জুলাই মাসে ও চলতি মাসে ট্রাম্প সিনেটে রিপাবলিকানদের বাধ্য করার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর প্রস্তাবিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিষেধাজ্ঞা (মোরাটোরিয়াম) পাস করাতে, যা যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোকে নিজেদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নীতিমালা তৈরিতে বাধা দিত। তবে ট্রাম্পের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেছেন, তিনি ইউরোপের নেতাদের দুর্বল মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন যে তাঁরা তাঁদের নাগরিকদের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান রক্ষা করতে অক্ষম। এখন পর্যন্ত ইউরোপের প্রতিক্রিয়া সেই ধারণাকেই শক্ত করেছে। ইউরোপ যদি এখন ক্ষমতা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে এ সংঘাতের চূড়ান্ত ফলাফল হয়তো ওয়াশিংটনে নয়, ব্রাসেলসেই নির্ধারিত হবে।

মেগা আন্দোলনের স্টিভ ব্যাননপন্থী অংশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থান হারানোর আশঙ্কায় ভীত এবং শিশুরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কী দেখছে, তা নিয়েও উদ্বিগ্ন। মেগা ভোটাররা বড় মাত্রার প্রযুক্তির রাজনৈতিক ক্ষমতা গভীরভাবে অবিশ্বাস করেন। তাই প্রযুক্তি নীতি ট্রাম্পের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দুর্বলতাগুলোর একটি।

ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডার লেনের হাতে এমন দুটি শক্তিশালী হাতিয়ার আছে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বুদ্‌বুদ ফাটিয়ে দিতে পারে। তিনি যদি এগুলো ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি গুরুতর সংকটে পড়তে পারে।

প্রথম হাতিয়ারটি হলো এএসএমএল। নেদারল্যান্ডসের এই কোম্পানি এমন এক প্রযুক্তির ওপর বৈশ্বিক একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রাখে, যাকে বলা হয় এক্সট্রিম আলট্রাভায়োলেট লিথোগ্রাফি। এটি অত্যাধুনিক চিপ বানানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি আলো ব্যবহার করে মাইক্রোচিপ তৈরি করে এবং আধুনিক চিপ উৎপাদনে এগুলো অপরিহার্য। বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি কোম্পানি হিসেবে বিবেচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিপ নির্মাতা এনভিডিয়া এই যন্ত্রগুলোর ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।

এ যন্ত্রের রপ্তানি সীমিত করলে নেদারল্যান্ডসের জন্য তা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হবে এবং ইউরোপের জন্য রাজনৈতিকভাবে কঠিন সিদ্ধান্ত হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ ক্ষতির পরিমাণ হবে অনেক বেশি। ইউরোপ যদি যুক্তরাষ্ট্রে অথবা তাইওয়ানে এ যন্ত্র রপ্তানি ধীর করে বা বন্ধ করে দেয়, তাহলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান এবং একে ভর করে গড়ে ওঠা ডেটা সেন্টারগুলো একেবারে দেয়ালে ঠেকবে। এইভাবে ইউরোপ চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বাড়বে, নাকি সংকুচিত হবে, সে বিষয়ে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

এদিকে ইউরোপের হাতে থাকা দ্বিতীয় হাতিয়ারটি ব্যবহার করা তুলনামূলকভাবে সহজ। সেটি হলো ইউরোপের বহুদিন ধরে অবহেলিত তথ্য সুরক্ষা আইন কঠোরভাবে কার্যকর করা। যুক্তরাষ্ট্রে চলমান মামলার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত গোপন নথি দেখায়, গুগলের মতো কোম্পানিগুলো কতটা দুর্বল সাধারণ তথ্য সুরক্ষা আইন প্রয়োগের সামনে। অন্যদিকে মেটা এখনো মার্কিন আদালতে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি, তাদের অভ্যন্তরীণ সিস্টেম কীভাবে ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে, কারা সেই তথ্য দেখতে পারে কিংবা কী উদ্দেশ্যে তা ব্যবহৃত হয়।

এ অনিয়ন্ত্রিত তথ্য ব্যবহারের সুযোগ কোম্পানিগুলোকে বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলকে প্রশিক্ষণ দিতে সাহায্য করছে, যা ইউরোপীয় আইনের আওতায় সম্পূর্ণ বেআইনি।

এদিকে ব্রাসেলস যদি কেবল আয়ারল্যান্ডকে বাধ্য করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়মগুলো ধারাবাহিক ও কঠোরভাবে কার্যকর করতে, তাহলে মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ভয়াবহ পরিণতির মুখে পড়বে। তথ্যের জবাবদিহির নিয়ম মানতে হলে তাদের পুরো প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা একেবারে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের জানাতে হবে যে নিয়ম না মানা পর্যন্ত তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পণ্য ইউরোপের মূল্যবান বাজারে নিষিদ্ধ থাকবে। এই দুই দিকের একসঙ্গে আঘাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বুদ্‌বুদ টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।

মেগা ভোটাররা তাঁদের সাংবিধানিক অধিকার বা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হারানোর জন্য ভোট দেননি। কিন্তু ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা ট্রাম্প গভীরভাবে অজনপ্রিয় একটি প্রযুক্তি খাতের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় স্থিতিশীলতা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ কারণে ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে (মিডটার্ম) তিনি মারাত্মকভাবে দুর্বল অবস্থায় পড়বেন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ঝুঁকির ভারসাম্য স্পষ্টভাবে ইউরোপকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে। এক বছর ধরে আপসের নীতি দেখিয়েছে যে নমনীয়তা ট্রাম্পকে আরও সাহসী করে তোলে। সংযমের যুক্তিগুলো দ্রুতই ফুরিয়ে যাচ্ছে।

ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেছেন, তিনি ইউরোপের নেতাদের দুর্বল মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন যে তাঁরা তাঁদের নাগরিকদের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান রক্ষা করতে অক্ষম। এখন পর্যন্ত ইউরোপের প্রতিক্রিয়া সেই ধারণাকেই শক্ত করেছে। ইউরোপ যদি এখন ক্ষমতা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে এ সংঘাতের চূড়ান্ত ফলাফল হয়তো ওয়াশিংটনে নয়, ব্রাসেলসেই নির্ধারিত হবে।

  • জনি রায়ান, পরিচালক, এনফোর্স (আইরিশ কাউন্সিল ফর সিভিল লিবার্টিজের একটি বিভাগ)

গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত