মতামত

‘স্যার’ হওয়ার বিড়ম্বনা থেকে নারীর মুক্তি

আমি ও আমার বর দুজনেই সরকারি কর্মচারী ছিলাম একসময়। বলা বাহুল্য তার অধস্তন সহকর্মীরা আমাকেও স্যার সম্বোধন করতেন। কেবল গৃহবধূ হলে ‘ভাবি’ ডাকতেন নিঃসন্দেহে। একদিন ফোনে এক বিনয়ী পুরুষকণ্ঠ অনুরোধ করলেন ‘স্যার, মেয়ের বিয়ের কার্ড দিতে আসব। স্যার কি বাসায় থাকবেন স্যার?’ শোনামাত্র বুঝতে পারলাম না তিনি কি আমাকেই বাসায় আছি কি না, জিজ্ঞাসা করলেন নাকি তার নিজের বসকে? বললাম ‘উনি বাইরে, আমি আছি।’ ‘স্যার, আপনাকেই দিতে চাচ্ছি স্যার।’ বুঝলাম।

আশির দশকে এক সরকারি দপ্তরে সেই প্রথম আমরা চারজন নারী প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করি। আমাদের সঙ্গে যোগদান করেন আরও ২৫ পুরুষ সহকর্মী। বেশ কজন সহকারী ও বার্তাবাহক নারী আগেই সেই দপ্তরে ছিলেন। প্রথম কয়েক দিন কক্ষ বরাদ্দ না হওয়া অবধি আমরা সবাই হলরুমে বসে কাজ বুঝে নিচ্ছিলাম।

একজন পুরুষ বার্তাবাহক হাত কচলাতে কচলাতে পুরুষ সহকর্মীদের কাছে গিয়ে বললেন, স্যার, আপনাদের জন্য কি চা-শিঙাড়া আনব? পরে আমাদের দিকে এসে বিনয়ের ধার না ধেরে সটান জিজ্ঞাসা করলেন ‘বইন, আপনারা কি চা খাবেন?’ সে সময়ে নারীদের ম্যাডাম বা ম্যাম ডাকের প্রচলন শুরু হয়নি। বার্তাবাহক ‘আপা’ সম্বোধনও করলেন না।

আমাদের দেশে কোনো নারী যদি ‘স্যার’ ডাক শুনতে ভালোবাসেন, সেটি তার ব্যক্তিগত ক্ষমতার সীমাকে বিস্তৃত করার অভিপ্রায়ে; কিন্তু কেউ যদি না জেনে বা অভ্যাসবশত সেই নারীকে আপা/ম্যাডাম বা অতি বিনয়ে মা জননী ডেকে বসেন, তখন সম্বোধনকারীর ওপর খড়্গহস্ত হওয়া প্রমাণ করে তার শিক্ষা ও সংস্কৃতির অসম্পূর্ণতাকে।

যাহোক এরপর দীর্ঘ পথপরিক্রমায় যথাক্রমে আপা ও ম্যাডাম অতিক্রান্ত হয়ে কবে কবে যেন নারী ‘স্যার’ হয়ে উঠলেন। এই সম্বোধন কে বা কারা কবে এবং কোন প্রজ্ঞাপনবলে শুরু করে দিলেন, তা চোখে পড়েনি; কিন্তু ব্যাপক হারে ‘স্যার, স্যার’ ধ্বনিত হতে লাগল। বিদেশি সংস্থার সঙ্গে কাজ করার সুবাদে চিঠিপত্রে যোগাযোগ বজায় রাখার সময় অপর পক্ষ চিঠির সম্বোধনে ‘ডিয়ার স্যার/ম্যাডাম’ লিখত। সামনাসামনিও তারা নারী চাকুরেদের সম্মান দেখিয়ে কখনো কখনো ম্যাডাম ডাকত, পুরুষদের নাম ধরে মি. অমুক।

জানি না কোনো দেশে ডাকে কি না, তবে আমার জানামতে বিশ্বের কোথাও নারী অফিশিয়াল বা নারী রাজনৈতিক ব্যক্তিকে কেউ ‘স্যার’ সম্বোধন করেন না। সেখানে নাম ধরে ডাকারই রেওয়াজ। খুব সম্মান করে আফ্রিকার কোনো দেশ সমাজে বিশেষ সম্মানিত নারীদের নামের আগে ‘লেডি’ ব্যবহার করেন। যেমন কারও নাম যদি হয় ইশরাত জাহান, তাকে ডাকেন ‘লেডি ইশরাত’ বলে।

আমাদের দেশে কোনো নারী যদি ‘স্যার’ ডাক শুনতে ভালোবাসেন, সেটি তার ব্যক্তিগত ক্ষমতার সীমাকে বিস্তৃত করার অভিপ্রায়ে; কিন্তু কেউ যদি না জেনে বা অভ্যাসবশত সেই নারীকে আপা/ম্যাডাম বা অতি বিনয়ে মা জননী ডেকে বসেন, তখন সম্বোধনকারীর ওপর খড়্গহস্ত হওয়া প্রমাণ করে তার শিক্ষা ও সংস্কৃতির অসম্পূর্ণতাকে।

প্রশাসনের নারী কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ ডাকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তোলপাড় হয়েছে বেশ আগে। ‘স্যার’ তো পুরুষ, নারী কোন ‘ছার’! কেউ বলেন কেউ কারও স্যার নয়, যে ইংরেজ এ দেশে ‘স্যার’ সম্বোধন চালু করেছিল, তার নিজের দেশ থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন বিলুপ্ত হয়ে গেছে বহু আগে। তা বটে।

কিছুদিন আগে একটা ভিডিও বেশ প্রচার পেয়েছিল। তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। দেখা গেল, তিনি একটি পুরোনো বাইসাইকেল দাঁড় করিয়ে মোড়ের দোকান থেকে কী যেন কিনলেন। তারপর নড়বড়ে সাইকেলটি বেশ কসরত করে চালিয়ে চলে যাওয়ার সময় পেছনের দোকান থেকে এক তরুণ বলে উঠলেন ‘বি কেয়ারফুল, বরিস’।

কেউ বলছেন ‘স্যার’ বলব কেবলমাত্র শিক্ষকদের। শিক্ষক ছাড়া কোনো স্যার নেই। তাঁর মাথায় ছিল নিশ্চয়ই পুরুষ শিক্ষক। তিনি তার জীবদ্দশায় হয় নারী শিক্ষক পাননি, নয়তো নারী শিক্ষককে ‘স্যার’ ডাকার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি। কারণ, ‘স্যার’ শব্দটি পুরুষবাচক বলেই ধরে নেওয়া হয়। যদি সেই স্যার হন নারী নিপীড়ক ও নারীবিদ্বেষী, তাহলেও কি কেবল শিক্ষক বলেই তাকে কদমবুসি করা যাবে?

এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নারী শিক্ষক ‘স্যার’ হয়ে ওঠেননি। যদিও ‘স্যার’ শব্দটির অর্থ জনাব বা মহোদয় করেছি আমরা, তাই এটাকে একটি জেন্ডার-নিরপেক্ষ শব্দ ধরে নেওয়া যায়। চিঠিপত্রে চলে; কিন্তু কাউকে জনাব বা মহোদয় সম্বোধনে ডাকি না। প্রতিরক্ষা বাহিনী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আইন পেশা, ব্যবসায় বা বেসরকারি সংস্থায় নারী কর্মকর্তারা ‘স্যার’ নামে সম্বোধিত হন বলে শুনিনি। আবার হতেও পারে।

প্রশাসনের কর্মকর্তাদের স্যার বা ম্যাডাম বলে সম্বোধন করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই—বলেছিলেন, বিতাড়িত বাংলাদেশের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। তাহলে কে কাকে কী নামে সম্বোধন করবেন, তার কোনো জুতসই জবাব পাওয়া যায়নি। ভাশুরের নাম মুখে না এনে ধরেই নেওয়া যায় অতি উৎসাহীরা ‘মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে ক’রে গমন হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়, সেই পথ লক্ষ্য ক’রে স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে আমরাও হব বরণীয়।’ তবে জ্ঞানী মহাজনেরা নিজের আকাঙ্ক্ষা অপরের ওপর চাপিয়ে দেন না।

কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্রী আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে ব্রিটিশ সরকার ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করলে তিনি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নামে পরিচিতি পান। ওদিকে বিশ্বের বিজ্ঞানীদের পথিকৃৎ নোবেলজয়ী মারিয়া স্ক্লোডোস্কার কুরিকে মাদাম মেরি কুরি হিসেবেই বিশ্ব চেনে, স্যার মেরি কুরি নয়। সুতরাং লিঙ্গ বিভেদ হলেও স্যার ও ম্যাডামের অর্থ অভিন্ন।

একবার বিদেশে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, সকালে অফিসে সাদা বস স্টিফেন কফি বানাচ্ছেন আর তাঁর অফিস সহকারী আফ্রিকান নারী ডেভি চিঠিপত্র সামলাতে সামলাতে বসকে বলছেন ‘স্টিফেন, আমাকেও এক কাপ দিয়ো।’ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল বাংলাদেশে আমার বসের চেহারা। তিনি নিজে কফি বানাবেন আর আমি পাতি কর্মকর্তা তাঁর কাছে এক কাপ চাইব, তার আগে আমার মরণ হলে ভালো। আমরা বীরের জাতি, সভ্য বলে আস্ফালন করা পাক-পবিত্রদের খেদিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে লাঠিসোঁটা দিয়ে দেশ স্বাধীন করি; কিন্তু বসদের প্রভু মানি আর প্রভুরা সেবাগ্রহীতাদের গোলাম ভাবেন।

সম্প্রতি নারী কর্মকর্তাদের স্যার ডাকার বিধান বাতিল করা হয়েছে। সরকারে নারী নেতৃত্ব বা সরকারি চাকরিতে নারীদের ক্রমবর্ধমান অন্তর্ভুক্তি দেশের সার্বিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য মাত্রা যোগ করেছে সন্দেহ নেই; কিন্তু পুরুষ ও ক্ষমতা যে একে অন্যের পরিপূরক—এই ধারণায় মনোজগৎ এখনো স্থির। যেন ক্ষমতাবান হতে হলে পুরুষ হতে হবে। তাই নারীর ‘স্যার’ ডাক শুনতে চাওয়াও একধরনের পুরুষতান্ত্রিক অভিলাষ। নারী নারীরূপেই ক্ষমতাবান। প্রাচ্যের খনা বা প্রতীচ্যের জোয়ান অব আর্ক প্রজ্ঞাবান নারী হিসেবেই সংগ্রাম করে প্রাণ দিয়েছেন।

ব্রিটেনের বিজনেস অ্যানালিস্ট অলাদায়ো গ্যাব্রিয়েল এক গবেষণায় বলেছেন, ‘উইমেন আর বেটার এমপ্লয়িজ দ্যান মেন’। নারীর অন্তর্দৃষ্টি ও অন্তর্নিহিত শক্তি পুরুষের পেশিশক্তি অপেক্ষা ক্ষুরধার। কেউ ‘স্যার’ ডাকলেই নারীর নিজেকে পৌরুষদীপ্ত ভেবে গৌরবের কিছু নেই। কোনো সংসারে মা উপার্জনক্ষম ও ক্ষমতায়িত হলে তাকে যেমন ‘বাবা’ ডাকা যায় না, তেমনি ‘স্যার’ সম্বোধনে নারীর ছাতি ১০ হাত প্রসারিত হওয়ারও কোনো কারণ নেই। নারীবাচক কোনো সম্বোধনে নারীর আত্মশ্লাঘা বোধ করা আত্মমর্যাদারই লক্ষণ।

উম্মে মুসলিমা কথাসাহিত্যিক

ই–মেইল: muslima.umme@gmail.com