
যখন ২৭ বছর বয়সী নরেশ রাওয়াল টিকটকের ভিডিওতে নেপালের অভিজাত রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানদের (যাদের ‘নেপোকিডস’ বলা হয়) বিলাসবহুল জীবনযাত্রা দেখছিলেন; তাঁদের দামি গাড়ি, ঘড়ি এবং সানগ্লাস প্রদর্শনের ভিডিও দেখছিলেন, তখন নিজের মধ্যে হতাশা দেখতে পেয়েছিলেন তিনি।
রাওয়াল নেপালের পশ্চিমাঞ্চলের একজন ছাত্র। কাঠমান্ডুতে ছোটখাটো কাজ করে কোনোমতে জীবন চালান তিনি। হাজার হাজার তরুণ বিক্ষোভকারীর সঙ্গে পার্লামেন্টের বাইরে জড়ো হন তিনি। জনগণের প্রতি বৈষম্যের কারণে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্ষোভে প্রকাশ করতে তাঁরা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন।
এক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ ১৯ জন বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে। হাসপাতালে পর্যন্ত কাঁদানে গ্যাসেন শেল নিক্ষেপ করা হয়। রাওয়াল সেখানে বেঁচে যান। কিন্তু বাড়িতে ফিরে তিনি সংবাদ চ্যানেলগুলো দেখে হতাশ হয়ে পড়েন। বিশেষ করে ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রচার করছিল, তিনি যে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন, সেটি বৈষম্যের বিরুদ্ধে নয়, বরং নেপালে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য।
রাওয়াল বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানেরা কোনো দৃশ্যমান আয় ছাড়াই বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে। এটা দেখে আমি আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া এটিকে মূল কারণ হিসেবে দেখায়নি। এটা আমাকে অবাক করে দিয়েছে।’
এ বিক্ষোভ ছিল শূন্যের দশকের মাঝামাঝি থেকে তরুণদের আন্দোলনগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ বিক্ষোভের ফলে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক মানুষ মারা গেছেন। ২০০৬ সালে রাজনৈতিক দল ও মাওবাদীদের নেতৃত্বে অনুরূপ একটি বিক্ষোভে ২৪০ বছর ধরে দেশটি শাসন করা শাহ রাজতন্ত্রের পতন ঘটেছিল।
এই জি-জেন আন্দোলন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলিকে পদত্যাগে বাধ্য করে। ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়।
তবু সীমান্তের ওপারে ভারতে যারা এই ঘটনা দেখছিল, তাদের কাছে দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো নেপালের পরিস্থিতি নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন গল্প হাজির করে। ভারতের প্রধান সংবাদ চ্যানেলগুলোতে বিক্ষুব্ধ নেপালি তরুণদের বিক্ষোভকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে নয়, বরং ২০০৮ সালে বিলুপ্ত হওয়া নেপালের হিন্দু রাজতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের আন্দোলন হিসেবে দেখানো হয়েছে।
নেপালের আন্দোলন নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ উপস্থাপন ক্ষোভ ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, যেখানে নেপালের অ্যাকটিভিস্ট ও মিডিয়া জোর দিয়ে বলছে যে, এই বিক্ষোভের সঙ্গে প্রাক্তন রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কোনো সম্পর্ক নেই।
ভারতের ডানপন্থী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এ ধরনের প্রচারণার নেতৃত্ব দিলেও সংবাদপত্র ও ডিজিটাল মাধ্যমগুলোও এই বয়ানকে জোরালো করেছে। এর মাধ্যমে বিক্ষোভকারীদের প্রকৃত ক্ষোভের কারণগুলোকে (দুর্নীতি, বৈষম্য ও অর্থনৈতিক দুর্দশা) অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। শুধু তা–ই নয়, তারা এমন একটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে, যা বিক্ষোভের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল না।
ফলে বয়ান নিয়ে একটি যুদ্ধের ইঙ্গিত পাওয়া যায় এখানে। নেপালি তরুণেরা রাজনৈতিক নেতাদের জবাবদিহির দাবি তুলেছেন, কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া, বিশেষত যারা ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ঘনিষ্ঠ, তারা নেপালের এ বিক্ষোভকে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক বয়ানের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে আগ্রহী।
জেন-জি নেতা ইয়ুবান রাজভান্ডারি এ ধরনের প্রতিবেদনকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে অভিহিত করেন। তিনি টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, ‘ভারতীয় মিডিয়া রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বিষয়ে একটি মিথ্যা বয়ান প্রচার করছে। এটি তাদের নিজস্ব স্বার্থ প্রতিফলিত করে, আমাদের নয়। আমরা এমন একটি পশ্চাৎপদ ব্যবস্থায় ফিরে যেতে পারি না। আমাদের বিক্ষোভে একবারও রাজতন্ত্রের পক্ষে স্লোগান তোলা হয়নি।’
রাজভান্ডারি আরও বলেন, ‘আমরা হয়তো তরুণ, কিন্তু আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা সচেতন। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরোধী নই আমরা।’
বিক্ষোভকারীরা ছিল মূলত তরুণ-কলেজছাত্র, সদ্য স্নাতক এবং পেশাজীবী; যাঁরা মূলত সরকার ও রাজনৈতিক নেতাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এবং কর্মসংস্থানের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন।
ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক দীপেশ ঘিমিরে বলেন, বিমূর্ত কোনো কারণে এ বিক্ষোভের সূচনা ঘটেনি, বরং এর সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সংগ্রামের বিষয়টি যুক্ত ছিল। বেকারত্ব ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে এসব মানুষের জীবন একটি চক্রে আটকে গিয়েছিল।
বিশ্বব্যাংকের মতে, নেপাল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দরিদ্র রাষ্ট্র। ২০২৪ সালে দেশটির ১৪ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ২১ শতাংশ ছিল। শুধু ২০২৪-২৫ অর্থবছরেই ৮ লাখ ৩৯ হাজারের বেশি নেপালি চাকরি খুঁজতে উপসাগরীয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন। তাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্সই দেশটির অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। সেই রেমিট্যান্স নেপালের জিডিপির প্রায় এক-চতুর্থাংশ।
নেপাল ও ভারতের মধ্যে ১,৭৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ উন্মুক্ত সীমান্ত রয়েছে। এ সীমান্ত এলাকা দিয়ে নেপাল খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধসহ গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানি করে। একটি স্থলবেষ্টিত দেশ হওয়ায় নেপাল তার প্রতিবেশী দেশ ভারতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। দেশ দুটি সাংস্কৃতিকভাবেও কাছাকাছি এবং উভয়ই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র।
এই নৈকট্য থাকা সত্ত্বেও কাঠমান্ডুতে জেন-জি বিক্ষোভের খবর সংগ্রহ করতে আসা ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে। এক্সে (টুইটার) একটি ভিডিওতে এনডিটিভির প্রতিবেদক আদিত্য রাজ কাউলের সরাসরি সম্প্রচারে বাধাগ্রস্ত করতে দেখা গেছে বিক্ষোভকারীদের। আরেকটি ভিডিওতে একজন টিভি নাইনের রিপোর্টারকে সরাসরি সম্প্রচারের মাঝখানে ধাওয়া দেওয়া হয়েছে।
পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এ ধরনের প্রতিবেদন বিজেপির আঞ্চলিক রাজনৈতিক বয়ানের সঙ্গেই মেলে। ভারতের ক্ষমতাসীন দলের কাছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই এর প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। নেপালি জেন-জি আন্দোলনকে রাজতন্ত্র ও হিন্দু পরিচয় প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা হিসেবে উপস্থাপন করে, ভারতীয় মিডিয়া এই ঘটনাকে বিজেপির আদর্শিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্ত করেছে।
দ্য কাঠমান্ডু পোস্টের মতামত বিভাগের সাবেক সম্পাদক দীনেশ কাফলে বলেন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতীয় মিডিয়া প্রতিবেশী দেশগুলোকে মূলত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে।
দীনেশ কাফলে টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, ‘ভারতীয় মিডিয়া নব্বইয়ের দশক থেকে মন্ত্রণালয়ের একটি সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে কাজ করেছে, কিন্তু ক্ষমতাসীন বিজেপির উত্থানের পর গত দশকে এটি আরও তীব্র হয়েছে।’
দীনেশ কাফলে আরও বলেন, ‘ভারতীয় মিডিয়া এখন কেবল সরকারি ভাষ্যই প্রচার করে না, বরং প্রায়ই সরকারকে খুশি করার জন্য গল্প বানায়।’
নেপালের আন্দোলন নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার এ ধরনের সংবাদ উপস্থাপন ক্ষোভ ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, যেখানে নেপালের অ্যাকটিভিস্ট ও মিডিয়া জোর দিয়ে বলছে যে এই বিক্ষোভের সঙ্গে সাবেক রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কোনো সম্পর্ক নেই।
১১ সেপ্টেম্বর দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা কান্তিপুর রিপোর্ট করে, পশ্চিমা মিডিয়া যেখানে দুর্নীতি, বেকারত্ব এবং সামাজিক মিডিয়া নিষেধাজ্ঞাকে আন্দোলনের কারণ হিসেবে অনুসন্ধান করেছে, সেখানে বেশির ভাগ ভারতীয় মিডিয়া ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করেছে। ভারতীয় মিডিয়া দাবি করেছে যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিদেশি শক্তি বা নেপালের ‘ডিপ স্টেট’ এই বিক্ষোভের পেছনে রয়েছে।
কাফলে বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে ভারতীয় মিডিয়ার বার্তাকক্ষগুলোতে দারুণ দারুণ সব সাংবাদিক কাজ করেন। তাঁরা সাংবাদিকতার সব মূলনীতি জানেন। কিন্তু কেন তাঁরা সেগুলো অনুসরণ করেন না? কারণ, সাধারণ মানুষও চায় খবরের নাটকীয় উপস্থাপন। তাই মিডিয়াও দর্শকদের খুশি করতে কোনো ঘটনাকে এমন হালকা উপস্থাপন করে, যেখানে খবরের কোনো গভীরতা থাকে না।’
ভারতীয় মিডিয়ার কাছে রাজতন্ত্রপন্থী কণ্ঠস্বরগুলো নিজের সুবিধামতো বক্তব্য দিচ্ছে। কাফলে বলেন, ‘দুর্নীতি, বেকারত্ব এবং গণতান্ত্রিক ব্যর্থতার জটিলতাগুলো নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করার চেয়ে নেপালের অস্থিরতাকে একটি ধর্মীয় উত্থান হিসেবে ব্যাখ্যা করা সহজ।’
নেপালে যেসব ভারতীয় চ্যানেলের কার্যক্রম আছে, তারা রক্তাক্ত ফুটেজ দিয়ে অস্থিরতার বিষয়টাকে এমন চাঞ্চল্যকরভাবে উপস্থাপন করছে, তাতে মাঠের পরিস্থিতি থেকে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতা হাজির হয়।
বিচার বিভাগ, পার্লামেন্ট ও সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি আগুনে পুড়ে যাওয়ার দুই দিন পর রাজধানী কাঠমান্ডু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করে।
এদিকে নেপালের সেনাবাহিনী কারফিউ শিথিল করেছে। অফিসগুলো খুলে গেছে। কাফলে বলেন, ‘আগুন নিভে গেছে। আমরা একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে প্রবেশ করেছি, যা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী করে। কিন্তু আপনি যদি এখন ভারতীয় সংবাদ চ্যানেলগুলো চালু করেন, তাহলে তার কিছুই দেখতে পাবেন না।’
দীপক অধিকারী কাঠমান্ডুর সাংবাদিক
টিআরটি ওয়ার্ল্ড থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ।