
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে গ্যালাপের এক জরিপে জনমতের বড় পরিবর্তন ধরা পড়েছে। দেখা গেছে, এখন মাত্র ৫৪ শতাংশ মার্কিন পুঁজিবাদকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন, যা এই জরিপ শুরু হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে কম। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মধ্যে সমাজতন্ত্রের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব বেড়েছে।
বামপন্থার উত্থানের প্রতীক হয়ে উঠেছেন নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদে এগিয়ে থাকা প্রার্থী জোহরান মামদানি। নিজেকে তিনি বলছেন ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী’। ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে জয়ী হয়ে মামদানি হয়ে উঠেছেন অভিবাসী সমাজ ও শহরের নিম্নবিত্ত মানুষের কণ্ঠস্বর।
বিভাজনটা স্পষ্ট; রিপাবলিকানরা যেখানে পুঁজিবাদের পক্ষপাতী, ডেমোক্র্যাটরা তুলনামূলকভাবে সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকছেন। তবে গভীরে আছে প্রজন্মভিত্তিক ক্ষোভ। তরুণ মার্কিনদের অনেকের কাছে পুঁজিবাদ মানে এক বিশেষ সুবিধাভোগী ব্যবস্থা। তাঁরা মনে করেন, পুঁজিবাদ কেবল ধনীদের জন্য, সাধারণ মানুষের জন্য নয়।
এ বিতর্ক শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু তার প্রতিধ্বনি এখন ভারতসহ সারা বিশ্বে শোনা যাচ্ছে। ভারতের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জটিল। কারণ, এখানে ‘পুঁজিবাদ’ আর ‘সমাজতন্ত্র’ কেবল আদর্শ বা ধারণা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। স্বাধীনতার পর ভারতের অর্থনীতি গড়ে ওঠে নেহরুবাদী সমাজতন্ত্রের ছাঁচে।
এই মডেলে গণতন্ত্র বজায় থাকলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল প্রধান। এই মডেলে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত হয়, উন্নয়ন এগোয় পরিকল্পিত অর্থনীতির মাধ্যমে, আর বিদেশি বিনিয়োগে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল দেশকে আত্মনির্ভর করা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা; অর্থাৎ ভারতের সমাজতন্ত্র ছিল বাস্তববাদী। এটি খাঁটি মতবাদ নয়; বরং জাতীয় স্বার্থ আর সমতার প্রয়োজনে গড়া।
কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সেই কাঠামোয় ফাটল ধরা স্পষ্ট হয়। অতিরিক্ত আমলাতন্ত্র, রাজস্বঘাটতি আর বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে দেশ ‘লাইসেন্স-পারমিট-কোটা রাজ’ ভাঙতে বাধ্য হয়। ১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক সংস্কার ভারতকে নিয়ে যায় নতুন যুগে। বাজারনির্ভর প্রবৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগ আর বেসরকারি উদ্যোগের যুগে। সন্দেহের চোখে দেখা পুঁজিবাদই হয়ে ওঠে অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের চালিকা শক্তি। মধ্যবিত্ত প্রসারিত হয়। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিপুল অগ্রগতি ঘটে। আর ভারত বৈশ্বিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে।
ভারতের বাস্তবতা শুধু পুঁজিবাদ-সমাজতন্ত্র দ্বন্দ্বে সীমাবদ্ধ নয়। দেশ আজ পুরোপুরি পুঁজিবাদীও নয়, আবার সমাজতান্ত্রিকও নয়; বরং এক জটিল মিশ্রণ। এখানে যেমন বেসরকারি হাসপাতাল আছে, তেমনি সরকারি স্বাস্থ্যসেবাও আছে। বহুজাতিক করপোরেশন আছে, আবার ভর্তুকি দেওয়া খাদ্যশস্যও আছে। বিলিয়নিয়ার আছে, আবার সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচিও আছে।
তবু যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতেও এখন অনেকে পুঁজিবাদের উজ্জ্বল রূপটিকে প্রশ্ন করছেন। বৈষম্য বেড়েছে। কর্মসংস্থান ছাড়াই প্রবৃদ্ধি ঘটছে। আর অল্প কিছু করপোরেট গোষ্ঠীর হাতে বিপুল সম্পদ জমা হচ্ছে। উদারনীতির প্রতিশ্রুতি ছিল সবার সমৃদ্ধি, কিন্তু বাস্তবে এসেছে অনিশ্চয়তা। কৃষকেরা করপোরেট প্রভাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। গিগ কর্মীরা মৌলিক সুরক্ষা চাইছেন। তরুণেরা ডিগ্রি নিয়েও চাকরি পাচ্ছেন না। তাঁদের মনে হচ্ছে, এ ব্যবস্থা ধনীদের জন্য বানানো।
তবে ভারতের বাস্তবতা শুধু পুঁজিবাদ-সমাজতন্ত্র দ্বন্দ্বে সীমাবদ্ধ নয়। দেশ আজ পুরোপুরি পুঁজিবাদীও নয়, আবার সমাজতান্ত্রিকও নয়; বরং এক জটিল মিশ্রণ। এখানে যেমন বেসরকারি হাসপাতাল আছে, তেমনি সরকারি স্বাস্থ্যসেবাও আছে। বহুজাতিক করপোরেশন আছে, আবার ভর্তুকি দেওয়া খাদ্যশস্যও আছে। বিলিয়নিয়ার আছে, আবার সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচিও আছে।
এই মিশ্রণ আসলে কাকতালীয় নয়; বরং এটি এক বাস্তব স্বীকারোক্তি। অসীম স্বাধীন পুঁজিবাদ কিংবা কঠোর মতবাদী সমাজতন্ত্র—কোনোটাই ভারতের বহুমাত্রিক সমাজের চাহিদা মেটাতে পারে না। বাস্তবের তাগিদেই ভারত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্যনিরাপত্তার মতো খাতে অনেক আগেই সামাজিকীকরণের পথ নিয়েছে। লক্ষ্য বাজারকে ধ্বংস করা নয়; বরং মানবিকতার ছোঁয়ায় তাকে নরম করা।
তবু অসন্তোষ থেকে যাচ্ছে। নয়ডা হোক বা নিউইয়র্ক—তরুণেরা যখন প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা পাঁচ বছরের পরিকল্পনা ফেরত আনার কথা বলছেন না। তাঁরা চাইছেন ন্যায়বিচার, মর্যাদা আর এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে কেউ পিছিয়ে থাকবে না। তাঁদের কাছে সমাজতন্ত্র মানে মৌলিক চাহিদা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকবে না, সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে, আর মুনাফা মানুষের ওপরে প্রাধান্য পাবে না।
এ আকাঙ্ক্ষা নতুন কিছু নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে ওঠে শুধু অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য নয়, আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্যও। ব্রিটেনে ‘স্বাস্থ্যসেবা কোনো পণ্য নয়’—এই বিশ্বাসে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস চালু হয়। এর স্থপতি এনুরিন বেভান বলেছিলেন, পুঁজিবাদী সমাজ নৈতিক থাকতে চাইলে কিছু পরিষেবা অবশ্যই সামাজিকীকরণ করতে হবে।
ভারতে একই প্রেরণাই প্রতিফলিত হয়েছে সরকারি শিক্ষা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিষ্ঠানের প্রতিশ্রুতিতে।
আজ বিতর্কের ভাষা বদলেছে। আর প্রশ্ন হচ্ছে—ব্যবস্থা কি সঠিকভাবে কাজ করছে? দুর্বলদের কি রক্ষা করছে? পরিশ্রমকে কি পুরস্কৃত করছে, আর দুর্ভাগাকে শাস্তি দিচ্ছে না? এগুলো কোনো মতাদর্শগত প্রশ্ন নয়—এগুলো বাস্তব প্রশ্ন। ভারত যখন ভবিষ্যতের পথ ঠিক করবে, তখন এ প্রশ্নগুলোই মুখ্য হবে।
কিন্তু এখনকার বিতর্ককে অনেক সময় একপেশেভাবে দেখা হয়। ডানপন্থীরা ভেনেজুয়েলা বা স্তালিন আমলের রাশিয়ার উদাহরণ টেনে সমাজতন্ত্রকে একনায়কতন্ত্র হিসেবে চিত্রিত করেন। তাঁরা ভুলে যান, সমাজতন্ত্র আসলে এক বিস্তৃত ধারাবাহিকতা। আবার বামপন্থীরা যখন পুঁজিবাদকে প্রকৃতিগতভাবে শোষণমূলক বলে নিন্দা করেন, তখন তাঁরাও উপেক্ষা করেন যে আধুনিক অর্থনীতিগুলো ইতিমধ্যেই নিরাপত্তা জাল, নিয়মকানুন আর সম্পদ পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক অনেক নীতি গ্রহণ করেছে।
ভারতে বিতর্কটা আরও জটিল। কারণ, এখানে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উপাদান জড়িয়ে আছে। অর্থনৈতিক আলোচনায় প্রায়ই পরিচয় রাজনীতি, আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষা আর ঐতিহাসিক ক্ষোভ মিশে যায়। ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ কথাটার অর্থ রাজ্যভেদে ভিন্ন। জাত, ধর্ম, সম্প্রদায় অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখে। আবার ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকারও আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোয় গভীর ক্ষত তৈরি করেছে।
তবু এ বিতর্ক আশাবাদ জাগায়। এটি প্রমাণ করে মানুষ বর্তমান অবস্থা মেনে নিতে রাজি নয়। তারা বিশ্বাস করে সমাজ আরও ভালো হতে পারে, অর্থনীতি সবার জন্য কাজ করতে পারে, পরিবর্তন সম্ভব। যাদের বাজারে প্রবেশাধিকার নেই, তাদের কাছে বাজারের জাদু অর্থহীন। তারা বঞ্চনার অভিজ্ঞতা জানে। তারা জানে, স্বপ্ন দেখার মানে কী।
শেষ পর্যন্ত আসল বিষয় হলো অভিজ্ঞতা, কোনো ট্যাগ নয়। আজকের সমাজ মূলত মিশ্র—গঠনে পুঁজিবাদী, চেতনায় সমাজতান্ত্রিক। চ্যালেঞ্জ হলো একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে বেছে নেওয়া নয়; বরং এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করা, যেখানে দক্ষতার সঙ্গে সহমর্মিতা, উদ্ভাবনের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তি থাকবে। বহুত্ববাদ ও বাস্তববাদের কারণে ভারত এ আলোচনায় নেতৃত্ব দেওয়ার বিশেষ অবস্থানে আছে।
আগামী দিনে আমাদের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে নৈতিক জটিলতাকে সামনে রেখে। মতাদর্শের মোহে নয়, ভারসাম্যের দিকে হাঁটতে হবে। অসন্তোষকে ভয় না পেয়ে; বরং অংশগ্রহণের নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এটি স্পষ্ট—পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র কোনো দ্বন্দ্ব নয়; বরং একটি ধারাবাহিকতা। আর ভারতকে বাকি বিশ্বের মতোই সেই ধারায় নিজের অবস্থান খুঁজে নিতে হবে।
শশী থারুর ভারতের লোকসভায় কংগ্রেস দলীয় এমপি ও দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ