যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করা কোম্পানিগুলোর ওপর অপ্রত্যক্ষ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার সময়সীমা কমিয়ে আনার পরিকল্পনা যখন ঘোষণা করলেন, ক্রেমলিন সেটি অবজ্ঞাভরে উপেক্ষা করল।
মস্কোর কর্মকর্তারা কিছুই হয়নি, এমন ভঙ্গিতে বিবৃতি দিয়েছেন। এটাকে তাঁরা আরেকটি পশ্চিমা ধাপ্পাবাজি বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। ৮ আগস্ট সময়সীমা আসন্ন হলেও ক্রেমলিনের কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলছেন যে তাঁরা পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত।
কিন্তু বাজার এত বোকা তো নয়। গত কয়েক দিনে ডলারের বিপরীতে রুশ রুবলের মান প্রায় ৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। রাশিয়ার প্রধান পুঁজিবাজারের সূচক ১ দশমিক ৫ শতাংশ পড়ে যায়। জ্বালানি খাতের বড় কোম্পানি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর শেয়ারদর সবচেয়ে বেশি কমেছে। এর কারণ হলো ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক ঝুঁকির কথা বিবেচনা করছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩১ জুলাই আবারও কঠোর অবস্থান নিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। ইউক্রেনে রাশিয়ার বোমাবর্ষণের প্রসঙ্গ তুলে ট্রাম্প বললেন, ‘আমি মনে করি, তারা যেটা করছে, সেটা জঘন্য।’
অপ্রত্যক্ষ নিষেধাজ্ঞা শুধু রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যের পথ বন্ধ করবে না। এই নিষেধাজ্ঞা বিদেশি কোম্পানিগুলোকেও (যদি তারা নিষেধাজ্ঞা মানতে ব্যর্থ হয়) মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থার বাইরে ছুড়ে ফেলতে পারে। ফলে প্রকৃত চাপ তৈরি হবে চীন, ভারত ও তুরস্কের মতো দেশগুলোর ওপর। এই তিনটি দেশই রাশিয়ার জ্বালানির প্রধান ক্রেতা। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধযন্ত্রকে অর্থ জোগায়।
চীন ও তুরস্ক এই ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের চাপে (অন্তত প্রকাশ্যে) মাথা নত করবে না। চীন এখনো রাশিয়ার কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের তেল কিনছে, আর তুরস্ক মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
যাহোক, ভারত তার অবস্থান পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহে ভারতের বেশ কয়েকটি তেল পরিশোধনাগার রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে অপ্রত্যক্ষ নিষেধাজ্ঞার হুমকি পর্দার আড়ালে ইতিমধ্যেই কাজ করতে শুরু করেছে। ব্লুমবার্গ-এর খবর জানাচ্ছে, ভারত সরকার পরিশোধনাগারগুলোকে, রাশিয়া বাদে অন্যান্য উৎস থেকে তেল আমদানির পরিকল্পনা তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছে।
পুতিন ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে বিবেচনায় আনবেন না, যতক্ষণ না তিনি ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল (দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন) পুরোপুরিভাবে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে নিতে না পারেন। এখন যুদ্ধের গতি তার পক্ষে, তাই এটা ভাবার বিশেষ কারণ নেই যে তিনি এখানেই থেমে যাবেন।
তবে ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন যে ভারত রাশিয়া থেকে সস্তা দামে জ্বালানি তেল সংগ্রহ চালিয়ে যাবে। ভারতের অর্থনৈতিক নীতিকে অন্য কোনো দেশের হাতে সঁপে দেবে না তারা।
বাইরে বাইরে প্রতিবাদী অবস্থান দেখালেও ভারত ও অন্যান্য দেশে যে উদ্বেগ বাড়ছে সেই লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। ট্রাম্প যদি সত্যিই তার হুমকি কার্যকর করেন, তবে পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। রাশিয়ার বাণিজ্যকে যারা টিকিয়ে রেখেছে তাদের জন্য মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার সীমিত হওয়া, উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ এবং ব্যাংক, বিমা কোম্পানি ও জাহাজ পরিবহনকারী সংস্থাগুলোর ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়বে।
শুধু রাশিয়ার তেল বিক্রিতে নয়, বরং মস্কোর সঙ্গে অন্যান্য বাণিজ্য করছে, এমন দেশগুলোর বিস্তৃত নেটওয়ার্ককেও বড় ধরনের ধাক্কা দেবে এই অপ্রত্যক্ষ নিষেধাজ্ঞা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় জার্মানি ও ইতালির যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রনিকস পণ্য এবং ব্রাজিল ও উজবেকিস্তানের খাদ্য ও তৈরি পণ্যের ওপর নির্ভর করেই রাশিয়ার যুদ্ধকালীন অর্থনীতি টিকে আছে।
মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার বন্ধ হয়ে গেলে, যেসব কোম্পানি ও ব্যাংক রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। এমনকি বড় অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য এই পরিণতি এড়ানো কঠিন হবে।
কিন্তু অপ্রত্যক্ষ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারে ট্রাম্প সত্যিই কত দূর পর্যন্ত যাবেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর কৌশলগত স্বার্থের কেন্দ্রে রয়েছে। রাশিয়াকে শাস্তি দিতে গিয়ে ট্রাম্প ভারত ও চীনের সঙ্গে বৃহত্তর সহযোগিতা ঝুঁকিতে ফেলবেন কি না, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়।
ওয়াশিংটন এটাও জানে যে ক্রেমলিনের বাণিজ্যিক অংশীদারদের ওপর অপ্রত্যক্ষ নিষেধাজ্ঞা দিলে তা উল্টো প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের খরচ বেড়ে যাবে।
ট্রাম্প–ঘোষিত সময়সীমা আসার আগেই রাশিয়ার জ্বালানি খাতের ওপর চাপ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এই খাত থেকেই রাশিয়ার কেন্দ্রীয় বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশ আসে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজে রাশিয়ান অপরিশোধিত তেলের দামসীমা কমিয়ে ৪৭ দশমিক ৬০ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। ১০০-এর বেশি ছদ্মবেশী ট্যাংকারকে (গোপনে রাশিয়ার তেল পরিবহনকারী জাহাজ) নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাশিয়ার তেলের সঙ্গে সম্পৃক্ত পরিশোধিত জ্বালানি আমদানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের লক্ষ্য হচ্ছে পুতিনের যুদ্ধকালীন রাজস্বের প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া।
দ্রুত নিম্নমুখী হতে থাকা অর্থনীতি ও ট্রাম্পের আসন্ন অপ্রত্যক্ষ নিষেধাজ্ঞার হুমকি—সব মিলিয়ে এখন নিখুঁত একটি ঝড়ের মুখোমুখি। দুই দিক থেকেই চাপ আসছে। যুদ্ধে ক্লান্ত রাশিয়ার অর্থনীতি হয়তো এই চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে পারে।
যাহোক, ট্রাম্পের আলটিমেটামের জবাবে ক্রেমলিন যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, সেটা বিভ্রান্তি ও দম্ভের মিশেল।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ট্রাম্পের সময়সীমা ঘন ঘন বদলানোর (প্রথমে ২৪ ঘণ্টা, পরে ১০০ দিন) পেছনে কী যুক্তি আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, মস্কো কেবল ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কী ভাবছেন, তা বোঝার চেষ্টা করছে। তবে তাঁর কণ্ঠে ছিল স্পষ্ট অবজ্ঞা। লাভরভ জোর দিয়ে বলেন, রাশিয়া আগেও নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা সামলেছে এবং ‘এই নতুন পদক্ষেপও মোকাবিলা করতে পারবে’।
প্রকৃতপক্ষে রাশিয়া এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৭ দফা নিষেধাজ্ঞা (জ্বালানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, প্রতিরক্ষা ও হাইব্রিড সক্ষমতার ওপর) মোকাবিলা করেছে। বিশ্বজুড়ে রাশিয়ার কোম্পানি ও ব্যক্তিদের ওপর প্রায় ২০ হাজার বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
রাশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভের প্রতিক্রিয়া ছিল আরও আক্রমণাত্মক। তিনি ট্রাম্পের সতর্কতাকে তাচ্ছিল্য করে ‘আলটিমেটাম নাটক’ বলে অভিহিত করেন। পাল্টা সতর্ক করে বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে আলটিমেটাম খেলা খেলতে এসো না।’
কিন্তু সবচেয়ে পরিষ্কার প্রতিক্রিয়াটা কথায় আসেনি, এসেছে রক্তস্নানে। ট্রাম্পের সর্বশেষ যুদ্ধবিরতির আহ্বানের মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মস্কো ইউক্রেনজুড়ে নতুন করে বিমান হামলা চালায়। হাসপাতাল ও কারাগারও ছিল লক্ষ্যবস্তু। এতে কমপক্ষে ১৭ জন নিহত হন।
ক্রেমলিনের দিক থেকে বার্তাটি নির্মম ও সরাসরি। রাশিয়ার যুদ্ধ লক্ষ্য এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। ইউক্রেনের মনোবল ভেঙে দেওয়া, দেশটির অবকাঠামো ধ্বংস করা এবং দেশটির সার্বভৌমত্ব মুছে ফেলা।
পুতিন ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে বিবেচনায় আনবেন না, যতক্ষণ না তিনি ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল (দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন) পুরোপুরিভাবে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে নিতে না পারেন। এখন যুদ্ধের গতি তার পক্ষে, তাই এটা ভাবার বিশেষ কারণ নেই যে তিনি এখানেই থেমে যাবেন।
জেসন করকোরান রাশিয়ার অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে অভিজ্ঞ সাংবাদিক
দ্য মস্কো টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত