অভিমত

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রভাব ও যানজট

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

অনেক প্রত্যাশার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠলে মনে হয় না যে দেশে আছি বা ঢাকায় আছি, মনে হয় অন্য কোনো স্বপ্নের দেশে চলে গেছি। এত ভালো লাগে, পুরো রাস্তায় কোনো যানজট নেই। চারপাশের সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে পার হওয়া। আর রাতের বেলা তো আরও অসাধারণ লাগে যখন স্ট্রিটলাইটগুলো জ্বলজ্বল করে আলোকিত হতে থাকে।

২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ প্রধানমন্ত্রী এটি কাওলার থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত চলাচলের জন্য উদ্বোধন করেন। সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগের (পিপিপি) ভিত্তিতে ঢাকার হাইস্পিড ফ্লাইওভারের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ।

পরদিন, অর্থাৎ ৩ সেপ্টেম্বর ভোর ৬টা থেকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রান্ত থেকে ফার্মগেট প্রান্ত পর্যন্ত অংশের উভয় দিকে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ২ অথবা ৩ চাকার যানবাহন, যেমন মোটরসাইকেল বা অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ এবং পথচারী চলাচল সম্পূর্ণ নিষেধ। সেতু বিভাগ এক গণবিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এক্সপ্রেসওয়ের মূল সড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৬০ কিমি/ ঘণ্টা এবং উঠানামার র‍্যাম্পের জন্য সর্বোচ্চ গতিসীমা ৪০ কিমি/ঘণ্টা।

এয়ারপোর্ট রোডের পদচারী-সেতুগুলো তুলে দেওয়ায় পথচারীরা পদচারী-সেতুতে উঠতে পারছেন না। এতে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা পারাপারে ভীষণ অসুবিধায় পড়েছেন সাধারণ পথচারীরা। কাওলা-আশকোনা-এয়ারপোর্টের এলাকাবাসী ও পথচারীদের জন্য সাধারণ যানবাহন বা বাস স্টপেজে দাঁড়ানো ও উঠানামা খুব ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

স্টপেজে বাস থামছে, কিন্তু যাত্রী নামতে পারছেন না, রয়েছে দুর্ঘটনার প্রবল ঝুঁকি। এদিকে যেখানে বাস থামছে, সেখান থেকেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শুরু। এ জন্য বেশ কিছু ট্রাফিক পুলিশ কাজ করে যাচ্ছেন অবিরত। উত্তরা থেকে চারটি পদচারী-সেতু সাময়িকভাবে অপসারণ হয়েছে, ভবিষ্যতে কী হবে, সাধারণ জনগণ জানেন না।

বিকল্প ব্যবস্থা না করে হঠাৎ করে পদচারী-সেতুগুলো উঠিয়ে দেওয়ায় রাস্তা পারাপারে জনজীবন-মনে দুঃসহ কষ্টের সঞ্চার হয়েছে, যা অবর্ণনীয়। এর মধ্যে প্রতিনিয়ত কর্মজীবী, পোশাককর্মী, পথচারী, শিক্ষার্থী—যাঁরা উত্তরা বা দক্ষিণ ঢাকায় স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন কিংবা অফিসে যাচ্ছেন এবং পাবলিক বাসের নিয়মিত যাত্রী ছিলেন, তাঁদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। উবারগুলোও সুবিধাজনক স্থানে না থাকায় আগের চেয়ে অনেক বেশি ওয়েটিং টাইম লাগছে।

ব্যবহারকারী যখন আমি

কয়েক দিন আগের কথা। অফিস যাওয়ার উদ্দেশে বেরিয়ে নামলাম মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনের এক্সিট দিয়ে। ইউটার্ন করে মহাখালী বাস স্টপেজ আসতে ৩০ মিনিট তো লেগেছেই, এরপরও অনেকক্ষণ বসে থাকতে হলো। আমি কোনোভাবেই অফিস যাওয়ার পথে এটি ব্যবহার করে সুবিধা পাচ্ছি না। না আগে যাই, না সময় বাঁচে। শুরুতে আমার মনে হয়েছিল, সম্ভাব্যতা যাচাই যথাযথ হয়নি এখানে। তবে আমি আশাবাদী, ভবিষ্যতে পুরো প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে আমরা পরিপূর্ণভাবে এটির উপকারভোগী হতে পারব।

আমি প্রতিটি এন্ট্রি দিয়ে গাড়ি নিয়ে প্রতিটি এক্সিট দিয়ে বের হয়েছি। যাওয়া-আসা করে যা সংক্ষেপে বুঝেছি, অফিস যাওয়ার সময় এটি ব্যবহার করে আমার সময় বাঁচবে না বটে, কিন্তু অফিস থেকে উত্তরা বাসা ফেরার সময় অর্ধেকটা সময় বাঁচবে। সেটিই-বা কম কি!

আলোচনায় যাই

এক্সপ্রেসওয়েতে উঠানামার জন্য ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মোট ৩১টি (১৫টি এন্ট্রি এবং ১৬টি এক্সিট) র‍্যাম্প রয়েছে। প্রাথমিকভাবে বর্তমানে ১৩টি র‌্যাম্প কার্যকর করা হয়েছে। এই র‍্যাম্পসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। কাওলার বা এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট দূরত্বে ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার ভ্রমণ মাত্র ১০ মিনিটে।

এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ওঠা ও নামার পথকে বলা হয় র‍্যাম্প। এই র‍্যাম্পগুলো যানজট বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে। এক্সপ্রেসওয়ের যতটুকু উদ্বোধন করা হয়েছে, তা যানজট দূর করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে আরও সময় লাগবে। টার্নিং মোড় ও বাস টার্মিনালের কাছে র‌্যাম্প হওয়ায় যে জায়গাগুলো আগে থেকেই যানজট ছিল, সেই জায়গায় বাড়তি গাড়ির চাপ ট্রাফিক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদকাল ৩০ জুন, ২০২৪।

এক্সপ্রেসওয়েকে ফ্রি ওয়ে বা সুপার হাইওয়ে নামেও ডাকা হয়। সড়কে কোনো মোড় থাকে না, ক্রস মুভমেন্ট, পার্কিং অ্যাকটিভিটি বা পথচারী চলাচল না করার অর্থ হচ্ছে ভালো মানের রাস্তা।

প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এই এক্সপ্রেসওয়ের প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে খরচ হয়েছে ১৯১ কোটি টাকার বেশি।

বিজয় সরণি হয়ে র‌্যাংগস বিল্ডিং ভেঙে যে ওভারপাসটি তৈরি করা হয়েছে, তার সঙ্গে তেজগাঁও পর্যন্ত যাওয়ার আগে ফ্লাইওভারের সংযোগ রয়েছে। তেজগাঁও থেকে বিজয় সরণির দিকে ওভারপাসের ওপরে ওঠার আরেকটি যোগসূত্র রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এটা কোনোভাবেই খুব কাজের হলো না, যানজট থেকেই যাচ্ছে। তবে রাজধানীর দক্ষিণ, পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষের জন্য পথটি সহজ হয়েছে। যাঁরা বনানী যেতে চান, তাঁরা বনানী রেলস্টেশনের সামনের ফ্লাইওভারে উঠতে বা নামতে পারবেন এবং এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসতে পারবেন।

অথচ উত্তরা থেকে এয়ারপোর্ট যেতে গেলে কাওলা পার হয়ে বেশ কিছুটা গিয়ে ইউটার্ন করে আসতে হয়। এতে ভ্রমণের সময় আগের চেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে।

উত্তর দিক থেকে যাত্রা করে নামার সহজ উপায় ফার্মগেটের ইন্দিরা রোড। এতে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, নিউমার্কেটগামী যানবাহনগুলো সুবিধামতো ইন্দিরা রোডে নামানো হয় এবং এ পথে যদি শাহবাগ, মতিঝিল কেউ যেতে চান, তাহলে তাঁকে আরও একবার প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যামের সম্মুখীন হতে হয় অফিস আওয়ারে, যা আগেও ছিল।

ফার্মগেট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড বা শাহবাগ, সেগুনবাগিচা, পুরান ঢাকা থেকে যাঁরা ফ্লাইওভারে উঠে এয়ারপোর্ট বা উত্তরা এলাকায় যেতে চান, তাঁদের বিজয় সরণি ওভারপাস, অর্থাৎ তেজগাঁও ফ্লাইওভারের মাঝের এলাকায় যেতে হবে।

সড়ক পরিবহনে ভোগান্তি কমাতে দীর্ঘমেয়াদি যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে প্রথম থেকেই আলোচনায় আছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। প্রকল্প হাতে নেওয়ার এক যুগের বেশি সময় পর গত ২ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন হয়েছে এক্সপ্রেসওয়েটি।

প্রকল্পের শুরু থেকেই বলা হয়েছিল, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ঢাকা ইপিজেড ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের যোগাযোগ সহজ হওয়ার পাশাপাশি ঢাকার যানজট নিরসনে এক্সপ্রেসওয়েটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে বিকল্প সড়ক হিসেবে কাজ করবে। এটি হেমায়েতপুর-কদমতলী-নিমতলী-সিরাজদিখান-মদনগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক-মদনপুরে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল ও পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ না করে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবেশ করবে। আবার উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলোও ঢাকাকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি যাতায়াত করতে পারবে। ফলে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট কমবে।

বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মিত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিষয়ে সেতু কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা শহরের যানজট অনেকাংশে কমে যাবে এবং ভ্রমণের সময় ও খরচ হ্রাস পাবে।

সার্বিকভাবে যোগাযোগব্যবস্থার সহজীকরণ, আধুনিকায়ন হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জিডিপিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৪ সালে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে ঢাকার যানজট নিরসনের পাশাপাশি উত্তর ও দক্ষিণের রুটের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টিও উঠে আসে; অর্থাৎ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট বাহনগুলো শহরে ঢুকতে যাতে কোনো ধরনের বাধার মুখে না পড়ে, সরাসরি বাইপাস করে চলে যেতে পারে, সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ শুরু হয়।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে গাজীপুরের দিক থেকে বা উত্তরবঙ্গ থেকে যে গাড়িগুলো অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে আসে, সেগুলো যেন ঢাকাকে বাইপাস করে চট্টগ্রামে চলে যেতে পারে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমানে যেটুকু রাস্তা চালু হবে, তাতে কেবল ঢাকার মধ্যেই যোগাযোগ তৈরি হবে। এ ছাড়া গণপরিবহন ও মোটরসাইকেলের যাত্রীরা এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে পারবেন না। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে অনেক র‍্যাম্প থাকার কারণে বাধাও বেশি পড়বে এবং র‌্যাম্প থেকে বের হওয়ার মুখে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যানজট বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে যানজট নিরসনে খুব বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন নগর-বিশেষজ্ঞরা।

অন্যদিকে শহরের প্রেক্ষাপটে ভোরবেলা ও গভীর রাতে ঢাকার রাস্তাও ফাঁকা থাকে। সে ক্ষেত্রে টোল দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের সংক্ষিপ্ত রাস্তা ব্যবহারের আকর্ষণও কম থাকবে।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে থেকে কাওলার থেকে এই পথ তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে অচিরেই। আশা করছি তখন আমরা আরও কিছুটা সুবিধা পাব।

  • আফরোজা বেগম তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, ঢাকা
    ই–মেইল: engafroza@gmail.com