মতামত

নির্বাচনের আশ্বাসে অস্বস্তি ও শঙ্কার ঘ্রাণ

‘পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই নির্বাচন ঠেকাতে পারে’—৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, সে জন্য যত প্রস্তুতি লাগে, সেগুলো নেওয়া হচ্ছে। প্রেস সচিবের এ মন্তব্যের ভেতর একধরনের অস্বস্তি ও শঙ্কার ঘ্রাণ পাওয়া যায়।

প্রেস সচিব ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ আরেক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে বলেন, নির্বাচন খুবই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে। উনি (প্রধান উপদেষ্টা) বারবার বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ওয়ান অব দ্য বেস্ট ইলেকশন হবে (দেশ রূপান্তর; ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫)। কিন্তু নির্বাচনের পূর্বশর্ত স্থিতি ও শান্তি। সেই স্থিতি ও শান্তির পথে পেরেক ঠোকা হচ্ছে প্রতিদিন। আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নারী, নারীদের ফুটবল খেলা, মাজার, খানকা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ কেউ আক্রমণের বাইরে নয়।

আজ ঘরে-বাইরে চেনা-অচেনা শক্রর অভাব নেই। এত শত্রু, এত সহবাসী শত্রু ভাবা যায় না? রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে বিমানবীকরণ প্রক্রিয়াও তীব্র হচ্ছে। তকমা দেওয়া হচ্ছে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষদের। হেয়, নিগ্রহ, শাস্তি ও হত্যার উপযোগী করে তোলা হচ্ছে।

শেখ হাসিনার পতন-পরবর্তী দুই ধরনের বিচারপ্রক্রিয়া জনগণ প্রত্যক্ষ করছে। এক. ভার্চ্যুয়াল বিচার, যা মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেন্দ্রিক; দুই. বিচারিক আদালত। সামাজিক মাধ্যমের লর্ডরা প্রতিদিন প্রচুর ভার্ডিক বা রায় দিচ্ছেন।

এই লর্ডদের কথা শুনে তাদের অনুগামীরা বিচারের রায় বাস্তবায়নে নেমে পড়ছেন। ভার্চ্যুয়াল সহিংসতা কেবল ভার্চ্যুয়াল জগতে থাকছে না, তা বাস্তবে নেমে পড়ছে। ভার্চ্যুয়াল জাজমেন্ট বা বিচার একপক্ষীয় ও পক্ষপাতদুষ্ট, এর গভীরে রয়েছে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।

এসব ভায়োলেন্স বা সহিংসতার মূল ভিত্তি সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক। অর্থাৎ বাস্তব জগতের ‘ভায়োলেন্স গ্র্যাজুয়েটরা’ ভার্চ্যুয়াল জগতে ঢুকে পড়েছে (অক্সফোর্ডের অধ্যাপক ডেভিড জ্যাকম্যান তাঁর সিন্ডিকেট অ্যান্ড সোসাইটিজ ক্রিমিনাল পলিটিকস ইন ঢাকা গ্রন্থে এ ‘ভায়োলেন্স গ্র্যাজুয়েট’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন)। আর তাদের অনুগামীরা থাকছে মাঠে। ফলে নুরাল পাগলাকে হত্যা করা এবং শরীরী অস্তিত্বকে ভস্মীভূত করতে ভায়োলেন্স গ্র্যাজুয়েটদের খুব বেশি বেগ পেতে হচ্ছে না। এরা সবাই মব সাম্রাজ্যের রাজা-প্রজা। ভায়োলেন্স গ্র্যাজুয়েট।

সরকারের ঘনিষ্ঠজনদের বহুল উচ্চারিত পদবাচ্য হলো নয়া বন্দোবস্ত, অন্তর্ভুক্তি, বৈষম্যহীনতা, দায় ও দরদের সমাজ। এগুলো জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে চিহ্নিত। আকাঙ্ক্ষাগুলোকে কর্পূরের মতো বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। শহীদদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে নেওয়া শপথ প্রাণহীন হয়ে পড়ছে।

কোনো বিশেষ গোষ্ঠী যখন অন্যদের বিচারের ভার নিজেদের হাতে তুলে নেয়, তখন সমাজে অন্ধকার নেমে আসে। আর তা পোক্ত হয় যখন এক নির্লিপ্ত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অসহায়ত্ব নিয়ে কিংবা মৌন সমর্থন দিয়ে। এত সহিংসতা, ক্লেদ এবং ক্ষোভ ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য হয়ে উঠছে। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী রাষ্ট্রের সমান্তরাল হতে চাইছে। রাষ্ট্র ও সরকারকে তারা তুচ্ছজ্ঞান করছে। বন্য মনোভঙ্গির লকলকে জিব বের করছে। সরকার হয়ে উঠেছে এক নিষ্কর্মা সত্তা। বিষাক্ত দাঁতের তীব্র স্বাদ নিয়ে সরকার বলছে এগুলো সহ্য করা হবে না। অথচ বিষদাঁত ফুটানো হয়ে গেছে। সরকারের সহ্যের অপেক্ষায় কে থাকছে? কে সরকারকে গুনছে? এত নখদন্তহীন সরকার কেউ কি কখনো দেখেছে?

সরকারের শাসনের স্বভাব দেখে মনে হয় তারা শাসক হতে চাননি? তা তো আধুনিক মনোভঙ্গি। অত্যন্ত পরিশীলিত বোধ। সেই নীতিনিষ্ঠ ও সর্বজনীন মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিক সমাজ তো বিনির্মাণ করা যায়নি। আমরা জনগণ থাকলাম, নাগরিক হতে পারিনি। কারণ, একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের অনেক ক্রিটিক্যাল জাজমেন্ট দিতে হয়। বাস্তবতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমাদের গড়পড়তা চিত্র।

এটা ভাঙছে, ওঠা ভাঙছে; কবর থেকে লাশ তুলে আগুন দিচ্ছে। মানুষ কি ক্যানাবলিজম বা মানুষ মানুষের মাংস খাওয়ার সংস্কৃতির ভেতর ঢুকে পড়ল? তথাকথিত মতাদর্শের নামে, বিশ্বাসের নামে এই সংস্কৃতির চর্চা শুরু করল! আর এর বিপরীতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নিন্দা, প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে এগুলো সহ্য করা হবে না। চলমান সহিংসতার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ? এটি অদক্ষতা। অথবা সরকারের দক্ষিণপন্থীদের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত। কারণ, বর্তমান সরকার অরাজনৈতিক সরকার নয়। এটি রাজনৈতিক সরকার। শেখ হাসিনার নিপীড়ন ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বৈষম্যহীন বাংলাদেশে গড়ার যে স্বপ্ন, তার হাত ধরে এ সরকারের জন্ম।

সরকারের ঘনিষ্ঠজনদের বহুল উচ্চারিত পদবাচ্য হলো নয়া বন্দোবস্ত, অন্তর্ভুক্তি, বৈষম্যহীনতা, দায় ও দরদের সমাজ। এগুলো জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে চিহ্নিত। আকাঙ্ক্ষাগুলোকে কর্পূরের মতো বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। শহীদদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে নেওয়া শপথ প্রাণহীন হয়ে পড়ছে। আরবি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়—অঙ্গীকার হলো মেঘ, আর বৃষ্টিপাত হলো তার পূর্ণতা। আকাশে অনেক সময় মেঘ জমে কিন্তু বৃষ্টি ঝরে না। বাংলাদেশ আজ হয়ে উঠেছে বৃষ্টিহীন অঙ্গীকারের সমষ্টি। মোদ্দাকথা, সরকারের গাঠনিক স্পিরিটকে ভিন্ন খাতে নেওয়া হচ্ছে।

জনস্বার্থ সুরক্ষায় মহৎ উদ্দেশ্য এবং দক্ষতা লাগে। বর্তমান সরকারের ভেতর ঢাকঢাক গুড়গুড় ব্যাপার লক্ষ করা যাচ্ছে। অসৎ উদ্দেশ্য ও অদক্ষতার সমন্বয়ে যে কর্তৃত্ব গড়ে ওঠে, তার চেয়ে ভয়াবহ কর্তৃত্ব আর হতে পারে না।

অন্যদিকে শেখ হাসিনার নির্বিচার শাসনামলে এক দূষিত জনমানস তৈরি হয়েছে। এ দূষিত মানসের হাতে ফ্যাসিবাদের বাড়বাড়ন্ত। শেখ হাসিনার অপশাসন গেছে বলে যে আর কোনো অপশাসন আসবে না, এমন নয়। দূষিত জনমানস অপশাসন ও ফ্যাসিবাদ ডেকে আনে।

অস্ট্রিয়ান চিকিৎসক ও মনোবিশ্লেষক বিলহেলম রিইচ তাঁর দ্য ম্যাস সাইকোলজি অব ফ্যাসিজম-এ (১৯৩৩) উল্লেখ করেছেন, আজকের দিনে এটা পরিষ্কার যে ফ্যাসিবাদের বিষয়টি কেবল হিটলার বা মুসোলিনির বিষয় নয়; বরং তা গণমানুষের অযৌক্তিক মনোভঙ্গির গভীরে প্রোথিত (টু ডে ইট হ্যাজ বিকাম অ্যাবসিলিউটলি ক্লিয়ার দ্যাট ফ্যাসিজম ইজ নট দ্য ডিড অব হিটলার অর মুসোলিনি, বাট দ্য এক্সপ্রেশন অব দ্য ইর‍েশনাল স্ট্রাকচার অব দ্য মাস ইন্ডিভিজ্যুয়াল)।

একবার ফ্যাসিবাদ চলে গেলেই আর তা আসবে না, এমন নয়। আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডলিন অলব্রাইট তাঁর ফ্যাসিজম: আ ওয়ার্নিং গ্রন্থে ইতালিয়ান রসায়নবিদ প্রিমো লেভিকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, সব শাসনামলে তার মতো করে একধরনের ফ্যাসিবাদ জিইয়ে থাকে (এভরি এইজ হ্যাজ ইটস ঔন ফ্যাসিজম)।

আবার মব ভায়োলেন্সের দিকে ফিরে আসা যাক। মব দৌরাত্ম্য যে কমছে না, তার পেছনে রয়েছে সরকারের শক্ত রাজনৈতিক অবস্থানের অভাব। যারা এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে ভিকটিমদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এতে অপরাধীরা একটা বিশেষ বার্তা পাচ্ছে—তা হলো সমস্যা নেই, এগোনো যাবে! জামিনহীনতা, আদালতে আসামির ওপর আক্রমণ, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, তদন্তে শ্লথগতি ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারকে ঠুনকো জায়গায় নিয়ে এসেছে।

ইংল্যান্ডে বসবাসরত শিক্ষক ও গবেষক লুবনা ফৌরদৌসী সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ধর্মীয় চরমপন্থা আর রাজনৈতিক অপরাধীদের পুনর্বাসনের জন্য যে পথে রাষ্ট্র এগোচ্ছে, সেই পথটাকে আইনের চোখে স্বাভাবিক হিসেবে দেখানোর উদ্যোগ আছে। উল্লেখ্য, সরকার ইতিমধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ১৬ হাজার ৪২৯টি ‘মিথ্যা’ মামলা প্রত্যাহার করেছে (সূত্র: চিফ অ্যাডভাইজার অফিসের ফেসবুক পেজ)। এই পদক্ষেপের লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে অন্যায্য হয়রানি বন্ধ করা, রাজনৈতিক উত্তেজনা কমানো এবং নির্বাচনের আগে একটি সমতাভিত্তিক পরিবেশ তৈরি করা।

কলিম খান ও রবী চক্রবর্তী তাঁদের প্রখ্যাত প্রবন্ধ ‘ঝাঁক ম্যানেজমেন্ট’-এ উল্লেখ করেছেন, আধুনিক ব্যবস্থাপনায় মূল কাজ হলো মানুষের ঝাঁক ম্যানেজ করা। সমতা, ন্যায্যতার ভিত্তিতে তা করতে হবে। সমস্যা হলো ইউনূস সরকারের ভেতর গুঁচি মাছের স্বভাব রয়েছে। কাদার ভেতর থেকেও সে শরীরে কাদা লাগাতে চায় না। তাঁর সরকার ইঙ্গিতপূর্ণ, সুনির্দিষ্ট নয়। রাজনৈতিকভাবে নির্লিপ্ত কিন্তু গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। একই সঙ্গে এ সরকার সংশয়প্রবণ ও অনুদার এবং যার ভেতর স্পিরিচুয়ালিটির অভাব বিদ্যমান।

নির্বাচনের পথে হাঁটতে হলে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। মানবাধিকার সবার জন্য, সবখানে, সমানভাবে—এ বিশ্বজনীন মূল্যবোধ সুরক্ষা করতে হবে।

  • খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগ পেশাজীবী ও শিক্ষক

    মতামত লেখকের নিজস্ব