বিহারে জনগণের অভিবাদনের জবাব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
বিহারে জনগণের অভিবাদনের জবাব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

আলতাফ পারভেজের বিশ্লেষণ

গঙ্গার ঢেউ কি বিহার থেকে বঙ্গের দিকে আসছে

ভারতের রাজনীতিতে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের চরিত্র এক রকম নয়। ভোটের মনোনয়ন ও প্রচারে বিহারে জাতপাতের বিবেচনা যতটা তীব্র, পশ্চিমবঙ্গে সে রকম ঘটে ধর্মীয় পরিচয়ে। গঙ্গার ঢেউ কি বিহার থেকে বঙ্গের দিকে আসছে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন আলতাফ পারভেজ

প্রায় এক মাস হয়ে গেল বিহারের নির্বাচনের। ভারতের পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলে এই নির্বাচনের ফল নিয়ে বিস্ময় কাটছেই না। বিজেপি জোট এখানে কেবল যে জিতেছে তা–ই নয়, বিপক্ষকে অনেকটা ধসিয়ে দিয়েছে। আগের চেয়ে কংগ্রেস জোটের প্রায় ৮০ আসন কমে গেছে। ২৪৩ আসনের বিধানসভায় বিজেপি জোটের দখলে গেল দুই শর বেশি আসন।

যদিও নিবিড় অনুসন্ধানে দেখা যায়, অধিকাংশ জায়গায় খুব অল্প অল্প ভোটে বিরোধীরা হেরেছে; কিন্তু আসনের বড় ব্যবধানে আরএসএস পরিবার দারুণ উজ্জীবিত। এখন তারা বলছে, গঙ্গার পানি বিহার থেকে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে চলেছে জোয়ার হয়ে। কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী সে রকমই হুঁশিয়ারি দিলেন কলকাতার অভিভাবকদের। সত্যি কি তা–ই ঘটতে চলেছে? গঙ্গার আসন্ন এই প্রবাহে পদ্মাপারের মানুষদের জন্যও বিশেষ বার্তা আছে কি?

এসআইআর তলোয়ার কাকে বধ করবে?

ভারতের রাজনীতিতে বিহার ও বাংলার চরিত্র এক রকম নয়। তা ছাড়া প্রতি স্থানীয় নির্বাচনই স্থানীয় চরিত্রের। ফেডারেল ভারতের সেটা এক সৌন্দর্যও বটে। ভোটের মনোনয়ন ও প্রচারে বিহারে জাতপাতের বিবেচনা যতটা তীব্র, বাংলায় সে রকম ঘটে ধর্মীয় পরিচয়ে।

ফলে এটা বেশ প্রশ্নবিদ্ধ দাবি, বিহারের নির্বাচনী কলাকৌশল পশ্চিমবঙ্গও মাত করবে। তবে মমতার জন্য মাঠপর্যায়ে উদ্বেগজনক অনেক কিছু আছে। প্রায় দেড় দশক তিনি ও তাঁর দল ক্ষমতায়। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বহু অভিযোগ জমেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।

তা ছাড়া সর্বভারতীয় বিজেপির তুলনায় তৃণমূল একান্তই প্রাদেশিক দল। পুরো বিজেপি ইতিমধ্যে প্রায় সব জনপদের উপযোগী দুর্দান্ত এক নির্বাচনী মেশিনে পরিণত হয়েছে। আবার ‘এসআইআর’–এর নামে পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি রাজ্যে সূক্ষ্ম পক্ষপাতদুষ্ট এক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে নির্বাচনের আগে-আগে। এর প্রয়োগ থেকে বিহারের মতোই বাংলায়ও রাজনৈতিক সুবিধা পেতে চাইছে বিজেপি।

‘এসআইআর’ হলো স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন। সরল বাংলায় যাকে বলে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন। এই সংশোধনে বসে অনেক ভোটারের বেলায় প্রায় ১২টি নথি দেখাতে হবে। যে রাজ্যগুলোতে বিজেপিবিরোধীদের জমিন শক্ত, মুখ্যত সে রকম জায়গায় এটা শুরু হয়েছে। বিজেপির দাবি, পশ্চিমবঙ্গের মতো কিছু রাজ্যে কথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা বড় সংখ্যায় ভোটার তালিকায় নাম তুলে ফেলেছে।

‘নিবিড় সংশোধন’ হলে বাদ পড়বে সেসব ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ ও ‘রোহিঙ্গারা’।
বিহারের অভিজ্ঞতা বলছে, এসআইআরে বাদ পড়ছে প্রধানত প্রান্তিক মানুষ; যারা পারিবারিক সব ধরনের নথিপত্র ঠিকঠাক রাখার মতো দক্ষ নয়। বাংলায় এ রকম বেশি ঘটবে মুসলমান, মতুয়া ও আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে। এর মধ্যে মুসলমানেরা এখানে তৃণমূল, কংগ্রেস ও বামদের সমর্থক। বিহারে বিধানসভা ভোটের আগে ভোটার তালিকায় এ রকম নিবিড় সংশোধন চালানো হয় অতি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভরা আসনগুলোতে। স্থানীয়রা যেগুলোকে বলে ‘মার্জিনাল সিট’।

বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে চলছে এসআইর তথা ভোটার তালিকা সংশোধন

এসআইআরে বিহারে প্রায় ৪৭ লাখ মানুষের নাম বাদ পড়ে। সেখানে বিজেপিবিরোধীদের ভোট কমার পেছনে এই বাদ পড়াদের ভোট ছিল বলে অনুমান করা হচ্ছে; যাদের বড় অংশ ছিল প্রদেশটিতে বিভিন্ন সময় থিতু হওয়া শ্রমজীবী মানুষ।

নির্বাচন কমিশন একই তলোয়ারের ধার যাচাই করতে চলেছে এখন বঙ্গে। এসআইআর চালুর সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় বিজেপি ও তাদের বুদ্ধিজীবীরা নাগরিকতার সব ধরনের কাগজপত্র না থাকাকে যেভাবে সাংস্কৃতিকভাবে অমর্যাদার ব্যাপার করে তুলেছেন, তাতে ইতিমধ্যে অনেক পরিবারে তদন্তকারীরা আসার আগেই মানুষ আত্মঘাতী হচ্ছে।

আবার এসআইআরের কাজটা এত জটিল যে এর সঙ্গে যুক্ত মাঠকর্মীরাও কেউ কেউ আত্মহননে নেমেছেন। প্রদেশটিতে এরই মধ্যে এ রকম আত্মহত্যার ২৮টি ঘটনা ঘটেছে বলে মুখ্যমন্ত্রী বললেন। ব্যাপারটা নীরব এক যুদ্ধের মতো কামড় বসিয়েছে রাজ্যজুড়ে।

বাংলাদেশের ঘটনাবলি: বিজেপির পালে বাড়তি হাওয়া

অনুমান হচ্ছে মার্চ-এপ্রিলে রাজ্যে নির্বাচন হবে। ভারতীয় গণতন্ত্রের বড় এক প্রাণশক্তি লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচন। গত প্রায় আড়াই দশকে মমতা অনেকগুলো নির্বাচন পার করলেন বাংলায়। এখানকার নির্বাচনী রসায়ন তাঁর ভালোই রপ্ত। আগের দুটি বিধানসভা নির্বাচনে (২০১৬ ও ২০২১) তৃণমূল যথাক্রমে ২১১ ও ২১৫ আসন পেয়েছে। ভোট পাওয়ার হার কমবেশি ৪৫ শতাংশ। বিগত দুটি লোকসভা নির্বাচনেও (২০১৯ ও ২০২৪) পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনে তৃণমূল গড়ে ওই রকম ভোটই পেয়েছে।

আসনের বেলাতেও তারা বিজেপির চেয়ে এগিয়ে ছিল—যথাক্রমে ২২ ও ২৯টি পেয়ে।
কিন্তু তারপরও তাদের জন্য অন্তত তিনটি বিষয় আছে উদ্বেগের। ভারতের অন্য রাজ্যগুলোর নির্বাচনী পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে বিজেপি ক্রমে অজেয় এক নির্বাচনী প্রতিপক্ষে পরিণত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের বিগত চারটি (দুটি বিধানসভা ও দুটি লোকসভা) নির্বাচনে তারাও গড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ করে ভোট পাচ্ছে। অর্থাৎ আসনের হিসাবে তারা পিছিয়ে থাকলেও ভোটের হিস্যা তৃণমূলকে ছুঁইছুঁই অবস্থা।

কোনো কারণে তৃণমূলের ৩-৪ শতাংশ ভোট কমলে বা বিজেপির অনুরূপ পরিমাণ ভোট বাড়লে আসনের অঙ্ক অনেকখানি বদলে যাবে। গাণিতিক এই শঙ্কা বাস্তবে রূপ দিতে এসআইআর এবং সীমান্তের অপর দিকে ‘তৌহিদী জনতা’র কাজকারবারকে সহায়ক উপাদান হিসেবে ভাবছে বিজেপি। বাংলাদেশে মাজার ভাঙাভাঙি আর বাউলদের পেটানোর ধারাবাহিক ঘটনাবলিতে বিজেপির পিআর টিমের কাজ বেশ কমিয়ে দিচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপধ্যায়

বলা হচ্ছে, এই রাজ্যে গত ২৩ বছরে হিন্দু ভোট যেখানে ৭২ শতাংশ বেড়েছে, মুসলমান ভোটার সেখানে ১২৮ শতাংশ বেড়েছে। এ রকম প্রচারের একধরনের ফল পেয়েছেও তারা। ২০১৬ সালে যে বিজেপি বিধানসভায় মাত্র ৩টি আসন পেয়েছিল, পরেরবার পেল ৭৭ আসন। এবারও সেই প্রচার আছে।

এসব প্রচারের মাধ্যমে ‘মুসলমানপন্থী মমতা’র বিরুদ্ধে হিন্দু ভোট এক বাক্সে আনা বড় এক লক্ষ্য বিজেপির। পাশাপাশি এসআইআরে যদি অতীতের দেশান্তরিত মানুষদের মুসলমান অংশকে ভোটার তালিকা থেকে মুছে দেওয়া যায়, তাহলে বিজেপির আরেক ধাপ এগোতে সমস্যা নেই।

এসআইআর ছাড়াও বিজেপি ইস্যু করার চেষ্টা করছে তৃণমূল রাজত্বের দুর্নীতি ও মাস্তানিকেও। প্রায় দেড় দশকের শাসনে মমতার দলে সুবিধাভোগী যে গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, তার একাংশ সাধারণ সমাজে বিরক্তি তৈরির মতো যা যা ঘটিয়েছে, বিজেপি সেগুলোও প্রচারে আনতে চায়। গত বছরের আগস্টে কলকাতার বুকে আর জি কর হাসপাতালে একজন শিক্ষার্থী যেভাবে খুন হলেন, সে রকম সবকিছু বিজেপির প্রচারসূচিতে নিশ্চিতভাবেই থাকবে।

পুরোনো কৌশল হিসেবে ধর্মের রঙে মেরুকরণ

বাংলা শব্দ ‘মমতা’ যে রকম নরম ইমেজ তৈরি করে, তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি নিশ্চিতভাবে সে রকম নন। হয়তো সে কারণেই ২০১৯ সালে তাঁর জীবন নিয়ে নেহাল দত্ত বাঘিনী নামে একটি মুভি বানিয়েছিলেন। বাস্তব রাজনীতি আবার প্রমোশনাল সিনেমার মতো নয়। আসাম, ত্রিপুরা, বিহার, ওডিশাসহ সবদিক থেকে বাংলাকে ঘিরে ফেলেছে গেরুয়াশিবির। একে নাইলনের জাল দিয়ে তৈরি বাঘ ধরার একধরনের ফাঁদের সঙ্গে তুলনা করা যায়।

বিজেপির রাজনীতির একটা একক কৌশল হলো হিন্দু ভোটকে এক বাক্সে আনার চেষ্টা। এটা করতে গিয়ে তারা সব সময় সমাজে নানাভাবে মেরুকরণ তৈরি করে। পশ্চিমবঙ্গ-আসাম-ত্রিপুরায় তাদের মেরুকরণ বিদ্যার পুরোনো এক উপাদান বাংলাদেশ–ভীতি। হামেশাই সীমান্তবর্তী জেলায় মুসলমান ভোট বাড়ার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরছে তারা।

যেখানে মমতার অবস্থান শক্ত

ভোটযুদ্ধে মমতার সবল জায়গা হলো নারী ও মুসলমান ভোটব্যাংক। এই দুই জায়গায় তৃণমূলের শিকড় উপড়ে ফেলা কঠিন। শেষোক্ত সমাজে উন্নয়ন বঞ্চনায় হতাশা আছে। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারীর মতো নেতারা তাঁদের মাঝে যে ভীতি ছড়িয়েছেন, তাতে অন্য কোনো প্রতীকে ভোট দেওয়ার নিরীক্ষা মুসলমানদের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ। এ রকম ভোটসংখ্যা এক কোটির বেশি, প্রায় ২৭ শতাংশ। ২৯৪টি আসনের মধ্যে অন্তত ৫০ আসনে মুসলমান ভোট জয়-পরাজয়ে নির্ধারক ভূমিকা রাখার মতো।

আবার কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডার, রূপশ্রী ইত্যাদি নামের স্পষ্ট নগদ সামাজিক সুবিধামূলক প্রকল্পগুলো নারীদের মাঝে মমতার প্রশাসনের ইতিবাচক এক ইমেজ গড়ে রেখেছে।  মমতার জন্য আরেকটি সুবিধার দিক বিজেপি শিবিরে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর তুল্য ইমেজের কেউ নেই। শুভেন্দু অধিকারীর বদলে শমিক ভট্টাচার্যকে দিয়ে বিজেপি যে নিরীক্ষা চালাচ্ছে তাতে পরিস্থিতির তেমন হেরফের হচ্ছে না।

আবার কংগ্রেস ও বামপন্থীরা রাজ্যে তাদের সাংগঠনিক ঐতিহ্য পুনর্গঠনের যে চেষ্টা করছে, তাতেও মমতার চেয়েও বিজেপির ক্ষতির শঙ্কা বেশি। তৃতীয় কোনো পক্ষ যদি ভোটে ভাগ বসায়, সেটা সংখ্যাগুরুর ভোটব্যাংক থেকে যাবে।

ভোটযুদ্ধে মমতার সবল জায়গা হলো নারী ও মুসলমান ভোটব্যাংক।

প্রধান ইস্যু মতুয়া ভোট–বিপর্যয়

হঠাৎ করেই এবারের নির্বাচনের প্রধান ইস্যু পাল্টে গেল বলা যায়। ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন’ মতুয়া সমাজে যে ব্যাপক উদ্বেগ ছড়াচ্ছে, সেটাও তৃণমূলের পক্ষে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতে সবাই এখন এই দিকটার প্রতি বেশি নজর রাখছে।

ভোটার তালিকা হালনাগাদে যেসব দলিলপত্র চাওয়া হচ্ছে, অনেক মতুয়া ভোটার সেসব দিতে সমর্থ নন। অথচ বিগত দুই-তিন দফা ভোটে এই সমাজের ভোট বড় সংখ্যায় গেছে বিজেপির বাক্সে। এসআইআর মতুয়াদের ভোটব্যাংককে যে হুমকিতে ফেলেছে এবং যার প্রতিক্রিয়া হবে ৩০-৪০টি আসনে, সেটা সামাল দিতে বিজেপি এই সম্প্রদায়কে ২০১৯-এ সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সুবিধা নিতে বলছে। বনগাঁয় মতুয়া নেতা শান্তনু ঠাকুর এসব বলে আশ্বস্ত রাখতে চাইছেন নিজ সম্প্রদায়কে।

তবে মতুয়া কেন্দ্রভূমি ঠাকুরনগরে তাতে উদ্বিগ্ন নারী-পুরুষের আসা-যাওয়া-উদ্বেগ থামছেই না। তাঁদের কথা, ২০১৪ সালের পরে যাওয়া কেউ নাগরিকত্ব আইনেরও সুযোগ পাবেন না, আবার যাঁরা আগের উদ্বাস্তু তাঁদেরও নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ বেশ দুরূহ। দীর্ঘদিনের প্রচারণা ও উদ্বুদ্ধকরণের পরও ২-৩ হাজারের বেশি উদ্বাস্তু হিন্দু সিএএ আইনের সুবিধা পাননি বলে জানা যায়।

পশ্চিমবঙ্গে মতুয়া সম্প্রদায়

আইনটি ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর বা তার আগে ‘ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে’ ভারতে আগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য নাগরিকত্বের সুবিধা দিতে করা হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু এসআইআর এখনই হচ্ছে এবং নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ, সে কারণে এবারের ভোটের আগেই অতীত উদ্বাস্তুদের অনেকে ভোটাধিকার হারাবেন। সেরকম ঘটবে উত্তর চব্বিশ পরগনা, নদীয়া এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কিছু এলাকায়। বিজেপি গত নির্বাচনে যে ৭৭টি আসন পেয়েছে, তার অর্ধেক এ রকম সীমান্ত সন্নিহিত জেলা থেকে। ফলে এসআইআর বিজেপির জন্য আত্মঘাতীও হতে পারে।

আদিবাসীদের মধ্যে রাজবংশীদের অনেকেও নির্বাচন কমিশনের এই উদ্যোগে অনিশ্চিত অবস্থায় পড়েছে। কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়িতে ৩৩ লাখের রাজবংশী সমাজে ভোট নিয়ে এসেছে মতুয়াদের মতোই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কোচবিহারে পঞ্চানন বর্মার নামে বিশ্ববিদ্যালয় করে মমতা ওই অঞ্চলের ভোটের গণিতে কিছুটা এগিয়ে থাকতে চাইছেন। প্রায় দুই শ রাজবংশী স্কুলকে সরকারি অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। যদিও রাজবংশীদের আলাদা রাজ্যের দাবির বিরোধী মমতা। এ দাবি আবার নগর কলকাতার খুব অপছন্দ।

সামগ্রিক এসব বিবেচনায় এবারও পশ্চিমবঙ্গের ভোট হবে বিজেপি ঠেকাও বনাম তৃণমূল হঠাও সমীকরণে। কংগ্রেস ও বামপন্থীরা একটা তৃতীয় জোট করলেও গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে যে দ্বিদলীয় ভোটযুদ্ধ চলছে, তাতে খুব বেশি হেরফের হবে বলে মনে হয় না।

এই নির্বাচনী যুদ্ধের ফলাফল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপির জন্য বাঁচা–মরার কোনো সংকট তৈরি করবে না। বিহারের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পর দেশটির ২০টি রাজ্যের প্রশাসন এখন বিজেপি জোটের নিয়ন্ত্রণে। তবে বাংলাকে পদানত না করতে পারার অতৃপ্তি নাগপুরের নীতিনির্ধারকদের বহুদিনের।

এর মাঝে আবার কৌতূহলোদ্দীপক দিক হলো, বাংলাদেশের ভোট ও পশ্চিমবঙ্গের ভোট খুব কাছাকাছি সময়ে। সম্ভবত এক মাস আগে-পরে। এ রকম মুহূর্ত অতীতে বেশি আসেনি। পৃথক দেশ হলেও বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ভোটের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্তসম্পর্ক অস্বীকার করা যায় না।

প্রশ্ন হলো, কোন অঞ্চলের ফলাফল অপরের মতামতকে প্রভাবিত করবে এবার? উজানের স্রোতের ধরন সচরাচর ভাটিকে প্রভাবিত করে; কিন্তু সেটা তো নদীর ধর্ম, মানুষের বেলায় কী বিধান?

  • আলতাফ পারভেজ গবেষক ও লেখক

    *মতামত লেখকের নিজস্ব