চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

মতামত

চীনে উত্তাল হচ্ছে ভারতবিরোধিতার ঢেউ

প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলা টানাপোড়েনের পর চীন ও ভারতের সম্পর্ক কিছুটা উন্নত হয়েছে। ২০২৫ সালে দুই দেশের মধ্যে বেড়েছে যোগাযোগ ও লেনদেন। সদিচ্ছার ইঙ্গিত হিসেবে চীনা সরকার মার্চ মাসে ভারতীয় নাগরিকদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ভিসানীতিও শিথিল করা হয়। এর ফলে ভারতীয়দের চীনে ভ্রমণ সহজ হয়েছে।

তবে এতে চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বড় ধরনের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কিছু ভিডিওতে ভারতীয় পর্যটকদের নেতিবাচকভাবে দেখানো হয়েছে। যেমন সাবওয়েতে হাত দিয়ে খাবার খাওয়া বা পর্যটনস্থলে গোসল করার ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর তীব্র সমালোচনা শুরু হয়।

অনেক মন্তব্যে ভারতীয়দের লক্ষ্য করে বর্ণবাদী ভাষাও ব্যবহার করা হয়। কেউ কেউ দাবি করে, চীনে সব ভারতীয় পর্যটকের প্রবেশ বন্ধ করা উচিত। এমনকি চীনে থাকা সব ভারতীয়কে বহিষ্কারের কথাও বলা হয়।এই ভারতবিরোধী মনোভাব দ্রুত চরম আকার নেয়। হাজার হাজার মন্তব্যের ভিড়ে শান্ত ও নিরপেক্ষ মতামত খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

এই মনোভাবের পেছনে ভারতীয়দের নিয়ে প্রচলিত নানা ধ্যানধারণা কাজ করছে। ডৌইনসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ভারতীয়দের প্রায়ই অপরিচ্ছন্ন ও নৈতিকভাবে দুর্বল হিসেবে দেখানো হয়। পাশাপাশি কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে ভারতীয় অভিবাসীরা নাকি জায়গা দখল করে নিচ্ছে, এমন খবরও ছড়ানো হয়েছে। এসব খবর সত্য নয়। তবু অনেক চীনা নেটিজেন মনে করছেন, চীনও ভারতীয় অভিবাসনের সম্ভাব্য লক্ষ্য হতে পারে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চীনের মূল ভূখণ্ডে বসবাসকারী প্রবাসী ভারতীয়ের সংখ্যা মাত্র ৮ হাজার ৪৬০। এই সংখ্যা চীনের পাশের হংকংয়ের তুলনায়ও অনেক কম, সেখানে ভারতীয় আছেন ৪৪ হাজার ১৪০ জন। জাপানে আছেন ৪৭ হাজার ৮১০ জন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৭ হাজার ১ জন।

সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে বলা হয়, বিপুলসংখ্যক ভারতীয় নাকি ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অবৈধভাবে চীনে থেকে যাচ্ছেন, এর পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। বাস্তবে চীন আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের জন্য বড় কোনো গন্তব্য নয়। দেশটি অভিবাসনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।

তবু ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘাতের পর চীন ও ভারতের মধ্যে যোগাযোগ কমে যাওয়ায় এবং চীনা সামাজিক মাধ্যমের বদ্ধ পরিবেশের কারণে ভিন্ন তথ্য সহজে ছড়াতে পারে না। ফলে প্রচলিত ধ্যানধারণা ও ভুল তথ্য ভাঙাও কঠিন হয়ে পড়ে। এর পেছনে আরও গভীর একটি কারণ আছে। তা হলো চীনা সমাজে ভারতবিরোধী বক্তব্যের প্রতি সহনশীলতা। চীন ও ভারতের সম্পর্ক যখন উত্তপ্ত ছিল, তখন ভারতীয়দের উপহাস ও বৈষম্যের লক্ষ্য হিসেবে দেখা হয়েছে।

পশ্চিমা বর্ণবাদের শিকার হিসেবে নিজেকে দেখলেও, চরম জাতীয়তাবাদীরা একইভাবে ভারতকে ব্যর্থ ও মূল্যহীন রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরে।

এই পরিস্থিতিতে কিছু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ভারতকে আক্রমণ করে নিজেদের নিরাপত্তাবোধ ধরে রাখে। তারা ভারতকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় চীনের তুলনায় দুর্বল দেশ হিসেবে দেখে।

পশ্চিমা বর্ণবাদের শিকার হিসেবে নিজেকে দেখলেও, চরম জাতীয়তাবাদীরা একইভাবে ভারতকে ব্যর্থ ও মূল্যহীন রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরে। পাশাপাশি চীনা সমাজের মূলধারার আলোচনায় বর্ণবাদবিরোধী শক্তিশালী ভাষ্য না থাকায়, অনলাইনে এসব বক্তব্য নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনমতকে প্রভাবিত করে।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে যে তীব্র ভারতবিরোধী মনোভাব দেখা যাচ্ছে, চীনা সরকার সম্ভবত তা সমর্থন করে না। অতীতে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার সময় সরকার জাতীয়তাবাদী ভাষ্য ব্যবহার করে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছিল। তবে মহামারিকালীন বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর সরকার এখন দুর্বল অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে মনোযোগ দিয়েছে। এই লক্ষ্যেই বিদেশিদের জন্য ভিসা নীতি শিথিলসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীন ভারতীয় নাগরিকদের জন্য ২ লাখ ৬৫ হাজার ভিসা ইস্যু করেছে।

এসব কূটনৈতিক উদ্যোগ ইঙ্গিত দেয় যে, ভারত এখনো চীনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। বিশেষ করে চীনা পণ্যের বড় ক্রেতা হিসেবে ভারতের ভূমিকা এতে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই মুহূর্তে চীন ইচ্ছাকৃতভাবে ভারতবিরোধী মনোভাব উসকে দিচ্ছে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। বরং এই মনোভাব অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী ধারণার গণ্ডি ছাড়িয়ে চীনা সরকারের পররাষ্ট্রনীতিকেই প্রশ্ন করার পর্যায়ে পৌঁছেছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা সত্ত্বেও চীন এখনো মহামারির পরের মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ বেকারত্ব মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি অনাস্থা বাড়িয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে বাস্তবে অস্তিত্বহীন ‘ভারতীয়দের গণ অভিবাসন’কে সীমিত চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। যেহেতু ভিসা দিচ্ছে সরকার, তাই এই আলোচনায় চীনা সরকারকেই মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কম জন্মহারের কারণে যে শ্রমিক–সংকট তৈরি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে সরকার ভারতীয় অভিবাসী আনতে চাইছে।

আগস্ট মাসে চীনা সরকার তরুণ বিদেশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিভাদের জন্য যে কে ভিসা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, সেটিকেও একটি কাঠামোগত ফাঁক হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এর ফলে বিপুলসংখ্যক ভারতীয় চীনে ঢুকে পড়বে। এমনকি চীনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এবং চীনা অভিবাসন কর্মকর্তারা নাকি ভারতীয় গুপ্তচর, এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্বও ছড়ানো হয়েছে।

এই ভিত্তিহীন অভিযোগগুলো আসলে একটি সামষ্টিক সামাজিক উদ্বেগের প্রতিফলন। এই উদ্বেগ কমানোর কার্যকর উপায় না থাকায় জনমত অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। এর ফলে কিছু ‘অপছন্দের গোষ্ঠী’কে সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে কল্পনা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতেই ভারতীয়রা জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদের শিকার হয়ে উঠেছে।

নিঃসন্দেহে জাতীয়তাবাদী ভাষ্যের প্রভাব গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী। এটি সরকারের ক্ষমতা সংহত করার একটি হাতিয়ার হতে পারে। কিন্তু সরকার যখন ক্রমেই উগ্র হয়ে ওঠা এই মনোভাবকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়, তখন জাতীয়তাবাদই উল্টো বিপদ ডেকে আনতে পারে।

  • ঝেনলিন চুই লন্ডনের এসওএএস বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক ও জাপানের ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো
    দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত