মতামত

উন্নয়নের এক্সপ্রেসওয়েতে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড

‘এ দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে রাস্তা, সেতু, ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে, কিন্তু সেগুলোতে যান চলাচল নিরাপদ করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না, বিদ্যমান তদারকি সংস্থাগুলোরও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হচ্ছে না।’
‘এ দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে রাস্তা, সেতু, ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে, কিন্তু সেগুলোতে যান চলাচল নিরাপদ করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না, বিদ্যমান তদারকি সংস্থাগুলোরও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হচ্ছে না।’

ফিটনেসবিহীন একটি বাসকে ঘুমহীন একজন চালকের হাতে তুলে দিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে বেপরোয়া গতিতে চালানোর সুযোগ করে দিলে যা ঘটতে পারে, তা–ই ঘটেছে ইমাদ পরিবহনের বাসটির ক্ষেত্রে। ১৯ মার্চ মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় ইমাদ পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং আহত হন অন্তত ২৫ জন।

সব সময় যা হয়, এবারও দুর্ঘটনার পর জানা গেল, এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলকারী বাসটির চলাচলের কোনো অনুমতি ছিল না, বাসটির ফিটনেস সনদও ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। আহত এক বাসযাত্রীর বরাত দিয়ে জানা যায়, বাসটির ব্রেক ঠিকমতো কাজ করছিল না বলে চালক ও হেলপার নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করছিল। শুধু তা–ই নয়, এই একই বাস ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর রাতে গোপালগঞ্জে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দেওয়ার ফলে তিনজনের মৃত্যু ঘটেছিল। এই ঘটনায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বাসটির চলাচলের অনুমতি স্থগিত করলেও সে স্থগিতাদেশ পালন করা হচ্ছে কি না, তার কোনো তদারকি না করায় বাসটি এক্সপ্রেসওয়েতে অবলীলায় যাত্রী নিয়ে চলাচল করছিল।

মহাসড়কে চলাচলের অনুমতি ও ফিটনেসবিহীন বাসে যাত্রী পরিবহন ছাড়াও ইমাদ পরিবহনের মালিকপক্ষের আরেকটি গুরুতর অপরাধ হলো, চালককে পর্যাপ্ত বিশ্রাম না দিয়েই একটানা বাস চালাতে দেওয়া। সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২–এর ৩২(৫) ধারা অনুসারে, একজন চালককে দিয়ে একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো যাবে না। এরপর কমপক্ষে আধা ঘণ্টা বিশ্রাম দিয়ে আবার তিন ঘণ্টা গাড়ি চালানো যাবে। তবে দিনে আট ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি একজন চালককে দিয়ে গাড়ি চালানো যাবে না।

প্রথম আলোর সংবাদ অনুসারে, দুর্ঘটনার আগের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টার বেশি বাস চালিয়ে ক্লান্ত ছিলেন চালক জাহিদ হাসান। তিনি ১৬ মার্চ রাতে ঢাকা থেকে যাত্রীবাহী বাসটি চালিয়ে পিরোজপুর গিয়েছিলেন, পরের দিন ১৭ মার্চ সকালেই আবার পিরোজপুর থেকে ঢাকার দিকে যাত্রা করেন। ১৭ মার্চ বিকেলে আবার যাত্রী নিয়ে যান পিরোজপুরে। রাতে পিরোজপুর পৌঁছে পরের দিন ১৮ মার্চ সকালে আবার যাত্রী নিয়ে ঢাকায় আসেন। ঢাকা থেকে ১৮ মার্চ দুপুরেই আবার যান খুলনায়। রাতে বাসের মধ্যে মাত্র তিন থেকে চার ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে ১৯ মার্চ ভোর চারটায় খুলনা থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। ধারণা করা হচ্ছে, এ রকম বিশ্রামহীন ক্লান্ত দেহে ঘুমচোখে অতিরিক্ত গতিতে বাস চালানোর কারণে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে।

নির্ঘুম ক্লান্ত দেহে পরিবহন চালিয়ে দুর্ঘটনা এটাই প্রথম নয়, এ রকম দুর্ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে; কিন্তু চালকদের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে পরিবহনমালিকদের বাধ্য করা হচ্ছে না।

গত ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে কুড়িগ্রাম সদরের ত্রিমোহনী বাজারে দাঁড়িয়ে থাকা একাধিক ব্যক্তি ও অটোরিকশাকে চাপা দেওয়া ‘আমার এন্টারপ্রাইজ’ বাসের চালক স্বপন মিয়ার কথাই ধরা যাক। আপাতদৃষ্টিতে স্বপন মিয়ার বেপরোয়া ও বিপজ্জনক চালনার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু স্বপন মিয়া কী কারণে বেপরোয়া চালিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারালেন, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যায়, সারা রাত গাড়ি চালিয়ে এসে পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম না নিয়েই ফিরতি যাত্রায় আবারও স্টিয়ারিং ধরেছিলেন তিনি।

পরিবহনমালিকেরা যদি চালকদের হাতে বাস তুলে দেওয়ার বেলায় পর্যাপ্ত বিশ্রামের বিধি মেনে চলতেন, তাহলে কি স্বপন মিয়ার পক্ষে পর্যাপ্ত না ঘুমিয়েই বাস চালানো সম্ভব হতো? সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা যদি যথাযথ নজরদারি ও আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে মালিকদের এই নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য করত, তাহলে কি এই দুর্ঘটনাটি ঘটত? তা ছাড়া সড়কে গতিসীমা বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারটি শুধু কাগজে–কলমে সীমাবদ্ধ না থেকে যদি বাস্তবেও প্রয়োগ করা হতো, গতিসীমা লঙ্ঘনকারী চালকদের নিয়মিত নজরদারির মাধ্যমে জরিমানা ও শাস্তির আওতায় আনা হতো, তাহলেও কিন্তু গতিসীমা লঙ্ঘন করে যানবাহন চালনা কমে আসত।

এ দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে রাস্তা, সেতু, ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে, কিন্তু সেগুলোতে যান চলাচল নিরাপদ করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না, বিদ্যমান তদারকি সংস্থাগুলোরও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হচ্ছে না।

বাংলাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মহাসড়ক-এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে, কিন্তু সেই রাস্তাগুলোতে পরিবহনের গতিনিয়ন্ত্রণের কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে না। পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির গতি সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হলেও কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা না থাকায় চালকেরা অবলীলায় ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালাতে পারেন। এর আগে এই এক্সপ্রেসওয়েরই জাজিরার নাওডোবা এলাকায় গত ১৭ জানুয়ারি অতিরিক্ত গতিতে চালানোর কারণে রোগীবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্স ট্রাকের পেছনে ঢুকে গিয়ে ছয়জনের মৃত্যু ঘটে।

সড়ক দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অনেক সময় চালকের বেপরোয়া মনোভাব, বিপজ্জনক গতিতে যান চালনা, পাল্লাপাল্লি করা, যানবাহন চালনার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও লাইসেন্স না থাকা ইত্যাদির কথা উঠে আসে। এই কারণগুলোর কোনোটাই অগুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু কী কারণে হাজার হাজার চালক একই ধরনের বেপরোয়া আচরণ করেন, কীভাবে ফিটনেস ও অনুমোদনবিহীন বাস মহাসড়কে অবলীলায় চলাচল করে, কী কারণে গতিসীমা অতিক্রম করে যানবাহন চালনা করলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না—এসব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করে সেই অনুযায়ী কাঠামোগত সমস্যাগুলোর সমাধান করা না হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে না।

দুর্ঘটনার পর অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় চালকের লাইসেন্স নেই বা চালক যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত নয়। সন্দেহ নেই লাইসেন্স ছাড়া যানবাহন চালনার জন্য চালক দোষী। কিন্তু প্রশ্ন হলো পরিবহনমালিক যদি লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে চাবি তুলে না দিতেন কিংবা সরকারের তদারকি সংস্থা যদি যথাযথ নজরদারির মাধ্যমে লাইসেন্সবিহীন চালককে যান চালনা থেকে বিরত রাখত, তাহলে কি লাইসেন্সবিহীন চালকের পক্ষে দুর্ঘটনা ঘটানো সম্ভব হতো? সমস্যা আরও আছে। চালকেরা প্রশিক্ষণ পাবেন কোথা থেকে?

বাংলাদেশের চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘ওস্তাদের’ কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে হেলপার থেকে চালক হতে হয়। এ কারণে সারা দেশে লাইসেন্সধারী বৈধ চালকের সংকট রয়েছে, ফলে বৈধ লাইসেন্সধারী চালক ছাড়াই চলছে ১০ লাখের বেশি যানবাহন। আবার যানবাহনের লাইসেন্স প্রদানের ব্যবস্থাও দুর্নীতিমুক্ত না হওয়ার কারণে এমনকি কাগজে–কলমে বৈধ লাইসেন্সধারী চালকদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

ফিটনেসবিহীন যান চলাচলের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। সারা দেশে অন্তত ৫ লাখ যানবাহন চলছে, যেগুলোর কোনো ফিটনেস সনদ নেই। আবার লাইসেন্সের মতো ফিটনেস সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, দক্ষতা ও লোকবলের সংকটের কারণে যেসব যানবাহনের কাগজে–কলমে ফিটনেস সনদ থাকে, কার্যত তার অনেকগুলোরই কোনো ফিটনেস থাকে না। অথচ সড়কে নিরাপদে চলাচলের জন্য যানবাহনের যান্ত্রিক ও কাঠামোগত ফিটনেস ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

সড়ক–মহাসড়ক নির্মাণের পেছনে বছর বছর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হলেও চালকদের প্রশিক্ষণ কিংবা যানবাহনের ফিটনেস নিশ্চিত করার জন্য বিআরটিএর সক্ষমতা ও নজরদারি বৃদ্ধির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না বলেই সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়মিত দুর্ঘটনার শিকার হয়।

শুধু কতগুলো ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করলেই মানুষের জীবনমানের সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করা যায় না। কোনো ভবনের ভিত্তি মজবুত না করে আকৃতিতে বাড়িয়ে চললে যেমন ভবনটি টেকসই হয় না, একইভাবে রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার মানোন্নয়ন না করে শুধু অবকাঠামো বাড়িয়ে চললে মানুষের জীবনের ঝুঁকি বাড়ে। উন্নয়নের মহাসড়কে ক্রমবর্ধমান দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

এ দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে রাস্তা, সেতু, ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে, কিন্তু সেগুলোতে যান চলাচল নিরাপদ করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না, বিদ্যমান তদারকি সংস্থাগুলোরও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হচ্ছে না। আর এই বিদ্যমান পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখার পেছনে ফিটনেসবিহীন গাড়ির মালিক, চাঁদাবাজ মালিক সমিতি, দালাল শ্রমিক ফেডারেশন ও সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বার্থ একসূত্রে গাঁথা। এই স্বার্থের জাল ছিন্ন করে কাঠামোগত সমস্যাগুলোর সমাধান না করা হলে সড়ক দুর্ঘটনায় নিয়মিত অসংখ্য মানুষের অকালমৃত্যু বন্ধ হবে না।

  • কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক, প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ, নজরদারি পুঁজিবাদ ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভবিষ্যৎ’। ই-মেইল: kallol_mustafa@yahoo.com