রাজনীতির মাঠে একটি সন্দেহ আগাগোড়াই ছিল। এনসিপি দলটি স্বতন্ত্র দলের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারবে তো! প্রশ্নটির উত্তর দিতেই যেন এনসিপি একটি কৌতূহলোদ্দীপক রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞের অংশীজন হয়ে গেল। দলটির মুখপাত্ররা জানাচ্ছেন—শহীদ ওসমান হাদির প্রয়াণে নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। তাঁরা বুঝেছেন—সমমনারা একত্র ও একজোট না থাকলে আধিপত্যবাদ ঠেকানো যাবে না। আবার একই সঙ্গে এটিও জানাচ্ছেন—এটি শুধুই নির্বাচনী জোট।
এনসিপিরও এক বড় অংশ হয়তো অপেক্ষাই করছিল বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনী জোটে যাওয়ার। চলতি পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দলের ভেতরের প্রগতিশীল ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় অংশ পদত্যাগ করছে, অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার ঘোষণা দিচ্ছে। তারাও শিখছে বাংলাদেশের রাজনীতির চরিত্র আর কখনোই সাদা-কালো হয়ে ওঠার নয়।
রাজনীতিতে জোট মানেই টানাপোড়েন। কিন্তু বর্তমান জোটটি নিয়ে বিতর্ক আলাদা। যদিও জোটবদ্ধরা বলছেন এটি নিতান্তই আসন সমঝোতার হিসাব-নিকাশের সম্পর্ক, বাস্তবতা ভিন্ন। এটি ভবিষ্যৎ রাজনীতির চরিত্র নির্ধারণের একটি বড় বাঁকই বটে।
এনসিপির জোটপন্থী অংশের কয়েকটি শক্ত যুক্তি রয়েছে। যেমন এক, পলাতক স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঠেকাতে এর চেয়ে বড় বিকল্প নেই। এককভাবে লড়াই ঝুঁকিপূর্ণ। আওয়ামী লীগ বা লীগপন্থী শক্তির ছায়া কাঠামোর পুনরুত্থান হলে ‘জুলাই বিপ্লব’ অর্থহীন হয়ে যাবে। ভয়টি খানিকটা বাস্তবই শোনায়।
দুই, পরিবর্তন ও সংস্কার ক্ষমতার অংশীদার না হলে সম্ভব নয়। বাইরে দাঁড়িয়ে নৈতিক উচ্চতা ধরে রাখা সহজ। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রকে আঁকড়ে না ধরলে কাঠামোগত সংস্কার হয় না।
তিন, জুলাই সনদের গণভোটে বিএনপির সম্ভাব্য ‘না’ ভোট ঠেকাতে হলেও এই জোট দরকার—এই যুক্তিও তারা দিচ্ছে। এই যুক্তি অবশ্য অস্পষ্ট। সনদের গণভোটের ভোট স্বতন্ত্র থাকা বা জোটে থাকা না–থাকায় ইতরবিশেষ হবে কেন?
চার, জামায়াতে ইসলামী বিএনপির তুলনায় বেশি সুশৃঙ্খল। কেন্দ্রের নির্দেশ পেলে কর্মী-সমর্থকেরা বিনা বাক্য ব্যয়ে, বিনা দ্বিধায় সমর্থন দেবে। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় এটি বড় সুবিধা দেবে। বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের বেলায় এ রকম সুবিধা মেলা অনিশ্চিত।
পাঁচ, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপির প্রতি ভারতের দুর্বলতা এবং পর্দার আড়ালের সমঝোতা ঠেকাতেও জোট প্রয়োজন।
ছয়, জোটের মাধ্যমেই ‘জুলাই শক্তির’ সংহতি আরও সুদৃঢ় ও সুসংহত থাকবে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—জোটটি কি আসলেই শুধু নির্বাচনের জন্য? ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিকনির্দেশনার কী হবে তাহলে? এটি যদি সাময়িক কৌশল হয়, ঝুঁকিগুলো সামাল দেওয়ার কর্মকৌশলে নেই কেন? পুরোনো রাজনীতির বিকল্প না হয়ে পুরোনো বন্দোবস্তেই বিলীন হয়ে গেলে গণহতাশার দায় কীভাবে নেবে ধারণা আছে কি?
আরও যুক্তি—ক. অন্যদের (জামায়াতের) প্রতিষ্ঠিত ‘পলিটিক্যাল ক্যাপিটাল’ বা রাজনৈতিক সম্বল ব্যবহার করা গেলে সময়, শ্রম, অর্থ জোগাড়ের ঝক্কি কমে। নতুন দল বা নতুন শক্তির জন্য এটি বড় অনায়াস পাওনা।
খ. নির্বাচনী নিরাপত্তা ও মাঠ ব্যবস্থাপনা নতুন দলের জন্য বিপজ্জনক। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার প্রার্থীদের জন্য জোট অসামান্য নিরাপত্তাকবচ।
গ. জোটের ভোট নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কম। একই ভাবধারার বিরোধী শিবিরের একাধিক প্রার্থী থাকলে সুবিধা পায় প্রতিপক্ষ।
ঘ. জোট মানেই রাষ্ট্রক্ষমতার দরজায় কড়া নাড়া। সেটি ভবিষ্যৎ দরকষাকষিতে কাজে লাগে।
তাই এনসিপি খুব ভুল কিছু করেছে বলা যায় না। রাজনীতি শুধুই আদর্শের চর্চা নয়, পাশাপাশি বাস্তবতারও খেলা। ভালো উদ্দেশ্যের জোট সব সময় অশুভ না-ও হতে পারে। নির্বাচনী জোট গড়া দোষের কিছুও নয়। হয়তো এই জোটটি অতীতের স্বৈরাচারী জোটগুলোর মতো হালুয়া-রুটির ভাগ–বাটোয়ারার মেলা হয়েও বসবে না। হয়তো শেখ হাসিনা বা এরশাদের সময়কার জোটগুলোর তুলনায় ভিন্ন ধরনেরই হবে। তবে বাংলাদেশিরা ঘরপোড়া গরু। সিঁদুরে মেঘকে অনায়াসে মেঘ বিবেচনা করাও আমজনতার স্বভাব।
জোটবদ্ধ হলেই শক্তিশালী হবে, এমনটি না-ও ঘটতে পারে। উল্টো শক্তিহীনতার কারণও হয়ে যেতে পারে। পাকিস্তানে ইমরান খান জোটবদ্ধ সরকারই গড়েছিলেন। জোটভুক্তরা একান্তই চাওয়া-পাওয়ার গরমিলের ছুতায় তাঁকে পরিত্যাগ করেছে। তাঁর স্থান এখন কারগারে।
রাজনীতিতে সুবিধার মূল্য চুকানো দিয়েই সমস্যা শুরু হয়। প্রথমত বড় ঝুঁকি দলের নিজস্ব অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়া। জোটের ভেতরে ছোট বা নতুন শক্তি প্রায়ই বড় শক্তির ছায়ায় মিলিয়ে যায়। ভোটারদের চোখে তারা আর আলাদা থাকে না। বড় পুকরের ছোট মাছের মতো দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায়।
‘ডমিন্যান্ট পলিটিক্যাল কালচার’ বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধ্বংস করে ছাড়ে উদীয়মান রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে। বিশ্বজুড়ে অনেক উদাহরণ আছে। ইউরোপে বাম বা পরিবেশবাদী দলগুলো শক্তিশালী হবে ভেবে বড় ঐতিহ্যবাহী দলের সঙ্গে জোট করেছে। ফল চূড়ান্ত বরবাদি। গ্রিন পার্টিগুলো সবচেয়ে সম্ভাবনাময় থেকেও ছিন্নমূল হয়ে গেছে। লাতিন আমেরিকায় উদীয়মান সংস্কারপন্থীরা পুরোনো ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে পুরোপুরি শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। আফ্রিকায় বহু ‘পরিবর্তনের দল’ জোটের রাজনীতিতে ঢুকে পুরোনো বন্দোবস্তেরই অংশ হয়ে গেছে।
ডমিন্যান্ট কালচার সব সময় নিজের নিয়ম চাপিয়ে দেয়। নতুন শক্তিকে বদলায় না বরং গ্রাস করে। এনসিপির ‘নতুন বন্দোবস্ত’ ধারণাটি তাই অকার্যকর মুখভরা বুলিতে পরিণত হতে সময় না-ও লাগতে পারে।
দ্বিতীয়ত, দেশজুড়ে অসংখ্য ‘সুইং ভোটার’ তৃতীয় শক্তির অপেক্ষায়। এই ভোটাররা দুই মেরুর বাইরে ভিন্নতা খুঁজছিল। এনসিপি-জামায়াত জোট তাদের সেই প্রত্যাশাকে ভেঙে দিলে, তারা উল্টো প্রত্যাঘাত করলে ভোট না বেড়ে কমতেও পারে।
জোটদদ্ধতা যতটা সুযোগের, ততটাই সংকটের। বাস্তববাদী হিসাব মেলাতে গেলে আদর্শকে জলাঞ্জলি দিতেই হয়। তাৎক্ষণিক লাভ পেতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির প্রস্তুতি থাকতে হয়।
তৃতীয়ত, একটি স্বতন্ত্র দলীয় আদর্শিক কাঠামো তৈরির সম্ভাবনা আঁতুড়ঘরেই মারা গেল। জোট রাজনীতিতে নীতি নয়, সমঝোতা মুখ্য হয়। দীর্ঘ মেয়াদে এটি ক্ষতিকর। দলটি স্বাতন্ত্র্য নিয়ে টিকে থাকলে মোটাদাগে নির্বাচনে হারলেও অসংখ্য নেতা তৈরি হতো ভবিষ্যতের জন্য।
জুলাই বিপ্লবের সুসংহত শক্তির আকর ছিল নৈতিক উচ্চতা, স্বতঃস্ফূর্ততা ও নাগরিক আশাবাদ। জোট রাজনীতিতে নাগরিক আশাবাদ বিলীন হয়ে বিশ্বাস ও আস্থার সংকট বাড়াতে পারে। জোট যদি ১৫১টি আসনে না জেতে, নানা দল-মত ও স্বার্থের ভাঙন বাড়বেই। প্রতিপক্ষ বিএনপি জোটও যদি ১৫১ আসনে না জেতে, তারাও এই জোটের হাত ধরে আসা অনেককে কিনে নেবে। পারস্পরিক আস্থা আরও ভাঙবে। ভ্রাতৃঘাতী রাজনৈতিক কলহও তৈরি হতে পারে।
আওয়ামী লীগ না থাকলেও অস্থিরতা থাকবেই। নির্বাচনে অংশ নিতে না পারা আওয়ামী লীগ যদি কোনোভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসনে জিতিয়ে আনতে পারে, তাহলে তৈরি হবে এক অদ্ভুত কোয়ালিশন বা জোট। কোয়ালিশনের স্থিতি-স্থায়িত্বের ঝুঁকি সীমাহীন। সরকার টিকবে না। দরকষাকষি চলবে। রাষ্ট্র আবার অচল হবে।
অনিশ্চয়তা অন্তর্ঘাতের সুযোগ বাড়ায়। জোট রাজনীতি পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হলে বিপদ বাড়বে।
শেষ কথা, জোটদদ্ধতা যতটা সুযোগের, ততটাই সংকটের। বাস্তববাদী হিসাব মেলাতে গেলে আদর্শকে জলাঞ্জলি দিতেই হয়। তাৎক্ষণিক লাভ পেতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির প্রস্তুতি থাকতে হয়।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—জোটটি কি আসলেই শুধু নির্বাচনের জন্য? ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিকনির্দেশনার কী হবে তাহলে? এটি যদি সাময়িক কৌশল হয়, ঝুঁকিগুলো সামাল দেওয়ার কর্মকৌশলে নেই কেন? পুরোনো রাজনীতির বিকল্প না হয়ে পুরোনো বন্দোবস্তেই বিলীন হয়ে গেলে গণহতাশার দায় কীভাবে নেবে ধারণা আছে কি?
১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন শুধুই ক্ষমতার হিসাব-নিকাশে আটকে থাকবে না, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকনির্দেশ করবে। যদি জোটের হিসাব-নিকাশে না মেলে, দলটি আবারও স্বতন্ত্র চরিত্রে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি? হিসাব-নিকাশ না মিললে আরও সংঘাত, আরও ভাঙন, আরও বিপর্যয়ের পথ তৈরি হতে পারে।
হেলাল মহিউদ্দীন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটার মেভিল স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিজ্ঞান অধ্যাপনায় নিয়োজিত
* মতামত লেখকের নিজস্ব