মতামত

পেডোফাইলরা কি চারপাশে কিলবিল করছে

সম্প্রতি উদ্বিগ্ন এক মা তাঁর পরিচিত অভিভাবকদের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও পোস্ট করেছেন। সেটি ভাইরাল হয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়ায়।

দেশ–বিদেশের অনেকে চমকে উঠেছেন ভিডিওটি দেখে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, একজন শিক্ষার্থীর জন্মদিনে কেক কাটা হয়েছে। সেই কেক শিক্ষার্থীর মুখে আগ্রহ নিয়ে লেপে দিচ্ছেন শিক্ষক।

শিক্ষক এখানে থেমে গেলে বিষয়টি ‘ফান’ হিসেবে গণ্য করে সেদিনের মতো ‘ফুলস্টপ’দেওয়া যেত; কিন্তু থলের মধ্যে বিড়াল থাকলে ‘ফুলস্টপ’ সহজ নয়।

এই শিক্ষকের অতি আগ্রহের বিড়াল টুপ করে থলে থেকে বেরিয়ে পড়ল তখন, যখন তিনি কিশোর ছাত্রটির কেক মাখনো গাল নিজের জিহ্বা দিয়ে পরিষ্কার করা শুরু করেন।

এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন শিশুটির মা জানান ওই শিক্ষক নাকি ছেলে শিক্ষার্থীদের জন্মদিনে এ রকম আচরণ করেন হামেশাই।

একজন অভিভাবক শিক্ষকটির এই অগ্রহণযোগ্য আচরণকে পেডোফাইল–সুলভ আচরণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে পেডোফাইল কী? পেডোফাইল বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যিনি প্রাক্‌–কৈশোর শিশুদের (সাধারণত ১৩ বছরের কম) প্রতি যৌন আকর্ষণ, তাড়না বা লালসা অনুভব করেন।

তবে এখানে যে এরা থেমে থাকবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এ রকম অগ্রহণযোগ্য যৌন আচরণ ১৩ –১৪ বছর পার হয়ে যাওয়া শিশু=কিশোরদের প্রতিও থাকতে পারে। যৌন অপরাধবিজ্ঞান সেই প্রবণতাকে ‘হেবেফিলিয়া’ বলে উল্লেখ করেছে।

হেবেফিলিয়া এমন একধরনের যৌন প্রবণতা, যেখানে একজন প্রাপ্তবয়স্কের যৌন আকর্ষণ থাকে শুধু ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের প্রতি। এটি পেডোফিলিয়া থেকে আলাদা; কারণ পেডোফিলিয়ায় আকর্ষণ থাকে কৈশোরে পৌঁছানোর আগের শিশুদের প্রতি, অর্থাৎ যারা এখনো বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছেনি। তা ছাড়া ‘ইফেবোফিলিয়া’ বলেও আরেকটি গ্রুপের কথা গবেষকেরা উল্লেখ করেছেন।

মেয়েশিশুরা যেমন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাছের লোকজন যেমন আত্মীয়, শিক্ষক, পারিবারিক বন্ধু, প্রতিবেশীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়; ছেলেদের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটে।

পেডোফিলিয়া, হেবেফিলিয়া বা ইফেবোফিলিয়ার চুলচেরা বিশ্লেষণ এই লেখার মোক্ষ নয়।

তবে এটুকু বলা যায়, তাঁরা সবাই অপ্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি যৌন তাড়নায় তাড়িত থাকেন এবং সুযোগ পেলেই নানাভাবে সেটি মিটিয়ে নেন। গালে কেক লাগিয়ে সেটি জিহ্বা দিয়ে পরিষ্কার করা সেই যৌন তাড়নারই বহিঃপ্রকাশ।

মাত্র হাঁটতে শেখা ভাগনে-ভাগনি বা ভাতিজা-ভাতিজির পেছন থেকে প্যান্ট খুলে দিয়ে অথবা শিশুর নরম গাল বা শরীরে দাড়ি ঘষে পুরুষ আত্মীয় বা পরিচিতজনেরা যে আনন্দ পান, সেটিও মনের মধ্যে সুপ্ত বিকৃত যৌনাচারের প্রকাশ। সেটি নির্দোষ কোনো বিনোদন নয়।

উদ্বিগ্ন মায়ের পোস্টে অনেকেই আওয়াজ তুলেছেন ‘শিক্ষাঙ্গনে যৌন নিপীড়ন নির্মূল করুন।’

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, বড়দের পেডোফিলিয়ার শিকার হলে শিশুর মন, শরীর, আচরণ, আত্মবিশ্বাস ও ভবিষ্যৎ সম্পর্ক সবকিছুই গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পেডোফিলিয়ার শিকার হওয়া শিশু ভয়, উদ্বেগ ও দুঃস্বপ্ন, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, অপরাধবোধ ও নিজেকে দোষী ভাবা, বিষণ্নতা ও পিটিএসডি বা আঘাত– পরবর্তী মানসিক আভিঘাতের ঝুঁকিতে পড়ে।

সময়মতো পরিবারের সহযোগিতা, চিকিৎসা বা কাউন্সেলিং না পেলে শিশুকে এর ভার সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়।

পাঠকদের মনে থাকার কথা, বছর তিনেক আগে (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২) এক বয়স্ক মানুষের যৌন লালসার শিকার হয়ে সাত বছরের এক শিশু এতটাই বিপর্যস্ত হয়েছিল যে সে বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আত্মহত্যা করার চেষ্টার পরেই জানা যায় ঘটনাটা।

ওই ঘটনায় শিশুটি প্রথমে ভয়ে সংকুচিত হলেও সে ব্যথায় অতিষ্ঠ হয়ে পরের দিন সন্ধ্যায় ফুফুকে ঘটনাটি বলে, ‘দোকানদার আঙ্কেল জোর করে ব্যথা দিয়েছে।’ এটা কোনো অভিযোগ ছিল না। স্রেফ আস্থায় থাকা একজনকে শিশুটি জানাতে চেয়েছিল গা শিউরে ওঠা অভিজ্ঞতার কথা। হয়তো তার কষ্টের কথা বলে সে হালকা হতে চেয়েছিল।

বড়রা জানেন না শিশুদের সঙ্গে এমন পরিস্থিতিতে কেমন ব্যবহার করতে হয়; এমন হলে শিশুকে তার শারীরিক আর মানসিক সুস্থতার জন্য কী পদক্ষেপ নিতে হয়।

শিশুকে দোষারোপ করে এবং জনে জনে বারবার একই প্রশ্ন করে বড়রা তাকে সেই গর্তে ফেলে দেন, যে গর্ত থেকে সে বেরিয়ে আসতে চায়।

যে ঘটনার পরিকল্পনা ফাঁদ পাতা ও বাস্তবায়ন—সবকিছুতে একজন বয়স্ক মানুষের হাত; তখন শিশুকে দোষারোপ করে তার মনের মধ্যে অপরাধবোধ চাগিয়ে তোলার কোনো যুক্তি নেই। এতে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুটির ভোগান্তি বাড়ে।

ওই শিশুর ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটেছিল। বড়রা কেউ বিশ্বাস করেননি। উল্টো শিশুটিকেই তাঁরা বকাবকি করেন। নিরুপায় শিশু তাই বোধ হয় মৃত্যুকেই তার শেষ আশ্রয়ের জায়গা মনে করেছিল।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, নির্যাতনের ঘটনা যদি ঘটে, তাহলে কখনো শিশুকে দায়ী করা যাবে না। তাকে মানসিকভাবে সমর্থন করতে হবে। তাঁর সামনে এ ঘটনা নিয়ে বারবার আলোচনা বা কান্নাকাটি করা যাবে না। এতে তার মানসিক সংকট চরমে পৌঁছে যায়।

এই সাত বছরের শিশুটির ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটেছিল। শেষমেশ সে ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ভাগ্য ভালো, শিশুটি বেঁচে গিয়েছিল। পরে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল যৌন নির্যাতককে।

ছেলে শিশুরা যে সহজেই যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে, সেটি অনেকের ধারণাতেই নেই। এই সুযোগটাই নেয় ছদ্মবেশী যৌন নির্যাতক বা পেডোফাইলরা।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ২০২১ সালে আইন সালিশ কেন্দ্রের এক হিসাবে দেখা যায়, সে বছর (২০২১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত) মোট ৭৫ জন ছেলেশিশুকে ধর্ষণসহ যৌন হয়রানি করা হয়েছিল।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করে, সংখ্যাটি এর চেয়ে অনেক বেশি হবে। বছর পাঁচেক আগে একটি সংগঠনের সাতক্ষীরা আর ঢাকার ৯টি স্কুলে চালানো জরিপ থেকে দেখা যায়, প্রতি ১০ জনের একজন ছেলে যৌন নির্যাতন বা অশোভন আচরণের শিকার হয়।

শুধু মা–বাবা কেন, দেশের মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোও ছেলেশিশুদের যৌন নির্যাতন নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন বলে মনে হয় না। উদ্বিগ্ন হলে প্রকাশিত ভিডিও নিয়ে তাঁরা কথা বলতেন অথবা নিরপেক্ষ ও পরিচ্ছন্ন তদন্তের ব্যবস্থার দাবি নিয়ে এগিয়ে আসতেন।

এই জরিপে বিভিন্ন বয়সের ও ক্লাসের মোট ১ হাজার ২০০ ছাত্র অংশ নিয়েছিল। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রির সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ছয়জন ছেলেশিশুর মধ্যে কমপক্ষে একজন যৌন হয়রানির শিকার। মেয়েশিশুদের মধ্যে এই হার প্রতি চারজনে একজন।

মেয়েশিশুরা যেমন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাছের লোকজন যেমন আত্মীয়, শিক্ষক, পারিবারিক বন্ধু, প্রতিবেশীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়; ছেলেদের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটে।

চট্টগ্রামে সেই শিশুর কথা আমরা পত্রিকায় জেনেছিলাম, যাকে ধর্ষণ করেছিল, সে শিশুটির নিকটাত্মীয়। পুলিশ ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পাওয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠায়।

অনেকে মনে করেন, দরিদ্র পরিবারের ছেলেশিশুরা একটু বেশি ঝুঁকিতে থাকে। অভিভাবকদের নজরদারির বাইরে থাকলেই শিশুরা যৌন নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যে থাকে। সেখানে ধনী–গরিবের বিষয়টি গৌণ।

শিশু নির্যাতনবিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে একজন ভারতীয় বক্তার জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনায় জানতে পারি, মা–বাবার অর্থের অভাব না থাকায় দেশের অত্যন্ত সম্মানিত ও কাঙ্ক্ষিত বোর্ডিং স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর।

স্কুলের ছুটিতে বাড়ি এলে ব্যস্ত মা–বাবা অধিকাংশ সময় তাকে গৃহভৃত্যের কাছে রেখে বাইরে যেতেন। গৃহভৃত্য সেই সুযোগে নিয়মিত এই অবোধ কিশোরকে ধর্ষণ করেছেন।

বোর্ডিং স্কুল ছুটির সময় আর সব ছেলে যখন আনন্দে মেতে উঠত, কিশোরটি মনেপ্রাণে চাইত ছুটি যেন না হয়, তাকে যেন বাড়িতে যেতে না হয়।

শিশুর সম্ভাব্য যৌন নির্যাতন ও যৌন হেনস্তার ক্ষেত্রে একজন মা তাঁর মেয়ে সন্তানকে নিয়ে যত উদ্বিগ্ন–উৎকণ্ঠায় থাকেন, ছেলেকে নিয়ে ততটাই নিরুদ্বেগ নিশ্চিন্তে থাকেন। একজন মা জানান, ‘ছেলেকে নিয়ে আমার অন্য ভয়; তাকে কেউ তুলে নিয়ে যাবে না তো! তাকে কেউ ফুসলিয়ে নিয়ে বা জোর করে যৌন নির্যাতন করবে, এটা কখনো হয় নাকি? আমরা শুনি, মেয়েরাই কেবল এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়।’

শুধু মা–বাবা কেন, দেশের মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোও ছেলেশিশুদের যৌন নির্যাতন নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন বলে মনে হয় না। উদ্বিগ্ন হলে প্রকাশিত ভিডিও নিয়ে তাঁরা কথা বলতেন অথবা নিরপেক্ষ ও পরিচ্ছন্ন তদন্তের ব্যবস্থার দাবি নিয়ে এগিয়ে আসতেন।

হতে পারে নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামজাদা শিক্ষক বলেই সবাই চুপ আছেন। কেউ কেউ ফেসবুকে লিখেছেন এসব ‘এআই’–এর কীর্তি। সেটি হলেও তদন্তের কোনো বিকল্প নেই।

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক। ই–মেইল: wahragawher@gmail.com

*মতামত লেখকের নিজস্ব