
আর কয়েক দিন পরই সরকারের এক বছর পূর্তি হবে। গত বছর ৮ আগস্ট যখন মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন সব রাজনৈতিক দল, আন্দোলনকারী ছাত্রনেতৃত্ব তাদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল।
যেহেতু এই সরকার একটি গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এসেছে, সেহেতু সরকারের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। তারা ভেবেছিল, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আসা সরকার বৈষম্য কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। অন্তত সমাজের যারা প্রান্তিক, অবহেলিত, তাদের পাশে দাঁড়াবে। নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। কিন্তু যাঁদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, তাঁরা জননিরাপত্তা নিয়ে খুব ভাবেন বলে মনে হয় না। সংবাদমাধ্যমে অপরাধের খবর ছাপা হলেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘অতিরঞ্জন’। অতীতেও ক্ষমতাসীনেরা একই কথা বলতেন।
বিরোধী দলের ওপর দমন–পীড়ন ও গুম–খুনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু এই সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলার অবনতির বড় কারণ ‘মব ভায়োলেন্স’ বা সংঘবদ্ধ সহিংসতা।
১০ জুলাই বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও সংখ্যালঘু ঐক্য জোটের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছিল, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে ২৭ জন নিহত হয়েছেন এবং গত ১১ মাসে ২ হাজার ৪৪২টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ১৫ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এর প্রতিক্রিয়ায় জানিয়ে দিল, ‘এখন পর্যন্ত কোনো ঘটনার পেছনে সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এগুলো পৃথক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সহিংসতামাত্র।
বাংলাদেশে ২০২৫ সালের প্রথম ৬ মাসে মানবাধিকার পরিস্থিতি হতাশাজনক ও উদ্বেগজনক বলেছে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৪ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল ভীতিকর ও সংকটপূর্ণ, যেখানে গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলেও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসেনি। নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার–সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সন্তোষজনক সফলতা দেখাতে পারেনি।’
এইচআরএসএস যে রাজনৈতিক সহিংসতা, গণপিটুনি ও হত্যা, নারীর প্রতি নিপীড়ন ও ধর্ষণ, শিশু নির্যাতনের যে উপাত্ত তুলে ধরেছে, সরকার তা অস্বীকার করবে কী করে?
এখানে আমরা দুটি মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখ করব, যার একটির সঙ্গে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সম্পর্ক নেই। একান্তই ব্যক্তিগত। আবার সমাজবদ্ধ মানুষ হিসেবে পুরোপুরি ব্যক্তিগতও নয়। ব্যক্তি তো সমাজ ও রাষ্ট্রেরই অংশ। যখন রাষ্ট্র সংস্কারের কথা জোরেশোরে প্রচার হচ্ছে, তখনই খবর এল সঞ্জু বারাইক নামের এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এই শিক্ষার্থী গত সোমবার ভোররাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের রবীন্দ্র ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।
এর কয়েক ঘণ্টা আগে নিজের ফেসবুক বার্তায় আবেগঘন ভাষায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি, আমি দিনের পর দিন কাউকে ডিস্টার্ব করে গেছি, উল্টো মানুষকে দোষারোপ করা আমার একদম ঠিক হয়নি, আমি সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি দিনের পর দিন অন্যায় করেছি, নিজের দোষ ঢেকে অপরজনকে দোষ দেওয়া আমার ঠিক হয়নি। আমি সবার কাছে ক্ষমা চাইছি, আমার কারণে কারও কোনো ক্ষতি হলে সে দায় একান্তই আমার, আমি ক্ষমা চাইছি।’
সঞ্জুর গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায়। তাঁর মা স্থানীয় একটি চা-বাগানের শ্রমিক। তাঁর শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন লিখেছেন, ‘সঞ্জু বারাইক আমাদের ছাত্র ছিল। চা–বাগানে বড় হওয়া সঞ্জুর সঙ্গে আমার প্রথম সেমিস্টার থেকেই আলাপ। খুব কম কথা বলে। মাঝেমধ্যে আসত না। একদিন বললাম, “ক্লাস ভালো লাগে না?” ও লাজুক ভঙ্গিতে বলল, “টিউশনি করে ক্লান্ত হয়ে যাই ম্যাডাম।...”একদিন জানাল তার টিউশনি চলে গেছে, সে ভালো বাংলা বলতে পারে না বলে।’
বোঝাই যাচ্ছে, অনেক সংগ্রাম করে ঢাকায় টিকে ছিলেন সঞ্জু। চা–বাগান থেকে উঠে এসে শহুরে জীবন ও ভিন্ন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে তাঁর কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। কেউ বলেছেন, প্রেমেও ছিল মনমালিন্য। এভাবে একবুক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় পড়তে আসা কত তরুণ–তরুণী মাঝপথে হারিয়ে যান, আমরা কি তার খবর রাখি?
দ্বিতীয় ঘটনাটি খাগড়াছড়ির। এর সঙ্গে রাষ্ট্র ও রাজনীতির নিবিড় সম্পর্ক আছে। ১৪ বছরের এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে তার সহপাঠী শিক্ষার্থীরা ও বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন। বৃহস্পতিবার সাধারণ শিক্ষার্থী ও যুবসমাজের ব্যানারে খাগড়াছড়ির উপজেলা সদরের ভাইবোনছড়া মুনিগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের গেট থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়।
গত ২৭ জুন মেয়েটি দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হলেও পরিবার জানতে পারে গত বুধবার রাতে। সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে গত শনিবার বিষ পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি জানতে পারেন।
ধর্ষণের দায়ে যে চারজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁরা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পলাতক দুই আসামিও বিএনপির। যে বিএনপির নেতা–কর্মীরা ১৬ বছর ধরে জেল–জুলুমের শিকার হলেন, তাঁদেরই কেউ চাঁদাবাজি, দখলবাজিতে লিপ্ত হয়েছেন। তাই বলে ১৫ বছরের কিশোরীর ওপর এভাবে পাশবিক নির্যাতন চালানো। মেয়েটি এখন হাসপাতালে জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। আবার এর প্রতিবাদ করতে গিয়েও সেখানে কেউ কেউ নিগৃহের শিকার হয়েছেন। এটাই কি রাজনীতির নতুন বন্দোবস্ত?
অন্য ক্ষেত্রে যেমন হয়, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘আসামি ছয়জন আমাদের নেতা-কর্মী ছিলেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কারণে তাঁদের সবাইকে মৌখিকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
৫ আগস্ট পর্যন্ত তাঁরা বিএনপির রাজনীতি করতেন, এখন বহিষ্কার করেছি—এই দোহাই দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। তাঁদের অপকর্মের দায় বিএনপিকেই নিতে হবে।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com
* মতামত লেখকের নিজস্ব
[সংশোধনী: এ লেখার ছবিটি প্রথম আলোর নয়। ছাপা পত্রিকায় অনিচ্ছাকৃত ভুলে সেটি উল্লেখ করা হয়েছে। অনলাইন সংস্করণে এটি সংশোধন করা হলো।]