বালাসী-বাহাদুরাবাদ রুটে লঞ্চ সার্ভিস
বালাসী-বাহাদুরাবাদ রুটে লঞ্চ সার্ভিস

মতামত

রংধনু মার্কা এসব উন্নয়ন দিয়ে করবটা কী

গাইবান্ধা ইনডোর স্টেডিয়ামে চলছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। পেছনের চেয়ার থেকে রফিকুল ইসলাম নামের স্থানীয় এক সাংবাদিক নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘ভাই, গাইবান্ধায় প্রথম এসেছেন, বালাশীঘাটটা দেখে যাবেন। তেমন বড় কিছু নয়, তবে এখানকার জন্য দর্শনীয়।’

তখনো প্রথম আলোর গাইবান্ধা প্রতিনিধি শাহাবুল শাহীন ব্যস্ত আছেন। আমাকে ব্রহ্মপুত্রের এই ঘাট দেখাতে নিয়ে গেলেন নাট্যকার আসাদ সরকার। তিনি স্থানীয় শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার। সেদিনের বিকেলটা ছিল বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল।

সড়কের পাশের গাছপালার ফাঁকফোকর গলিয়ে চোখে লাগছে সোনা রঙের নরম রোদ। তার ভেতর দিয়ে ছুটছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। মনে হলো রিকশা নয়, আমরা একটা ঝলমলে বিকেলের পিঠে চড়ে ছুটছি।

বালাশীঘাটে পৌঁছাতেই হাতের বাঁ পাশে বিশাল দুটি গেট নজর কেড়ে নিল। তাতে লেখা রয়েছে ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ’। তার নিচের লাইনে ছোট হরফে লেখা ‘বালাশী ফেরিঘাট টার্মিনাল, ফুলছড়ি, গাইবান্ধা’।

বালাশী ফেরিঘাট টার্মিনাল, ফুলছড়ি, গাইবান্ধা’

দেখতে দেখতেই রিকশা দাঁড়াল ব্রহ্মপুত্র নদের ঘাটে। সেখানে দাঁড়াতেই মন হারিয়ে গেল ২৬ কিলোমিটার দূরে ওপারের জামালপুরে। ওদিক থেকে বাতাস আসছে। বাতাস তো নয় যেন এক সহনীয় মাত্রার ঝড়। তাতে মাথার চুল থেকে জামা কাপড়—সবকিছু যেন পতাকার মতো পতপত করে উড়ছে।

জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাটের কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। শুধু চোখে পড়ছে শেষ বিকেলের রংধনু। যেন জামালপুরের রংধনু। এ দৃশ্য থেকে চোখ ফেরানো যায় না, কিন্তু এত সুন্দর বেশিক্ষণ চোখে সহ্য হলো না। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা নদীর ঘাট থেকে আমাদের তাড়া করল। দৌড়ে এসে ঢুকলাম এক জুতার দোকানে। তার সামনেই ফেরিঘাট টার্মিনাল। দোকানের ভেতর থেকেই সবকিছু দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে বুটভাজা খেতে খেতে দোকানির সঙ্গে হচ্ছিল এই ফেরিঘাট টার্মিনালের গল্প।

বালাশীঘাটের মতোই আরেকটি টার্মিনাল বানানো হয়েছে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাটে। খরচ হয়েছে প্রায় ১৪৫ কোটি টাকা। কিন্তু জুতার দোকানির দুঃখ হচ্ছে, এই গেটের দরজা এক দিনও খোলা হয়নি। গেটের এক পাশে রয়েছে টোল বুথ। সেই বুথে কোনো দিনও একটি টাকা জমা পড়েনি।

বালাশীঘাটের মতোই আরেকটি টার্মিনাল বানানো হয়েছে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাটে। খরচ হয়েছে প্রায় ১৪৫ কোটি টাকা। কিন্তু জুতার দোকানির দুঃখ হচ্ছে, এই গেটের দরজা এক দিনও খোলা হয়নি। গেটের এক পাশে রয়েছে টোল বুথ। সেই বুথে কোনো দিনও একটি টাকা জমা পড়েনি।

শাহাবুল শাহীনের মুখে শুনলাম, ‘মানুষ এই টার্মিনাল ঘিরে স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁরা অল্প সময়ে ঢাকায় যেতে পারবেন। এখন তাঁদের যমুনা সেতু হয়ে বাসে ঢাকায় যেতে সময় লাগে সাত থেকে আট ঘণ্টা। আর ট্রেনে ৯ থেকে সাড়ে ৯ ঘণ্টা। আর বালিশীঘাট-জামালপুর হয়ে গেলে থেকে সর্বোচ্চ চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে তাঁরা ঢাকায় গিয়ে পৌঁছাতে পারবেন। সেই সঙ্গে এখানে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

ইতিহাসের পাতায় ঢুঁ মেরে দেখা গেল, ১৯৩৮ সালে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার রেল যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে গাইবান্ধার তিস্তামুখ ঘাটে রেল ফেরি সার্ভিস চালু করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৯০ সালে যমুনা নদীর নাব্য কমে যাওয়ায় ফেরি সার্ভিসটি তিস্তামুখ ঘাট থেকে বালাশীঘাটে স্থানান্তর করা হয়।

বিশ্বের অন্যতম ব্যতিক্রমী একটি রেল ফেরি সেবার মাধ্যমে পুরো ট্রেন নদী পার করা হতো। রেলওয়ে ফেরির ১৩টি লাইনে প্রতি লাইনে ৩টি করে ছোট বগি বা ওয়াগন বহন করার সুবিধা ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে বালাশীঘাট ব্রিটিশদের মালামাল পরিবহনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

জামালপুরের আকাশে রংধনু। ছবিতে লেখক।

উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য একসময় ময়মনসিংহ, সিলেট, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ রাজধানী ঢাকার সঙ্গে রেল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল বালাশী-বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট। কিন্তু নাব্য-সংকট ও যমুনা নদীর গতিপথ বদলে যাওয়ায় ২০০০ সালে থেকে এই ঘাট দিয়ে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৫ সালের দিকে নৌযানগুলোও বিক্রি করে দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়ে অতিরিক্ত যানবাহনের চলাচলের চাপ লাঘবের জন্য সেতুটির ধারণক্ষমতা নিয়ে আশঙ্কা সৃষ্টি হওয়ায় বিকল্প পথ তৈরির যুক্তি দেখিয়ে বালাশী ও বাহাদুরাবাদে ফেরিঘাট চালুর লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।

২০১৬ সালে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রধানের নেতৃত্বে নৌ, সড়ক, স্থানীয় সরকার, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রেল ও বিআইডব্লিউটিএর প্রতিনিধিরা এলাকাটি পরিদর্শন করেন। পরে পরিকল্পনা কমিশনে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হয়।

এরপর বালাশীঘাটে বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ, পুলিশ ব্যারাক, ফায়ার সার্ভিস, গেস্টহাউস, আনসার ব্যারাকসহ বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। একই অবকাঠামো নির্মাণ করা হয় বাহাদুরাবাদে।

এসব অবকাঠামো নির্মাণের পর বিআইডব্লিউটিএর কারিগরি কমিটি হঠাৎ করে নাব্যতা-সংকট ও ২৬ কিলোমিটার বিশাল দূরত্বের নৌপথসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে ২০২১ সালের জুনেই নৌ রুটটি নৌযান চলাচলের অনুপযোগী ঘোষণা করে। তবু দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো পরের বছর এপ্রিলে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ থেকে গাইবান্ধার বালাশীঘাট পর্যন্ত নৌপথে পরীক্ষামূলক লঞ্চ চলাচলের উদ্বোধন করেন তৎকালীন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। ৯ মাস পরে তা-ও বন্ধ হয়ে যায়।

এই টার্মিনাল যেন ঘোড়ার আগেই চাবুক কেনার মতো হয়েছে। এখন এ নিয়ে সরকারের অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, তা জানার জন্য স্থানীয় ইউএনওকে ফোন করলাম।

সদাশয় কর্মকর্তা একটি ফোন নম্বর দিয়ে বিআইডব্লিউটিএর এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে বললেন। তিনি ফোন ধরে বলেন, তিনি রাইট পারসন নন, নির্বাহী প্রকৌশলী এ ব্যাপারে কথা বলতে পারবেন। তিনিও তাঁর ফোন নম্বর দিলেন।

এবার নির্বাহী প্রকৌশলী বললেন, সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী এ দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন না। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলার জন্য একটা ফোন নম্বরও দিলেন। সেই ফোনে লাগাতার তিন-চার দিন একনাগাড়ে চেষ্টা করেও তাঁর নাগাল পাওয়া গেল না। তিনি ফোনই ধরেন না।

সপ্তাহখানেক পর প্রথম আলোর সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আরিফুল গণির শরণাপন্ন হলাম। তিনিও ফোনে না পেয়ে সরাসরি অফিসে গেলেন। তিনি গিয়ে শুনলেন, সেখানে নির্বাহী প্রকৌশলীর কোনো পদই নেই। তবে ওই অফিসে একজন যুগ্ম পরিচালকের পদ আছে। তিনি আবার অফিসের বাইরে চলে গেছেন। তবে কর্মচারীরা আশ্বাস দিলেন, স্যার ভালো মানুষ, ফোন ধরবেন। সত্যিই তিনি ফোন ধরলেন।

তবে বললেন, বালাশীঘাটের দায়িত্বে রয়েছেন কুড়িগ্রামের উপপরিচালক রবিউল ইসলাম। এবার তাঁর ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বললেন, তাঁর তো বদলির আদেশ হয়েছে। তিনি চলে যাচ্ছেন।

কিছু জানতে হলে বাঘাবাড়ী অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাঁর নাম সঞ্জয় দেবনাথ। অবশেষে মুঠোফোনে সঞ্জয় দেবনাথের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তিনি বলেন, তথ্যের জন্য আপনাকে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করতে হবে।

এ বিষয়ে আর আবেদন করার ধৈর্য রইল না। কেবলই বালাশীঘাটের একজন লোকের কথাই মনে পড়তে লাগল। তিনি তাঁদের ফেরি টার্মিনাল নিয়ে মনের খেদে বলছিলেন, ‘জামালপুরের আকাশে রংধনু দেখছেন না, এই উন্নয়ন হচ্ছে রংধনুর মতো। ধরাও যাবে না, ছোঁয়াও যাবে না। কাজেও লাগবে না। শুধু দেখা যাবে।’

  • আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রথম আলো, রাজশাহী