বিজয়ের মাস

বীরাঙ্গনাদের কথা আমরা কি ভুলে গিয়েছি

বাংলাদেশের মতো অন্যান্য দেশের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নারীরা অবদান রেখেছেন নানাভাবে তাঁদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেসব দেশ তাঁদের নারী যোদ্ধাদের কীভাবে সম্মান জানিয়েছে, তা কি আমরা খোঁজ নিয়েছি কখনো? দেশের স্বাধীনতার জন্য অপূরণীয় ত্যাগ স্বীকার করা এসব মানুষকে কীভাবে উপযুক্ত সম্মান দেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে লিখেছেন ইপ্সিতা কাজুড়ী ও ইশরাত জাকিয়া সুলতানা

তেজকুনিপাড়ার একটি বস্তিতে বাস করেন তিনি। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দূরে থাক, ন্যূনতম প্রয়োজনই পূরণ করা কঠিন—এ রকম একটি পরিত্যক্ত জীর্ণ কুটির তাঁর ঠিকানা। দুশ্চিন্তায় কাটে তাঁর প্রতিটি দিন।

অন্যরা না জানলেও এ দেশের লাল-সবুজ পতাকা তাঁর পরিচয় ঠিকই জানে। এখন আর তিনি নিজেকে নিয়ে খুব একটা ভাবেন না। কিন্তু ‘স্বাধীনতা’, ‘বিজয়’—এসব শব্দ মাঝেমধ্যে তাঁকে কিছু প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।

এই নারী একজন বীরাঙ্গনা। দেশের জন্য যিনি বিসর্জন দিয়েছেন নিজের সম্ভ্রম, হারিয়েছেন নিজের পরিবারকে। মানুষটির কি আজ বস্তিতে থাকার কথা? যুদ্ধে সর্বস্ব ত্যাগের প্রতিদান কি আমরা এভাবেই দিয়ে যাব?

তাঁর নাম পারভীন বেগম (ছদ্মনাম)। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাস করতেন ঢাকা শহরের পুরোনো বিমানবন্দর এলাকায়। ২৫ মার্চ রাতে হঠাৎ চারদিকে প্রচণ্ড আওয়াজ শুনতে পেয়ে বাইরের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিতে বের হন পারভীন বেগমের স্বামী, কিন্তু ঘরে ফেরেননি আর।

স্বামীর সন্ধান না পেয়ে পারভীন তাঁকে খুঁজতে বের হয়েছিলেন। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট তিনি ভালো করে চিনতেন না। অনেক খোঁজার পর একপর্যায়ে গাছপালায় ঘেরা এক জায়গায় এসে দেখতে পান, চার থেকে পাঁচজন পাকিস্তানি মিলিটারি মিলে তাঁর স্বামীকে প্রচণ্ড নির্যাতন করছে।

তিনি তাদের কাছে স্বামীর প্রাণভিক্ষা চেয়ে অনুনয়-বিনয় করলে পাকিস্তানি মিলিটারিরা তাঁকে ‘কুপ্রস্তাব’ দেয়। রাজি না হলে তারা জোর করে তাঁকে মারধর করে। একপর্যায়ে তিনি চেতনা হারান। জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারেন তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন, পাশে দেখতে পান তাঁর স্বামীর গুলিবিদ্ধ মরদেহ।

কোনোমতে বাসস্থানে ফিরে যাওয়ার পর পারভীন প্রতিবেশীদের জানান তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্মম অত্যাচারের কাহিনি। কিন্তু প্রতিবেশী সবাই ঘটনা জেনে বিরূপ আচরণ শুরু করেন। একপর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে তিনি সেই ঠিকানা ছেড়ে বের হয়ে পড়েন অজানার উদ্দেশ্যে।

পথে যেতে যেতে চারদিকে নৃশংস ঘটনা ঘটতে দেখে ভয়ে প্রাণরক্ষার জন্য তিনি একটি গর্তে আত্মগোপন করে ছিলেন। এভাবে অনেক দিন কিছু না খেয়ে সেখানেই লুকিয়ে থাকেন। কিছুদিন পর চাল ধোয়া জল জোগাড় করতে পারেন খাওয়ার জন্য।

আজও পারভীন বেগমের মতো এমন আরও অনেক বীরাঙ্গনার ঠাঁই বস্তিতে, তা কি বাংলাদেশ সরকার জানে? একটি স্বাধীন দেশের বীরাঙ্গনাদের যদি নিজের দেশের মানুষেরাই প্রাপ্য সম্মানটুকু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও দিতে না পারে, তাহলে আদৌ কি মননে-চেতনায় আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি?

বিগত সরকার ব্যস্ত ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঝান্ডা হিসেবে ব্যবহার করার কাজে। তাই হয়তো সময় পায়নি বস্তিতে কিংবা মানবেতরভাবে বাস করা বীরাঙ্গনাদের জন্য মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই, তিন বেলার খাবার, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ইত্যাদির বন্দোবস্ত করে দিতে। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে গড়ে উঠল যে অন্তর্বর্তী সরকার, তার মনোযোগ কি পাবেন বাংলাদেশের সেই সব বীরাঙ্গনা, যাঁরা সম্মান দূরে থাক, বেঁচে থাকতেই হিমশিম খাচ্ছেন পাঁচ দশক ধরে?

বাংলাদেশের মতো অন্যান্য দেশের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নারীরা অবদান রেখেছেন নানাভাবে তাঁদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেসব দেশ তাঁদের নারী যোদ্ধাদের কীভাবে সম্মান জানিয়েছে, তা কি আমরা খোঁজ নিয়েছি কখনো?

ডেবোরাহ স্যাম্পসন ছিলেন মার্কিন সামরিক বাহিনীতে যুদ্ধ করা প্রথম নারীদের একজন। তিনি ১৭৮১ সালে পুরুষের ছদ্মবেশে আমেরিকান বিপ্লবের সময় সৈনিক হিসেবে যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করেছিলেন। তাঁর শহরের পাবলিক লাইব্রেরির বাইরে তাঁর এই অদম্য সাহসিকতা ও দেশপ্রেমকে সম্মান জানিয়ে একটি মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে।

১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের লিনা হিগভি ১৯ জন নার্স নিয়ে মার্কিন নেভির প্রথম নার্স দল গঠন করেন। তিনি দলের প্রধান হিসেবে তাঁর দলের অন্য সদস্যদের নিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন রণক্ষেত্রে আহত ব্যক্তিদের সেবার পাশাপাশি স্থানীয় নার্সদেরও বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। মার্কিন নৌবাহিনী ১৯৪৫ সালে হিগভির সম্মানে তাদের একটি যুদ্ধজাহাজের নামকরণ করে ইউএসএস হিগভি এবং লিনা হিগভিকে পরবর্তী সময় মার্কিন নেভির সর্বোচ্চ সম্মান ‘নেভাল ক্রস’–এ ভূষিত করেন।

মার্থা নোকার্ট ছিলেন একজন বেলজিয়ান নার্স, যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্য ও এর মিত্রদের জন্য গুপ্তচর হয়েছিলেন। তিনি একটি জার্মান গোলাবারুদ ডিপোর নিচে অবস্থিত এক অব্যবহৃত নর্দমা সুড়ঙ্গব্যবস্থা আবিষ্কার করেন এবং গোলাবারুদের ডাম্প ধ্বংস করার জন্য বিস্ফোরক স্থাপন করেন। নোকার্টকে তাঁর গুপ্তচরবৃত্তির কাজের বীরত্বের জন্য ব্রিটিশ, ফরাসি ও বেলজিয়ান সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল।

১৯৭২ সালে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের ফটোসাংবাদিক নিক উটের তোলা অনেকের সঙ্গে তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে নগ্ন হয়ে দৌড়ানো ৯ বছরের কন্যাশিশুটির কথা অনেকের মনে আছে হয়তো। ঘটনাটি ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রের নাপাম বোমা নিক্ষেপের কারণে। ছবিটি আলোড়ন তুলেছিল সারা বিশ্বে।

ছবির সেই ছোট্ট বালিকা ভিয়েতনামের ফান থি কিম ফুকের শরীরের ক্ষতগুলো এতটাই গুরুতর ছিল যে চিকিৎসকেরা ভেবেছিলেন তিনি বাঁচবেন না। ১৯৯৪ সালের ১০ নভেম্বর  ফুককে ‘ইউনেসকো গুডউইল অ্যাম্বাসাডর’ হিসেবে মনোনীত করা হয়। পরবর্তী সময় ফুক ইউনেসকোর সঙ্গে তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং শান্তির জন্য একজন কর্মী হিসেবে ২০১৯ ড্রেসডেন শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন।

পশ্চিমা দেশগুলো, এমনকি ভিয়েতনামের মতো এশীয় দেশও যদি তাদের দেশের যুদ্ধে নারীদের অবদানকে এত স্বীকৃতি দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যেখানে নারীর সম্মান ঐতিহ্যের অংশ; সেই দেশে কেন পারভীন বেগমদের মতো বীরাঙ্গনারা এত অবহেলিত?

সরকারি সূত্রে, ২০২২ সালের ২৪ মে পর্যন্ত দেশে গ্যাজেটভুক্ত বীরাঙ্গনাদের মোট সংখ্যা ৪৪৮। অথচ সরকারি হিসাব অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্যাচারিত নারীর সংখ্যা ২ লাখের কাছাকাছি (অন্তত এত দিন তা-ই বলা হতো)।

২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে বীরাঙ্গনাদের জন্য সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা শ্রেণিতে মাসিক ২০ হাজার টাকা করে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। এটি কি বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী একজন মানুষের জন্য পর্যাপ্ত?

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পর ২০১৫ সালে প্রজ্ঞাপন জারির মধ‍্য দিয়ে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার প্রদানের সরকারি কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২১ সালে প্রকাশিত টিআইবির প্রতিবেদনে জানা যায়, গেজেটভুক্তির আবেদন থেকে শুরু করে গেজেটভুক্তি সম্পন্ন হওয়ার জন্য সর্বোচ্চ কত দিন সময় লাগবে, তার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করা নেই কোথাও। গেজেটভুক্তির পর ভাতাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ।

বীর নিবাসে ঘরের জন‍্য আবেদন করলে তা পেতেও দীর্ঘ সময় ব‍্যয় হয়। কোথায়, কীভাবে তাঁরা দিন কাটান এই অপেক্ষার সময়ে, সেটি কি রাষ্ট্র ভেবেছে? গেজেটভুক্তির এই বিভিন্ন ধাপে প্রতিনিয়ত অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হতে হয় বীরাঙ্গনাদের। প্রক্রিয়াগত এই দীর্ঘসূত্রতা ও অনিয়ম-দুর্নীতি সামাজিক পরিসরেও বীরাঙ্গনাদের জন‍্য জটিলতার সৃষ্টি করে।

সরকার বীরাঙ্গনাদের গেজেটভুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় পর্যায়ে বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিত করার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। উপজেলা পর্যায়ে বীরাঙ্গনাদের গেজেটভুক্তির প্রক্রিয়া সামগ্রিকভাবে পরিচালনার জন‍্য বিশেষভাবে কেউ দায়িত্বপ্রাপ্ত নন।

মুক্তিযুদ্ধের পর কেন্দ্রীয় বা স্থানীয়ভাবে বীরাঙ্গনাদের কোনো তালিকা সংরক্ষণ করা হয়নি। অথচ বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করা এবং তাঁদের নির্যাতনের ঘটনা লিপিবদ্ধ করা জরুরি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন করার যে উদ্যোগ, সেখানে অবশ্যই বীরাঙ্গনাদের কথা থাকতে হবে। দেশের স্বাধীনতার জন্য অপূরণীয় ত্যাগ স্বীকার করা এসব মানুষকে খুঁজে বের করা ও তাঁদের উপযুক্ত সম্মান প্রদানের জন্য প্রশাসনে সঠিক দিকনির্দেশনা রয়েছে কি?

মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় বীর হিসেবে পরিচিত করা হলেও বীরাঙ্গনাদের নিয়ে আজ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এসেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট অনেকাংশে নীরব। তাই দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে থাকা বা পরিচয় প্রকাশে সংকোচ করা এসব মানুষ আজও নিজেদের পরিচয় গোপন রাখার চেষ্টা করেন।

সামাজিক সংবেদনশীলতার অভাবে সৃষ্ট আমাদের নেতিবাচক মনোভাব থেকে বীরাঙ্গনা, তাঁদের পরিবার-পরিজন এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষদের সচেতন করার জন‍্য স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আজও সমাজের উচ্চপর্যায় থেকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেই। এমনকি স্বীকৃতিপ্রাপ্তির পরও বীরাঙ্গনা ও তাঁদের পরিবারকে হেনস্তার শিকার হতে হয়। তাঁদের আমরা কোনো অনুষ্ঠানে প্রধান বা বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানাই না।

অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন লুকিয়ে রাখা নির্যাতনের এই ঘটনা ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পাওয়ায় বীরাঙ্গনাদের মধ্যে একধরনের জড়তা ও দ্বিধা কাজ করে। এই পরিস্থিতিতে বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় অধিকার প্রদানের জন্য তাঁদের সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসা জরুরি।

আজ যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আরও একবার নতুন করে ফিরে দেখা হচ্ছে, তখন আমাদের উচিত, আর কালক্ষেপণ না করে এসব বীরাঙ্গনাকে যোগ্য সম্মান দেওয়া, স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে তাঁদের কথা উল্লেখ করা, তাঁদের স্মরণে স্মৃতিফলক-তোরণ নির্মাণ করা, যেন তাঁদের বীরত্বগাথা আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যায়। বীরাঙ্গনাদের ঋণ শোধ করা না গেলেও তাঁদের জীবদ্দশায় সম্মান জানাতে যেন আমরা কার্পণ্য বা বিলম্ব না করি।

  • ইপ্সিতা কাজুড়ী শিক্ষার্থী ও গবেষণা সহকারী এবং ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা শিক্ষক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়