মতামত

এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের টেলিযোগাযোগব্যবস্থা

২৬ অক্টোবর মহাখালীর খাজা টাওয়ারে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে
ছবি: সংগৃহীত

এক পায়ে নূপুর আর অন্য পা খালি রাখার গান আমরা শুনেছি। তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার ছড়াও আমরা ছন্দে ছন্দে পড়েছি। কিন্তু দেশের টেলিযোগাযোগব্যবস্থা যে এক টাওয়ারে ভর করে তালগাছের মতোই দাঁড়িয়ে ছিল, সেটি আমরা জানতে পারলাম ২৬ অক্টোবর মহাখালীর খাজা টাওয়ারে আগুন লাগার পর।

মুঠোফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটব জানিয়েছে, খাজা টাওয়ারে ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) থাকার কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মোবাইল অপারেটরদের একে অপরের মধ্যে ভয়েস কলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে।

অপর দিকে ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএসপিএবি বলেছে, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবার প্রায় ৭০ শতাংশ প্রদানকারী দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ব্যান্ডউইডথ আসত খাজা টাওয়ারের দুই ডেটা সেন্টার থেকে। যেহেতু ডেটা সেন্টারগুলো বন্ধ হয়েছে, তাই ইন্টারনেট সেবায় বিঘ্ন হচ্ছে (প্রথম আলো, ২৬ অক্টোবর ২০২৩)। 

অপর দিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী একই ভবনে এত বেশি পরিমাণ সংযোগ সেবা প্রদানের যন্ত্রপাতি থাকার কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাঁর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই ভবনে আটটি আইআইজি, দুটি আইসিএক্স, দুটি আইএসপির সরাসরি অফিস, বাইরের আরও ৫০০ আইএসপি বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ডেটা ছিল। এই প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারিভাবে পরিচালিত উল্লেখ করে তিনি এর দায় মূলত ভবনমালিক এবং যাঁরা ঝুঁকি বিবেচনা না করে সেখানে তাঁদের দামি যন্ত্রপাতি বসিয়েছেন, তাঁদের ওপর দিয়েছেন। (বিবিসি বাংলা, ২৭ অক্টোবর ২০২৩)

আমাদের দেশ থেকে অন্য দেশে পণ্য সরবরাহ করতে হলে যেমনটি কোনো না কোনো বন্দর দিয়ে গেট পার হয়ে অন্য দেশে প্রবেশ করতে হয়, আমাদের ডেটাও দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক সীমানায় যেতে হলে কোনো না কোনো গেট অতিক্রম করতে হয়। লাইসেন্সপ্রাপ্ত এই বন্দর বা গেট কর্তৃপক্ষই ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে বা আইআইজি।

আবার দেশের ভেতরে যাতায়াতে সীমান্ত পার হওয়ার দরকার হয় না। রংপুর থেকে চট্টগ্রাম যেতে চাইলে মাঝখানে কমলাপুর জংশনে (এক্সচেঞ্জ) ট্রেন পরিবর্তন করে নিলেই হবে। একইভাবে এক টেলিকম অপারেটর থেকে অন্য টেলিকম অপারেটরে কথা বলতে হলে যে এক্সচেঞ্জের মধ্য দিয়ে ডেটাগুলো যেতে হয়, সেগুলো হলো ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ বা আইসিএক্স। 

সবচেয়ে বড় কথা হলো এত গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা ব্যবস্থা একটি টাওয়ার, একটি এলাকা কিংবা একটি–দুটি প্রতিষ্ঠানে ওপর কোনোভাবেই এত বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল থাকা উচিত নয়। বস্তুত, কোনো একটি সিস্টেম বন্ধ হয়ে গেলে ব্যাকআপ সিস্টেমকে যত শিগগির দ্রুততার সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠা উচিত, যাতে ব্যবহারকারীরা বুঝতেই না পারেন যে কোনো একটি সিস্টেম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন প্রযুক্তিগত কারণ ও বাস্তবতার বিচারে এটি পুরোপুরি সম্ভব না হলেও, লক্ষ্য হিসেবে সাধারণত এটিই নির্ধারিত করা হয়।

অতএব বলা চলে এই আইআইজি, আইসিএক্স বা সমজাতীয় এসব ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের টেলিযোগাযোগব্যবস্থা। সংগত কারণেই আগুন লাগার ঘটনার কয়েক দিন পরও সবকিছু আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি। লাইসেন্সপ্রাপ্ত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনার দায় হয়তো তাদের, কিন্তু তারা নিয়ম মেনে সেটি পরিচালনা করছে কি না, সেটি পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব তো কারও না কারও ওপর ন্যস্ত থাকতে হবে।

এই সিস্টেমগুলোর জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্যোগ-পরবর্তী পুনরুদ্ধার (ডিজাস্টার রিকভারি), সংকট ব্যবস্থাপনা (ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট), ব্যাকআপ সিস্টেম, জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহ, অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ইত্যাদি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত রীতি অনুসরণ করার কথা। আবার এগুলোর প্রায় সব কটি বাদ রেখেও পরিষেবা প্রদান শুরু করে দেওয়া যায়। 

শুধু ব্যবসায়িক দিক চিন্তা করলে প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত খরচ করতে না–ও চাইতে পারে। তা ছাড়া যখন দেখে বিদ্যমান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলো এগুলো অনুসরণ না করেই হরদম ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্যরা নিয়মরীতি না মেনেই ব্যবসা পরিচালনা করতে চাইবে। তদারককারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ঠিক এই জায়গাটাতেই গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্যপ্রযুক্তি অডিট (আইটি অডিট) নামের আলাদা একটি ধারাই এখন চালু আছে। একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তি পরিকাঠামো, অ্যাপ্লিকেশন, ডেটা ব্যবহার, ব্যবস্থাপনা, নীতি, পদ্ধতি ইত্যাদি স্বীকৃত মান বা প্রতিষ্ঠিত নীতিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, সেটি পরীক্ষা এবং মূল্যায়ন করাই তথ্যপ্রযুক্তি অডিটের উদ্দেশ্য।

লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এই অডিট করার দায়িত্বটা লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের ওপরই বর্তায়। স্বীকৃত রীতি অনুসরণ করা হলে, প্রাথমিক খরচ বেশি হলেও দিন শেষে সেটি সেবাগ্রহীতার ও সেবা প্রদানকারী উভয়ের স্বার্থই রক্ষা করে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো এত গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা ব্যবস্থা একটি টাওয়ার, একটি এলাকা কিংবা একটি–দুটি প্রতিষ্ঠানে ওপর কোনোভাবেই এত বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল থাকা উচিত নয়। বস্তুত, কোনো একটি সিস্টেম বন্ধ হয়ে গেলে ব্যাকআপ সিস্টেমকে যত শিগগির দ্রুততার সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠা উচিত, যাতে ব্যবহারকারীরা বুঝতেই না পারেন যে কোনো একটি সিস্টেম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন প্রযুক্তিগত কারণ ও বাস্তবতার বিচারে এটি পুরোপুরি সম্ভব না হলেও, লক্ষ্য হিসেবে সাধারণত এটিই নির্ধারিত করা হয়।

আমার স্কুলজীবনের এক সহপাঠীর চার ভাই-বোন। ঈদে বাড়ি যাওয়ার সময় দেখতাম, চার ভাই-বোনের দুজন একটি বাসে বাড়ি যাচ্ছেন, বাকি দুজন অন্য আরেকটি বাসে যাচ্ছেন। ঈদে যেখানে সবাই একসঙ্গে বাড়ি যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব থাকেন, সেখানে এই ভাই–বোনেরা কেন দুই ভাগে ভাগ হয়ে বাড়ি যাচ্ছেন, সেটি নিয়ে অনেকেরই জানার আগ্রহ ছিল। মূলত তাঁদের মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী আয়োজনটি করতে হতো।

পথে যদি অপ্রত্যাশিত কোনো কিছু ঘটে, তাহলে একসঙ্গে যেন চার ছেলেমেয়ে দুর্ঘটনার শিকার না হয়ে যান, সে জন্যই মায়ের এ নির্দেশনা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের টিনের ঘরে বাস করা এক মা যদি ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট অব ফেইলিওর’ (একটি অংশের দুর্বলতায় সম্পূর্ণ অংশ অকার্যকর হওয়া) নিয়ে চিন্তা করে ফেলতে পারেন, আমরা কেন সুউচ্চ টাওয়ারে বসেও সেই চিন্তা করতে পারি না?

ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক

ebmmainul@du.ac.bd