চট্টগ্রাম শহরের আলমাস সিনেমার সামনে তিন রাস্তার মোড়ে চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়ানো এবং ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা আবর্জনার ভাগাড়টি এখন আর নেই।
কয়েক মাস বিদেশে থাকার পর দেশে এসে প্রতিদিনের অফিস আসা–যাওয়ার পথে এই মোড়ে আসার আগেই নাক অভ্যাসবশত চেপে ধরেছি। কিন্তু কাছে এসে দেখি, একি! সব ঝকঝকে, তকতকে। ওখানে কোনো আবর্জনা নেই। নিজের শহরের একটা জায়গায় এমন ইতিবাচক পরিবর্তনে মনটা সুবাসিত হয়ে উঠেছে।
মনে মনে ভাবলাম, আহা, বিদেশ থেকে এসে যদি দেখতাম পুরো শহরই এমন বদলে গেছে! না, সেটা হয়নি। দু-এক দিন আগে মোমিন রোডে কদম মোবারক স্কুলের গলির পুরোটাই আবর্জনার স্তূপ।
ঐতিহ্যবাহী কদম মোবারক মসজিদের গেটে ময়লা মাড়িয়ে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা নামাজ পড়তে যান। শত শত কিশোর শিক্ষার্থী এই ময়লার ওপর দিয়ে হেঁটে স্কুলে যায়। গলিটাকে অনেকেই প্রেসপাড়া বলে। কারণ, এই গলিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছাপাখানা, কাগজ কাটিং, বুক বাইন্ডিংসহ মুদ্রণশিল্পের প্রতিষ্ঠান। একটি পত্রিকা অফিসও আসে সেখানে। আাবাসিক ভবনও আছে প্রচুর। একটা আবর্জনাভর্তি গলি শত শত মানুষের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে আছে।
কদম মোবারক মসজিদের গলির মতো ১৫৫ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের চট্টগ্রাম মহানগরের বহু সড়ক, অলিগলি, মোড়ের এ অবস্থা। বাংলাদেশের অর্থনীতি, শিল্প–বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বন্দরনগরীর জনজীবনের এই ঘোরতর সমস্যার কথা এখন সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। এখানে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার টনের মতো বর্জ্য তৈরি হয়। এই বর্জ্য যথাযথভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে না।
এ সমস্যার সমাধানও করা সম্ভব হচ্ছে না কেন, তা খুঁজে বের করা দরকার। এলাকাভিত্তিক সমাধান ছাড়াও কর্ণফুলী, খালসহ অন্যান্য জলাশয় ও পাহাড়ের কথা বিবেচনায় এনে পুরো মানচিত্র সামনে রেখে এর সমাধান খোঁজা দরকার। কেননা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রতিদিন সৃষ্ট বর্জ্যগুলোর সবটুকু সংগ্রহ করতে পারে না। অনেক বর্জ্য সড়কে, খালে বা খোলা জায়গায় জমতে থাকে। তাতে পরিবেশ হয়ে ওঠে বিষময়।
নগরের জনসংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার জনসংখ্যা প্রায় ২৯ লাখ ২৮ হাজার। তবে শহরতলিসহ বৃহত্তর মহানগর এলাকায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ বলে ধারণা করা হয়।
একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে শূন্য দশমিক ৬ কেজি বর্জ্য উৎপন্ন করেন। জনসংখ্যা যদি কম করে হলেও ২৯ লাখ হয়, তবে সেটি পরিবেশের কী ক্ষতি করছে, তা ভাবতে গেলে ভবিষ্যৎ চট্টগ্রামের এক ভয়াবহ চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আলমাস সিনেমার সামনের অংশ যেভাবে পরিষ্কার হয়ে গেল, ঠিক সেভাবে পুরো শহরের কথা ভাবতে হবে।
আপাতদৃষ্টে এটি অসম্ভব মনে হলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও আন্তরিকতা থাকলে অসাধ্য কিছু নয়। কারণ, সম্প্রতি এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, শহরের মোট বর্জ্যের প্রায় ৭৩ শতাংশই পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক। অর্থাৎ প্লাস্টিক যদি আমরা পুনর্ব্যবহার করতে পারি, তবে বর্জ্য সমস্যার অনেকাংশ সমাধান হবে। কিন্তু পরিকল্পনা ও প্রযুক্তির অভাবে এই প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে সন্তানের কাছে গিয়েছিলাম বেড়াতে। এর আগেও দেশটিতে যাওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলা দেখে আমি শুধু হতাশ হতাম। ভাবতাম, আমাদের দেশে কেন এমন করতে পারে না?
এদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি সুসংগঠিত প্রক্রিয়া, যেখানে সরকারি নীতি, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, বেসরকারি খাত এবং নাগরিকদের অংশগ্রহণ—সব মিলেই গড়ে উঠেছে এক কার্যকর ব্যবস্থা। অথচ তাদের দেশের নাগরিকেরা প্রতিদিন আমাদের চেয়ে বেশি বর্জ্য উৎপন্ন করে থাকে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে কোথাও ময়লা দেখা যায় না। প্রতিটি বাড়ি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও অফিস–আদালত সারা সপ্তাহ ধরে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদাভাবে জমা রাখে। ঘরে ঘরেই বর্জ্য আলাদাকরণের কাজটি সম্পন্ন হয়ে যায়।
সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন ঘরের সামনে থেকে বড় বড় ড্রাম সাইজের বিন থেকে কর্তৃপক্ষের গাড়ি এসে নিয়ে যায়। ওখানে বর্জ্য সঠিকভাবে পৃথক্করণ, পুনর্ব্যবহারের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। ওখানে গড়ে প্রায় ৩২ শতাংশ বর্জ্য পুনর্ব্যবহার বা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য উপাদানে রূপান্তরিত হয়, ১২ শতাংশ পোড়ানো হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আর বাকি অংশ নিরাপদভাবে মাটিচাপা দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতি রয়েছে। তবে পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা সার্বিকভাবে দেখভাল করে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ওদের মূলমন্ত্র হলো বর্জ্য কমাও, পুনর্ব্যবহার করো এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করো। পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ থেকে উৎপাদিত হয় নতুন কাঁচামাল আর খাদ্যবর্জ্য থেকে তৈরি হয় জৈব সার ও বায়োগ্যাস। ইদানীং সিয়াটল ও সান ফ্রান্সিসকোর মতো কোনো কোনো শহর এখন নাকি জিরো ওয়েস্ট নীতি অনুসরণের পরিকল্পনা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই উন্নত ব্যবস্থাপনা নিশ্চয় এক দিনে গড়ে ওঠেনি। সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কঠোর নজরদারির কারণে ব্যবস্থাগুলো এখন মানুষের চির অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশে রাতারাতি হয়ে যাবে তা নয়, কিন্তু ভালো কিছু শুরু তো করতে হবে। আমরা হতাশ হতে চাই না। আমরা চাইলে যে পারি, তার উদাহরণ এ প্রতিবেদনের শুরুতেই দিয়েছি। এ জন্যই আমি আশাবাদী। এর কিছু কার্যকারণও আছে।
সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ‘বর্জ্যনির্ভর গ্যাস উৎপাদন প্রযুক্তি’ নামে একটি প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে বর্জ্য থেকেই উৎপাদিত হবে ব্যবহারযোগ্য গ্যাস। অন্যদিকে ইউনিলিভার বাংলাদেশ, ওয়াইপিএসএ ও সিটি করপোরেশনের যৌথ উদ্যোগে শহরে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহার কার্যক্রম চলছে—ইতিমধ্যে ২৪ হাজার টনের বেশি প্লাস্টিক নতুন চক্রে ফিরেছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকার সহায়তায় শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পরিকল্পনার কাজও এগোচ্ছে। এখন শুধু একটাই আশঙ্কা—এসব প্রকল্প মাঝপথে থেমে যাবে না তো? আমরা পোড়া গোয়ালের গরু। তাই ভয় আমাদের বেশি। কিন্তু আমরা পাহাড়, হ্রদ আর সমুদ্রের চট্টগ্রাম শহরকে নান্দনিক শহর হিসেবে দেখতে চাই। এর ভবিষ্যৎ সুন্দর করতে হলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে দাঁড় করাতেই হবে।
এর জন্য কিছু মৌলিক পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন বর্জ্য পৃথক্করণ বাধ্যতামূলক করা; আধুনিক ও নিরাপদভাবে কিছু বর্জ্য মাটিচাপা দেওয়া এবং পুনর্ব্যবহারকেন্দ্র গড়ে তোলা। সবচেয়ে বড় কথা, যাঁরা এই বর্জ্য প্রতিদিন তৈরি করছেন, তাঁদের সচেতন করা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোরভাবে নিয়ম বা আইনের প্রয়োগ করতে হবে। প্রশাসন, সাধারণ মানুষ, সরকারি–বেসরকারি সংস্থাগুলো সবাই মিলে একসঙ্গে এগিয়ে এলে একদিন চট্টগ্রাম সত্যিকার অর্থে সবুজ ও পরিচ্ছন্ন নগরে পরিণত হবে। আমাদের বর্জ্যগুলো পরিণত হোক নতুন এক শক্তিতে।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক