Thank you for trying Sticky AMP!!

ট্রাম্প যখন ফৌজদারি মামলার আসামি

আদালতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ম্যানহাটন, ৪ এপ্রিল, ২০২৩

ঠিক ৫০ বছর আগে, এপ্রিল ১৯৭৩-এ ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবারের মতো ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হন। সে সময় তাঁর ও তাঁর পিতা ফ্রেড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তাঁরা ফেডারেল আইন লঙ্ঘন করে নিজেদের মালিকানাধীন অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া প্রদানে কৃষ্ণকায়দের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করছেন। আদালতের বাইরে আপস রফা করে তিনি সে যাত্রায় বেঁচে যান। প্রকৃতপক্ষে, এরপর এখন পর্যন্ত তিনি কয়েক হাজার মামলার মুখে পড়েছেন। প্রতিবারই জরিমানা দিয়ে অথবা আদালতের বাইরে আপস করে রক্ষা পেয়েছেন।

এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলো গতকাল মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল)। এদিন তিনি ম্যানহাটনের একটি আদালতে ফৌজদারি মামলার আসামি হিসেবে আত্মসমর্পণ করেন। হাতকড়া না থাকলেও সে সময় তিনি গ্রেপ্তার করা আসামি, অন্য সব আসামির মতো তিনি নিজের হাতের ছাপ দেন এবং পরে বিচারকের সামনে উপস্থিত হয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। পরবর্তী শুনানিতে যথাসময়ে উপস্থিত হবেন, এই শর্তে ছাড়া পেয়ে সেদিনই তিনি ফ্লোরিডায় তাঁর মার-আ-লাগো বাসভবনে ফিরে যান।

Also Read: পুতিন ও ট্রাম্পের সত্যিই কি বিচার হবে?

ঘটনাটি অভাবিত ও অভূতপূর্ব, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একজন প্রেসিডেন্ট, সাবেক অথবা ক্ষমতাসীন, ফৌজদারি মামলায় আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত হলেন। বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধে আরও আধা ডজনের মতো মামলা চলছে, যার মধ্যে একটি রাষ্ট্রদ্রোহী ও আরেকটি অতিগোপনীয় সরকারি নথিপত্র বেআইনিভাবে ব্যক্তিগত দখলে রাখার অভিযোগ। জর্জিয়ায় তৃতীয় আরও একটি মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে, সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে।

দুর্বল মামলা

অধিকাংশ পর্যবেক্ষক ধরে রেখেছিলেন এই তিন মামলার যেকোনো একটি মামলায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ফেঁসে যাবেন। হয়তো যাবেন, সে সম্ভাবনা এখনো প্রবল, কিন্তু তার আগে অপেক্ষাকৃত একটি দুর্বল মামলায় অভিযুক্ত হয়ে তিনি এখন ফৌজদারি মামলার আসামি। ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি এলভিন ব্রাগের আনা অভিযোগ অনুসারে, ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে স্টরমি ড্যানিয়েলস নামের একজন পর্নো তারকার সঙ্গে তাঁর গোপন প্রণয়ের খবর ফাঁস হওয়া ঠেকাতে তিনি ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার দিয়ে তাঁর মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করেন। এই কাজে তাঁকে সাহায্য করেন মাইকেল কোহেন নামে তাঁর দীর্ঘদিনের পুরোনো আইনজীবী।

আদালতের বাইরে ট্রাম্পভক্তদের বিক্ষোভ

শুধু স্টরমি ড্যানিয়েলস নন, প্লেবয় ক্লাবের একজন পরিচারিকার সঙ্গে একই রকম গোপন প্রণয়ের খবর ঠেকাতে তাঁকেও ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার উৎকোচ দিয়েছিলেন। একজন অজ্ঞাত পরিচয় নারীর গর্ভে তাঁর একটি অবৈধ সন্তান রয়েছে, এমন এক খবর ধামাচাপা দিতেও তিনি ৩০ হাজার ডলার ব্যয় করেন। এই দুই কাজে তাঁকে সাহায্য করেন ন্যাশনাল এনকোয়ারার নামের একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকার প্রকাশক ডেভিড প্যাকার। এই ঘটনার ভিত্তিতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মোট ৩৪-দফার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।

কংগ্রেসের সামনে মিথ্যা বলার অভিযোগে মাইকেল কোহেন জেলে গিয়েছিলেন। ফলে অনেকেই বলেছিলেন, যে মামলা তাঁর মতো মিথ্যাবাদীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে গঠিত, তা ধোপে টিকবে না। তদুপরি, নিজ পরিবারের সামনে অপদস্থ হওয়া এড়াতে যে কাজ ট্রাম্প করেছিলেন, তা অনৈতিক হলেও বেআইনি কিছু নয়। কিন্তু ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি এলভিন ব্রাগ সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করে দাবি করেছেন, এই ‘মুখবন্ধ’ অর্থের খবর সত্য গোপন করে রাখতে তা কোহেনের অ্যাটর্নি বাবদ ফি হিসেবে খাতাপত্রে দেখানো হয়, যা নিউইয়র্কের আয়কর ও আর্থিক নীতিমালার পরিপন্থী।

Also Read: ট্রাম্পকে জেলে পুরতে হবে এখনই, নয়তো কখনোই নয়

তার চেয়েও বড় কথা, এই কাজ ট্রাম্প করেছিলেন আরও বড় একটি অপরাধ ঢাকতে, আর তা হলো নির্বাচনের সামনে জনমত যাতে তাঁর বিপক্ষে না যায়, তা নিশ্চিত করা। এটি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ব্যয় নীতিমালার লঙ্ঘন। ট্রাম্পের সরাসরি নির্দেশে যে এই কাজ তিনি করেছেন, তার বিস্তর প্রমাণপত্র দিয়েছেন মাইকেল কোহেন, যার মধ্যে তাঁদের দুজনের কথোপকথন ও ট্রাম্পের স্বাক্ষরিত চেকের কপিও রয়েছে। ডেভিড প্যাকারের কাছ থেকেও উত্থাপিত অভিযোগের সমর্থনে সাক্ষ্য পাওয়া গেছে।

এই মামলার কাজ মাত্র শুরু হলো। শুনানি পর্ব শুরু হতে আরও প্রায় বছরখানেক লেগে যাবে। আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য হয়েছে আগামী ৪ ডিসেম্বর। আগামী সাত মাসে উভয় পক্ষ মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে। ট্রাম্পের আইনজীবীরা আশা করছেন, প্রাক্‌-বিচার পর্বেই তারা মামলাটি খারিজ করার আবেদন করবেন। আদালত সে আবেদন গ্রাহ্য না করলে আগামী বছর বসন্তে আনুষ্ঠানিক বিচারকার্য শুরু হতে পারে।

সন্দেহ নেই ট্রাম্প নৈতিকভাবে দেউলিয়াপ্রাপ্ত একজন রাজনীতিক। তা সত্ত্বেও রিপাবলিকান নেতৃত্ব ও দেশের এক-তৃতীয়াংশ নাগরিক তাঁর প্রতি যে কঠোর আনুগত্য প্রকাশ করেছেন, তা বিস্ময়কর।

এই মামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মহলে মহা তোলপাড় শুরু হয়েছে। নানা কারণে ট্রাম্প বিতর্কিত, তা সত্ত্বেও নিজ সমর্থকদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। তিনি নিজেকে শুধু নির্দোষ নয়, চলতি বাইডেন প্রশাসনের বিচার বিভাগের ষড়যন্ত্রমূলক আক্রমণের শিকার বলেও দাবি করেছেন। তাঁকে জেলে ঢোকালে দেশে আগুন জ্বলবে, এমন আগাম ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। দুই সপ্তাহ ধরেই তিনি ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি ও যে বিচারকের আদালতে তাঁর বিচার হবে, তাদের কঠোর ভাষায় আক্রমণ করে বক্তব্য দিয়েছেন। এলভিন ব্রাগকে তিনি ‘জানোয়ার’ বলেও গাল দিয়েছেন এবং তাঁর একটি ছবির সামনে বেসবল ব্যাট নিয়ে তাঁর মাথা থেঁতলে দেওয়ার অভিনয় করে ছবি বিলি করেছেন।

গতকাল আদালত তাঁকে সব ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য না দিতে সাবধান করে দেন। কিন্তু সে ধমকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে ট্রাম্প সেদিন রাতে মার-আ-লাগোতে ফিরেই একই ভাষায় দ্বিগুণ জোর দিয়ে আক্রমণাত্মক ভাষণ দেন। এই ভাষণের সময় সেখানে উপস্থিত তাঁর সমর্থকদের উল্লাস দেখে একজন ভাষ্যকার মন্তব্য করেছেন, এই লোকটা জেলে যেতে পারেন, আর তাঁর সমর্থকেরা পার্টি করছেন। এটি ঠিক বাস্তব কোনো ব্যাপার নয়, অতিবাস্তব।

আত্মসমর্পণ করতে আদালতে। ম্যানহাটন, যুক্তরাষ্ট্র।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

গত নভেম্বরে ট্রাম্প নিজেকে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এর ফলে অনিবার্যভাবেই তাঁর বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি রাজনৈতিক হয়ে পড়েছে। অনেকের ধারণা, চলতি তদন্তগুলোকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ প্রমাণের লক্ষ্যেই তিনি সবার আগে এবং এত লম্বা সময় আগে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেন।

ট্রাম্পের এই রণকৌশল কাজে লেগেছে বলেই মনে হয়। নিজ দলীয় সমর্থকদের মধ্যে তাঁর প্রতি সমর্থন আগের চেয়েও তুঙ্গে। অভিযোগপত্র গঠনের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর গত কয়েক দিনে ট্রাম্প তাঁর সমর্থকদের কাছে থেকে আট মিলিয়ন ডলারের বেশি চাঁদা সংগ্রহ করেছেন। নিউইয়র্কের আদালতে আত্মসমর্পণের পর আসামি হিসেবে তাঁর কোনো ছবি তোলা হয়নি। তা সত্ত্বেও আসামি হিসেবে তাঁর একটি জাল ছবি ব্যবহার করার মাধ্যমে গেঞ্জি বিক্রি করেও বিস্তর অর্থ কামিয়ে নিচ্ছেন তিনি। অন্য কথায়, এই ঘটনাকে দুর্ঘটনা বা বিপর্যয় না ভেবে ট্রাম্প ও তাঁর শিবির শাপে বর হিসেবেই দেখছে।

Also Read: ট্রাম্প যাচ্ছেন, কিন্তু ট্রাম্পিজম?

রাজনৈতিকভাবেও ট্রাম্প ফায়দা পাচ্ছেন। সবশেষ জনমত জরিপ অনুসারে এই মুহূর্তে দলের ৪৬ শতাংশ সমর্থক তাঁকেই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান। যেসব রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্পের প্রার্থিতা চ্যালেঞ্জ করবেন বলে দিনক্ষণ গুনছিলেন, তাঁরা এখন কিছুটা হলেও দমে গেছেন। এটি যে বাইডেন প্রশাসনের চক্রান্ত, ট্রাম্পের এই দাবির প্রতি সহমত প্রকাশ করেছেন অধিকাংশ রিপাবলিকান রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা।

এমনকি রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের বর্তমান স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থি ও অন্যান্য শীর্ষ নেতারা ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির শাস্তি দাবি করে সংসদীয় শুনানির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ডেমোক্রেটিক নেতৃত্ব অবশ্য একে যুক্তরাষ্ট্রের আইনব্যবস্থার সাফল্য বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এ দেশে আইনের চোখে সবাই সমান, এমনকি অপরাধী হলে একজন সাবেক প্রেসিডেন্টকেও যে কাঠগড়ায় উঠতে হবে, এতে তাঁরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

সন্দেহ নেই ট্রাম্প নৈতিকভাবে দেউলিয়াপ্রাপ্ত একজন রাজনীতিক। তা সত্ত্বেও রিপাবলিকান নেতৃত্ব ও দেশের এক-তৃতীয়াংশ নাগরিক তাঁর প্রতি যে কঠোর আনুগত্য প্রকাশ করেছেন, তা বিস্ময়কর। তিনি একটি নতুন রাজনৈতিক ধারার মুখপ্রাপ্ত, যার কেন্দ্রে রয়েছে শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদভিত্তিক বর্ণবাদ। ট্রাম্পবিরোধী হিসেবে পরিচিত রক্ষণশীল ভাষ্যকার ডেভিড ফ্রেঞ্চ মন্তব্য করেছেন, এই মামলার মাধ্যমে ট্রাম্পের চরিত্র যতটা না প্রকাশিত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়প্রাপ্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির চরিত্র।

  • হাসান ফেরদৌস লেখক ও প্রাবন্ধিক

Also Read: ট্রাম্প সরলেও থেকে যাবে ‘ট্রাম্পকার্ড’