আমার বয়স যখন ১৬ বছর ৪ মাস তখন, বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এক মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর যে যুদ্ধ আমরা শুরু করেছিলাম, তা ছিল অনেকখানি ‘যার যা কিছু আছে’, তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো এক যুদ্ধ। অনেক ‘বিজ্ঞ লোক’ তখন ভেবেছিলেন যে বাঁশের লাঠি দিয়ে সর্বাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বাঙালিরা কখনোই যুদ্ধে জিততে পারবে না।
কিন্তু আমার মতো কোটি কোটি আবেগদীপ্ত তরুণ-কিশোরেরা তখন ভেবেছিল, আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে, এবার ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’! রবার্ট ম্যাকনামারাকেও স্বীকার করতে হয়েছিল যে শত শত মেগাটন বোমা ফাটিয়েও ভিয়েতনামের জনগণের আদর্শ ও চেতনাকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। চীনেও ‘বোকা বুড়োরাই’ পাহাড় সরাতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর লাতিন আমেরিকায় আবার মৃত চে-র পুনরুত্থান হচ্ছে, আমরা দেখছি। এসবই প্রমাণ করে, জনগণের প্রকৃত উত্থানকে কোনো শক্তিই দাবিয়ে রাখতে পারে না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রকৃত অর্থে একটি জনযুদ্ধ। বাঙালি জাতির সব শ্রেণির সব সদস্যই এর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি যাঁরা পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির অনুগ্রহপুষ্ট সুবিধাভোগী ছিলেন, তাঁরাও ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস আক্রমণের পর স্বাধীনতার পক্ষে চলে এসেছিলেন।
একমাত্র ‘অন্ধ মৌলবাদী’ ও মুষ্টিমেয় দালালেরা ছাড়া কেউই পাকিস্তানের ওই নৃশংস আক্রমণকে মানতে পারেনি। কিছু সুবিধাবাদী অবশ্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিল। তারা ‘মার্কটাইম’ করছিল। যেদিকে জিতবে সেদিকেই যাবে—এটাই ছিল তাদের চিন্তা। খোদ যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সৌদি আরবের জনগণও শত অপপ্রচার সত্ত্বেও তাঁদের শাসকশ্রেণির বিরূপ ভূরাজনৈতিক অবস্থান উপেক্ষা করে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির সংগ্রামের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এভাবে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ১৯৭১ সালে গড়ে উঠেছিল বিশ্বমানবতার ঐক্যতান!
মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা অনেকেই পাভেল করচাগিনের কথাও ‘ইস্পাত’ উপন্যাসটিতে পড়ে থাকব। মহৎ ঘটনা ঘটানোর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের চরিত্রও কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে মহৎ হয়ে ওঠে, তার একটি অনবদ্য বর্ণনা ওই উপন্যাসে রয়েছে। মার্ক্সের ‘ফয়েরবাখ’–এর ওপর ১১টি থিসিসের নির্যাসও তা–ই! যেকোনো মহাসংগ্রাম একটি আগুনের মতো। যে আগুন শুধু ধ্বংসই করে না, আগুনে পুড়ে পুড়ে লোহাকে ইস্পাতেও পরিণত করে। পৃথিবীর সব মহাযুদ্ধের মধ্যে আমরা শুধু ধ্বংস ও অশান্তি দেখলে ভুল করব। ওই ধ্বংসের আড়াল থেকে মহৎ সৃষ্টি সব সময়ই উঁকি মেরেছে। আমরা দেখতে পেয়েছি, জনগণের অসাধ্য কিছুই নেই। বদলে দেওয়ার মহৎ সংগ্রামের মাধ্যমেই আমরা নিজেদেরও মহৎ মানুষে পরিণত করছি। নিজেদের বদলে দিচ্ছি।
সম্ভবত ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আমরা তখন গোকুলনগর ট্রানজিট ক্যাম্পে শীতে কাঁপছি। অপেক্ষা করছি কখন মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণের জন্য ট্রানজিট ক্যাম্প ছেড়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে যেতে পারব, ট্রেনিং নিয়ে বন্দুক হাতে দেশে যাব, যুদ্ধ করব। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী তখন একের পর এক হার মানছে। প্রতিদিন ভারত থেকে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতরে ঢুকছেন। আমরা ট্রানজিট ক্যাম্পে বসে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে পড়ছি।
এ রকম সময় ট্রানজিট ক্যাম্পের বদ্ধ জীবন আমাদের জন্য মোটেও কাম্য ছিল না। আমি ছিলাম ক্যাম্পের কনিষ্ঠ সদস্যদের একজন। এই কারণে আমাদের ক্যাম্পের প্রধান কঠিন কঠোর ব্রহ্মচারীর মতো দৃঢ়চেতা কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী আমাকেই একটি কঠিন দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেই দায়িত্বটি হচ্ছে, দুপুরবেলায় লাইন করে যখন সবাই খাবারের বাসনটি নেবে, তখন সেই লাইনে টিকিট বিতরণের দায়িত্ব আমার। ফলে প্রতিদিন সবাইকে টিকিট দিয়ে আমার খেতে খেতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত। কিন্তু বয়স আমার কম ছিল বিধায়, বয়স্ক ক্যাম্প–সাথিরা ধৈর্য ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ভাবতেন এই বাচ্চাই যখন এতক্ষণ অপেক্ষা করছে, আমরা কেন পারব না।
আমরা তখন খোলা ময়দানে বাঁশের চাটাইয়ের ওপর বসে দুপুরের ভাত বিকেলে খেতাম। রাতেও হ্যাজাকের আলোতে ময়দানেই খাওয়া চলত, সুশৃঙ্খল লাইনে দাঁড়িয়ে একই পদ্ধতিতে। গভীর রাতে পোকামাকড় এসে ভাতের থালায় পড়লে, আমরা সেটাই কড়মড়িয়ে খেতাম এবং মধ্যবিত্ত কমরেডরা একে অপরকে ঠাট্টা করে বলতাম, ‘প্রোটিন’ খাচ্ছি। আমাদের প্রতি বেলা আহার বরাদ্দ ছিল খুবই সামান্য, সকালে দুটি আটার রুটি ও এক চামচ বুটের ডাল। দুপুরে মাপা এক কাপ ভাত এবং এক হাতা ‘ঘ্যাঁট’ নামের বিচিত্র এক তরকারি। ঘ্যাঁট হচ্ছে যা কিছু শাকসবজি, কচুঘেঁচু সংগৃহীত হয়েছে, তার সম্মিলিত এক রূপ। রাতেও দুপুরের মতন একই খাবার।
স্বভাবতই আমরা সবাই থাকতাম অর্ধভুক্ত। বিশেষত শ্রমিক-কৃষক সাথিদের এত অল্প ভাতে চলত না, তাদের হাতে বাইরে থেকে কোনো কিছু কেনার পয়সাও ছিল না। আমরা মধ্যবিত্তরা তখন এক কাপ চা কিনে কীভাবে চারজনে ভাগ করে তা খেতে হয়, তা শিখেছিলাম। এভাবেই বহু ধনীর দুলাল, বহু আদরের ছেলেমেয়ে মুক্তিযুদ্ধের ওই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে ধীরে ধীরে কঠিন কঠোর যোদ্ধায় পরিণত হচ্ছিলেন।
পাশাপাশি ক্যাম্পের অন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী সাথিরা মমতা ও স্নেহের সঙ্গে আমাদের এই কৃচ্ছ্রতাকে দেখতেন। আমাদের দিকে আন্তরিক বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এভাবে বাস্তব জীবনের পারস্পরিক আমাদের দুই ভিন্ন শ্রেণি এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছিল। এভাবে আমরা এক অজেয় গণবাহিনীতে পরিণত হয়েছিলাম। মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে পরিচালিত, কিন্তু আসলে সেটা ছিল জনগণের গণবাহিনী।
একদিন আমাদের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ দায়িত্বশীল নেতা আমাদের মতো ‘সুশিক্ষিত’ ‘মধ্যবিত্ত’ কিছু নেতাকে ডেকে বললেন, আজ একটা পৃথক খাদ্যের আয়োজন করেছি। আসলে তিনি পার্শ্ববর্তী শরণার্থীশিবির থেকে কীভাবে যেন কিছু পুঁটিমাছ সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছিলেন। দুপুরে সেটাই রান্না করে আমরা পাঁচ-ছয়জন সবার চোখ এড়িয়ে গোপনে তা খেতে বসেছিলাম। কিন্তু সম্ভবত গন্ধের জন্যই সেটা জানাজানি হয়ে গেল। সেদিন আমাদের ক্যাম্পের পরিচালক অগ্নিযুগের বিপ্লবী জ্ঞান চক্রবর্তী আগরতলা শহরে গিয়েছিলেন বিশেষ কাজে। ফলে তাঁকে ছাড়াই আমরা এই কাজ করেছিলাম।
রাতে তিনি যখন ফিরে এলেন, তখন তাঁর জন্য রেখে দেওয়া বিশেষ পুঁটিমাছের তরকারিটি সাধা হলো। তিনি জানতে চাইলেন, কেন ও কীভাবে এই ‘বিশেষ আয়োজন’। সব ঘটনা শুনে তিনি সেদিন আমাদের বলেছিলেন, কাজটা করা আমাদের ঠিক হয়নি। ব্যাপারটা ঘটনা হিসেবে হয়তো সামান্যই। সুবিধাটাও খুবই ছোট আকারের। কিন্তু এটা গোপনে সাথিদের না জানিয়ে কিছুটা চুরি করে খাওয়ার মতো একটা ব্যাপার হয়ে গেছে। আর তা ক্যাম্প-শৃঙ্খলা বা মুক্তিযুদ্ধের যে নৈতিক শ্রেণিগত ভিত্তি রয়েছে, তাকে দুর্বল করে দেয়।
সব শুনে সেদিন আমাদের মনে প্রশ্ন জেগেছিল যে আমরা কি আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধির জোরে ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পেয়ে বাড়তি অগ্রহণযোগ্য সুবিধা নিয়েছি? আমরা কি বিশ্বাসঘাতক? ঘটনা ছোট, কিন্তু প্রশ্নটি ছিল বিশাল।
পরবর্তী সময় এ নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক ভেবেছি। এ কথা ঠিক যে সমাজতন্ত্রে ‘মুড়ি–মুড়কির’ সমান দর হবে না। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে যখন ন্যূনতম প্রয়োজনই সবার মেটেনি, তখনো কি এইধরনের বাড়তি ভোগ করাটা সমীচীন হবে? ‘ক্রুশ্চেভপন্থী’রা মনে করেছিলেন যে ‘বস্তুগত প্রেরণা’ ছাড়া উৎপাদনশক্তির বিকাশ ঘটাতে অধিকতর দক্ষ ব্যক্তিরা অনুপ্রাণিত হবেন না। সেটুকু প্রেরণা তাদের অন্তবর্তী সময়ে দিতে হবে। মার্ক্স ও লেনিনের কোনো কোনো লেখায় এর অনুমোদন পাওয়া যায়।
চে’-র অনুসারীরা ভাবেন যে নৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ কোনো পুরস্কার ছাড়াই অসাধ্য সাধনের আনন্দের জন্য অসাধ্য সাধন করবেন। একবিংশ শতাব্দীতে আবার আধুনিক চীনের স্রষ্টা দেং চীনাদের বলেছেন, ‘রাষ্ট্র তোমাদের সব সুযোগ দেবে, বাজারকে ব্যবহার করে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তোমরা সবাই ধনী হওয়ার চেষ্টা করো। তাতে কিছুটা অসমতা তৈরি হবে। উৎপাদনশক্তির বিকাশ হলে, সেটা আমরা আবার সংশোধন করে নেব। এর কোনটা যে ঠিক, তা বলা মুশকিল।’
অবশ্য এ কথাও তো সত্য, আমাদের মতন অন্য বিভিন্ন ক্যাম্পে আরও অনেক এই ধরনের অসমতা ঘটেছে। সেই অমীমাংসিত অসমতা সমস্যার বীজ ধারণ করেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সামনে অগ্রসর হয়েছে, বিজয়ও অর্জন করেছে। অসাম্যের সমস্যারও সঠিক সমাধান নিশ্চয়ই একদিন হবে। উৎপাদনশক্তির বিকাশ ও সাম্যের সোনালি সূত্রের সন্ধান মানবিকতার অসীম প্রগতিশীল যাত্রার মধ্যেই নিহিত আছে।
সম্ভবত পাঁচ আঙুলের অসমতার কিন্তু আবার কার্যকারিতা আছে। এর সমাধান এমনভাবেই আমাদের করতে হবে, যাতে অসমতা দূর হয়, কিন্তু কার্যকারিতা যেন নষ্ট না হয়ে আরও বৃদ্ধি পায়। এর কোনো সহজ–সরল ‘ধর তক্তা মার পেরেক’মার্কা নিয়ম নেই।
পাঁচ আঙুল মাও সে-তুং একসময় হুকুম দিয়ে কেটে সমান করার চেষ্টা করেছিলেন। তা চীনের জন্য সুফল বয়ে আনেনি। হয়তো এমন কোনো নতুন কৌশল খুঁজে বের করতে হবে, যেখানে ছোট আঙুলগুলো জন্য রইবে বাড়তি সুযোগর ব্যবস্থা। বড় আঙুলগুলো না কেটেই ছোট আঙুলগুলো প্রবৃদ্ধির বা বিকাশের গতিবেগ বৃদ্ধি করে হয়তো আমরা একই সঙ্গে আরও আধুনিক কিন্তু আরও সুষম সমাজ নির্মাণে সক্ষম হব।
কিন্তু আমরা যা–ই চাই না কেন, জনগণের উত্থান ছাড়া যে তা হবে না, সেটা নিশ্চিত। আর জনগণের উত্থানের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে তাদের নিজস্ব বিকশিত জ্ঞান সম্পর্কে। তাহলেই উত্থানের ফলাফলও তাদের হাতছাড়া হবে না। স্বচ্ছতা–জবাবদিহি তো লাগবেই, কিন্তু তারও আগে লাগবে জাগ্রত, সাহসী ও সক্ষম জনগণ।
এম এম আকাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক