Thank you for trying Sticky AMP!!

তালেবান কার ভয়ে এবং কেন রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে রাখছে

২০২২ সালে কাবুলে আফগান নারীদের বিক্ষোভ শূন্যে গুলি ছুঁড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয় তালেবান

আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের দুই বছর হলো এই আগস্টে। এই দুই বছরের একটা বড় বিশেষত্ব ছিল নিয়মিত কোনো না কোনো বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ। শেষ সেখানে নিষিদ্ধ হলো রাজনৈতিক দল। এই ফরমান জারির সময় শাসকদের তরফ থেকে এ–ও বলা হয়েছে, শরিয়তে রাজনৈতিক দলের কোনো বিধান নেই।

আফগানিস্তানে গত দুই বছর সামান্যই রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল। আইএস নামে পরিচিত সশস্ত্র ইসলামিক স্টেটের তৎপরতা ছাড়া কাবুলে নারীদের ছোটখাটো মিছিলের বাইরে উল্লেখ করার মতো কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। তারপরও এ সময় তালেবান সরকার কেন আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করল, সে বিষয়ে বিস্তর কৌতূহল তৈরি হয়েছে। শেষ ঘোষণার ভেতর দিয়ে প্রাসঙ্গিক আরেকটা জরুরি প্রশ্নও হাজির করেছে তালেবান, যেসব মুসলিমপ্রধান দেশে এখন বহুদলীয় রাজনীতি চলছে, তারা কি তবে শরিয়তবিরোধী কাজ করছে?

Also Read: কূটনীতি ও সমরে যেভাবে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল তালেবান

পশ্চিমাদের ব্যর্থ দর-কষাকষির দুই বছর

এটা এক অভিনব ঘটনা যে কাবুল দখলের দুই বছর পূর্তিকালেও বিশ্বের কোনো দেশ এখনকার আফগান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাতে অবশ্য তালেবান কোনো ধরনের অস্তিত্বের সংকটে পড়েনি। পুরো দেশে তাদের ভালোই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বাকি বিশ্ব, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকা এই ২৪ মাস আফগান সরকারের সঙ্গে নারীশিক্ষা নিয়ে ব্যাপক দর-কষাকষি চালালেও কোনো সফলতা আসেনি তাতে। পশ্চিমা কূটনীতির এই দীর্ঘ ব্যর্থ চেষ্টা কাবুলের বর্তমান নেতৃত্ব সম্পর্কে তাদের বোঝাপড়ার ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।

তালেবান প্রথম থেকেই স্পষ্টভাবে বলছে, উচ্চশিক্ষা ও ঘরের বাইরের কর্মজগৎ নারীর জন্য নয়। তাদের ক্ষমতা পাওয়ার দুই বছর পূর্তি উৎসবের অনুষ্ঠানগুলোয়ও নারীদের অংশগ্রহণ ছিল না। এ দুই বছর নিষেধাজ্ঞাগুলোর বড় অংশ নারীমুখী থাকলেও সাংবাদিকতা থেকে ঘুড়ি ওড়ানো পর্যন্ত আরও বহু বিষয়ে তালেবান অপছন্দের কথা জানিয়েছে। শেষ তারা রাজনৈতিক দলের ওপর আপত্তির কথা জানাল।

তালেবান বিচারমন্ত্রী আবদুল হাকিম সরাই তাঁর সরকারের দুই বছর পূর্তির পরদিন নতুন সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘দেশে কোনো রাজনৈতিক দলকে কাজ করতে দেব না আমরা। শরিয়া বিধানে রাজনৈতিক দলের কাজের কোনো সুযোগ নেই। আফগানিস্তানের জন্য সেটাই ভালো হবে।’ অর্থাৎ রাজনীতি যা করার, তালেবানরাই কেবল করবে।

নতুন বিতর্কের সূত্রপাত

আফগানিস্তানের এখনকার বিচারমন্ত্রী আবদুল হাকিম সরাই একসময় প্রধান বিচারপতিও ছিলেন। তালেবানরা তাঁকে ইসলামি আইনে পণ্ডিত মনে করে। যদিও ‘মানবাধিকারবিরোধী ভূমিকা’র জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কিন্তু আফগান নীতিনির্ধারণে গত দুই বছর তার প্রভাবে কোনো টান পড়তে দেখা যায়নি। এখন তিনি যখন বলেন যে শরিয়তে বহুদলীয় রাজনীতির কোনো অনুমোদন নেই, তখন সেটা ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্কসহ কয়েক ডজন মুসলিমপ্রধান দেশের গণতন্ত্রচর্চাকে নিশ্চিতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এমনকি এটা ইসলামে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের শত শত বছরের ঐতিহ্যকেও বিতর্কের মুখে ফেলেছে একদফা।

তালেবান আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য আদর্শিক প্রভাব আছে বিশ্বজুড়ে। রাজনৈতিক দল বিষয়ে তাদের নতুন মত কেবল উপমহাদেশে আটকে থাকবে না, বিশ্বজুড়ে এটা ভাবনা-দুর্ভাবনার সৃষ্টি করবে। এই আলোচনায় যুক্ত হয়ে কেউ কেউ ‘মদিনা সনদ’–এর কথাও স্মরণ করবেন, যেখানে অনেকগুলো ভিন্ন গোত্রকে কাছাকাছি এনেছিল একটা উদারনৈতিক উদ্যোগ ও চুক্তি, নিষেধাজ্ঞা নয়। হযরত মুহাম্মদ (সা.) সেখানে অভিভাবক ও সালিসকারীর ভূমিকা নিয়েছিলেন, একনায়কের নয়।

মদিনা সনদ সেখানকার গোত্রগুলোর ভেতর শান্তি ও স্বস্তি আনতে গিয়ে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর আধিপত্য কায়েম করেনি। অর্থাৎ বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মদিনা সনদ ছিল ফেডারেলধর্মী, একক আধিপত্যবাদী নয়। বাংলায় মাওলানা ভাসানী ও আবুল হাশিম যে ঐতিহ্যকে বলেছিলেন ‘পালনবাদ’ বা ‘রবুবিয়াত’।

Also Read: তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে যা করতে হবে

ইমরান ও পিটিআই আপাতত কোণঠাসা হয়ে গেলেও পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক সংস্থার সঙ্গে তালেবান নেতাদের পুরানো সম্পর্ক সচলই আছে। এ ছাড়া চীন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়াই তালেবান সরকারকে ধীরলয়ে মদদ দিচ্ছে। তালেবানের পক্ষ থেকে রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্তও এল মে মাসে চীন ও পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে তাদের এক যুক্ত বৈঠকের পর।

অর্থাৎ যেখানে ইসলাম সব প্রাণের পালনকারীর ভূমিকা নেয়, কর্তৃত্ববাদের জায়গা নয়। এই ধর্ম সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ও কর্তব্যের বিষয়ে নানামুখী মতামতের সংলাপ ও পর্যালোচনার পরিসর বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলে কি না, সেটা তালেবানের সিদ্ধান্তে নিঃসন্দেহে আবার বিতর্কের বিষয় হবে।

মুসলিমপ্রধান অনেক দেশে গণতন্ত্রের পক্ষে ইউসুফ কারজাভি, রশিদ ঘানুসি প্রমুখের চিন্তাধারা এখন বেশ জনপ্রিয়। এ রকম জনপ্রিয়তার মধ্যে তালেবানের নতুন সিদ্ধান্ত এল। কারজাভি, ঘানুসি প্রমুখ পণ্ডিত নারীর রাজনৈতিক অধিকারের পক্ষেও কথা বলছেন দীর্ঘকাল।

ধর্মীয় এই পরিসরের বাইরে, তালেবানদের রাজনীতিবিষয়ক ডিক্রির ন্যায্যতা বিশ্বজুড়ে সেসব মানুষকেও ভাবাবে, যাঁরা ২০২১ সালের আগের দুই দশক আফগানিস্তানে ন্যাটোর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নানা রূপে প্রতিবাদ করেছেন এবং আফগানদের প্রতিরোধকে সমর্থন দিয়েছেন।

Also Read: তালেবান নিয়ে উভয়সংকটে ইসলামাবাদ

তালেবান শিক্ষা-ঐতিহ্যের সঙ্গে বহুদলীয় ব্যবস্থা মানানসই নয়

রাজনীতি বিষয়ে তালেবানের নতুন সিদ্ধান্তের পেছনে যাঁরা অর্থনৈতিক কারণ খোঁজার চেষ্টা করবেন, তাঁদের আপাতত হতাশই হতে হবে। কোনো ধরনের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে তারা এই ব্যবস্থা নেয়নি।

পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের নেতিবাচক প্রচারণা সত্ত্বেও বাস্তবতা হলো, এ বছর দেশটিতে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, খাদ্যপণ্যের দামও কমেছে। বিশ্বের বিভিন্ন মুদ্রার বিপরীতে আফগানির দরও বাড়তে দেখা যাচ্ছে, যা অর্থনীতির শক্তিশালী হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। রাজস্ব আয়ও বাড়ছে এখানে এবং ৯০ ভাগ সরকারি কর্মচারীই বেতন পাচ্ছেন নিয়মিত। এ রকম অবস্থায় তালেবান কার ভয়ে এবং কেন রাজনীতিকে নিষিদ্ধ বিষয় করে রাখতে চাইছে, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারছে না। তবে এর উত্তর পাওয়া আসলে কঠিন নয়।

Also Read: যুক্তরাষ্ট্র নীতি বদলে ফেলছে, স্বীকৃতি পাবে তালেবান সরকার?

পাকিস্তান-আফগানিস্তানজুড়ে তালেবান শক্তির গঠন ও পুনর্গঠন চলছে প্রায় তিন দশক ধরে। যাঁরা এই প্রক্রিয়া নিবিড়ভাবে নজরে রেখেছেন, তাঁরা তালেবানদের রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্তে খুব বেশি বিস্মিত হননি। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তি রয়েছে তালেবান নেতাদের শিক্ষা ও আদর্শিক কাঠামোয় এবং পশতুনদের জাতিগত গোত্রকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে।

বর্তমান তালেবান নেতৃত্ব যে পরিবেশে ও ভারত-পাকিস্তানের যে ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত হয়েছে, সেসব জায়গায় কাঠামো নিয়ন্ত্রণমূলক। সাধারণ সমাজে শিল্প-সংস্কৃতির স্বাভাবিক বহুত্ববাদী যেসব কর্মকাণ্ড চলে, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘ফিতনা’ হিসেবে তার লাগাম টেনে রাখা হয় কঠোরভাবে। এভাবে বড় হওয়া ব্যক্তিদের শিক্ষাজীবনের ছাপ থাকছে তাঁদের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তেও। তালেবানদের যাবতীয় নিষেধাজ্ঞামূলক সিদ্ধান্ত তাই পশ্চিমের কূটনীতিবিদেরা দেন-দরবার করে সামান্যই বদলাতে পারবেন।

Also Read: তালেবানকে পশ্চিমাদের সঙ্গী করার এখনই সময়

কেবল রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞায় নয়, অতীতের সঙ্গে তুলনায় বর্তমান আফগানিস্তানের আরেকটি বড় ফারাক হলো, দেশটির নীতি-সিদ্ধান্ত সব হচ্ছে কাবুলের বদলে কান্দাহারে।

কান্দাহারেই থাকেন তালেবান আন্দোলনের জীবিত মুখ্য নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা। তাঁর সূত্রে কান্দাহার দেশটির রাজনৈতিক রাজধানী হয়ে আছে এ মুহূর্তে। সমস্যা হলো, সেখান থেকে ফতোয়া আকারে যত দ্রুত একের পর এক সিদ্ধান্ত আসছে, কাবুলের প্রশাসন তত সহজে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে পারছে না। ক্ষমতা দখলের দুই বছর পরও বহির্বিশ্বের স্বীকৃতির ঘাটতি সে কারণেই। তবে ইরান ও পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক বেশ গতিশীল। পাকিস্তানে ইমরান সরকারের পতন তালেবানকে কিছুটা মুশকিলে ফেলেছে। ইমরান তাদের সোচ্চার সমর্থক ছিলেন।

ইমরান ও পিটিআই আপাতত কোণঠাসা হয়ে গেলেও পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক সংস্থার সঙ্গে তালেবান নেতাদের পুরানো সম্পর্ক সচলই আছে। এ ছাড়া চীন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়াই তালেবান সরকারকে ধীরলয়ে মদদ দিচ্ছে। তালেবানের পক্ষ থেকে রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্তও এল মে মাসে চীন ও পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে তাদের এক যুক্ত বৈঠকের পর। চীনের সঙ্গে তালেবানদের বোঝাপড়া যদি আরও ইতিবাচক ভঙ্গিতে এগোয়, নিশ্চিতভাবে তার আরও রাজনৈতিক ছাপ পড়বে আফগানিস্তানের বাইরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যত্রও।

  • আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক