বর্তমানে বাংলাদেশে আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষ প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪.৬ শতাংশ। প্রত্যেক প্রতিবন্ধী মানুষ রাষ্ট্রের নাগরিক। তাই রাষ্ট্র প্রদত্ত সব সুবিধা ভোগ করার অধিকার তাঁর রয়েছে। বরং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হওয়ায় তাঁরা অতিরিক্ত কিছু সেবা ও সুবিধার অধিকারী। সমাজের মূল স্রোতে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে যুক্ত করতে হলে রাষ্ট্র, সমাজ এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু সিদ্ধান্ত গ্রহণই যথেষ্ট নয়, বরং তা বাস্তবায়নের ধারাবাহিক চর্চা থাকতে হবে। আশার কথা হলো বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী বিষয়ে সচেতনতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪৫ বছর ধরে প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হয়। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নানা আয়োজন, কমিটি গঠন এবং কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। এর ফলে সমাজে প্রতিবন্ধী অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এই আয়োজনগুলো কি সত্যিই প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে?
এই আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর পালিত হয় আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। এবারও বাংলাদেশে, এ বছর দিবসটি পালিত হয়েছে ‘Fostering disability inclusive societies for advancing social progress!’ শীর্ষক জাতিসংঘ ঘোষিত প্রতিপাদ্য নিয়ে। এ উপলক্ষে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন তিন দিনব্যাপী মেলা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। এখানে ও আলোচনার ভেতর দিয়েই সবকিছু শেষ হলো। নেই কোনো প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার, যা আগামী দিনে দেখাবে নতুন কোনো আলো।
বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধী অন্তর্ভুক্তি নিয়ে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। তারা মনে করে, প্রচুর কাজ হচ্ছে এবং মানুষ সন্তুষ্ট। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—
• সাংগঠনিক সংস্কৃতিতে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ নেই।
• সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধীদের ভূমিকা নেই।
• কার্যক্রমের সাফল্য-ব্যর্থতার জবাবদিহি নেই।
• উন্নয়নকর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ সীমিত।
এখানে একটি চিত্র তুলে ধরা যাক: বিগত বছরগুলোতে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও বাস্তব অগ্রগতি সীমিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে কর্মসংস্থানের হার মাত্র ৩১ শতাংশ, যেখানে অপ্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে তা ৫৭ শতাংশ।
এ ছাড়া একটি নীতি বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় প্রতিবন্ধী ভাতা পেলেও প্রায় ৪০ শতাংশ যোগ্য ব্যক্তি এখনো বাদ পড়ছেন।
ফলে কার্যক্রম থাকলেও প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জিত হচ্ছে না।
অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধী অন্তর্ভুক্তি পরিমাপ করে কার্যক্রমের সংখ্যা দিয়ে। কিন্তু অন্তর্ভুক্তি আসলে একটি নতুন বিশ্বাসের প্রতিস্থাপন—একটি ধারা যেখানে বৈষম্য বা বাধা থাকবে না, সবাই স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তি অনুভব করবে। তাই অনুষ্ঠান, প্রশিক্ষণ, সভা বা নীতিমালা হালনাগাদ—এসব কার্যক্রমের সংখ্যা প্রকৃত পরিবর্তনের প্রতিফলন নয়।
প্রতিবন্ধী অন্তর্ভুক্তির বাস্তব অগ্রগতি বোঝা যায় তখনই যখন—
• প্রতিবন্ধী কর্মীরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে সমাজে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারেন।
• নিয়োগে প্রতিবন্ধীদের সমান সুযোগ থাকে।
• প্রতিবন্ধী ও অপ্রতিবন্ধীদের মধ্যে সমন্বয় বজায় থাকে।
• গৃহীত কার্যক্রম সময়মতো বাস্তবায়িত হয় এবং দৃশ্যমান পরিবর্তন আনে।
• কর্মীরা অনুভব করেন তাঁদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ।
• সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিবন্ধী সদস্যরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন।
• নেতৃত্বে প্রতিবন্ধীবান্ধব আচরণ দৃশ্যমান হয়।
বর্তমানে প্রতিবন্ধী অন্তর্ভুক্তি নিয়ে যারা কাজ করছে, তাদের প্রতি কিছু মৌলিক প্রশ্ন তোলা জরুরি—
• গৃহীত নীতিমালা কার্যকর হচ্ছে কি না?
• কার্যকর হওয়ার ফলে কী পরিবর্তন এসেছে?
• প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান কতটুকু উন্নত হয়েছে?
উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করতে পারলেই সমস্যাগুলো চিহ্নিত হবে এবং সমাধানের পথ সুগম হবে বলে বিশ্বাস করি।
পরিশেষে বলব, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা গ্রহণ ও তার ধারাবাহিক বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। কার্যক্রম শুধু গ্রহণ করলেই হবে না, তা দৃশ্যমান হতে হবে। দৃশ্যমান পরিবর্তনই প্রমাণ করবে যে প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নত হচ্ছে। আসলে প্রমাণই পরিবর্তনের প্রকৃত সূচক। ফলাফলই সত্যকে প্রকাশ করে, আর সেই প্রকাশিত সত্যই প্রতিষ্ঠান ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এর ব্যত্যয় শুধুই হতাশা তৈরি করবে। বিশ্বাস করি, আগামী দিনগুলো কথার ফুলঝুরিতে রাঙাবে না, জীবন পরিবর্তনের মাধ্যমে রাঙাবে।
মো. শহীদুল হক (অশোকা ফেলো) প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এসএআরপিভি