সুন্দরবন
সুন্দরবন

মতামত

সুন্দরবনের দস্যু বনাম সংসদের দস্যু

আজ ৩ অক্টোবর। ইতিহাসের পাতায় দিনটি এক অমানবিক ঘটনার জন্য কালো অক্ষরে লেখা। ১৫০২ সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা ভারতের কালিকটের রাজার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ নিতে ১৫টি জাহাজ আর ৮০০ লোক নিয়ে রওনা দেন।

পথে তিনি আটক করেন মিরি নামে একটি জাহাজ, যেখানে মক্কা থেকে ফেরা ৪০০ হজযাত্রী ছিলেন, এর মধ্যে প্রায় ৫০ জন নারীও ছিলেন। যাত্রীদের মুক্তিপণের প্রস্তাব উপেক্ষা করে দা গামা তাদের জাহাজ জ্বালিয়ে দেন এবং পরে একে একে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করেন।

এটি ছিল নিছক দস্যুতা, যার উদ্দেশ্য ছিল আতঙ্ক সৃষ্টি, শোষণকে বৈধ করা এবং বাণিজ্যের নামে লুণ্ঠন। ইতিহাসবিদেরা একে মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ভাস্কো দা গামা ও তাঁর উত্তরসূরিরা সমুদ্রপথে শুধু পণ্য নয়, সভ্যতার মর্যাদাকেও রক্তাক্ত করেছিলেন। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ৫০০ বছর পেরিয়েও আমরা সেই একই জলদস্যুতার চিহ্ন দেখতে পাই। কখনো তা সুন্দরবনের অন্ধকার গহিনে, কখনো তা সংসদের গম্বুজ তলায়।

সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন (আত্মসমর্পণকারীরা বন দস্যুতায় ফিরছে, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫) পড়ে আমি স্তম্ভিত হই। সেখানে বলা হয়েছে, সুন্দরবনে আবারও সক্রিয় হয়েছে বনদস্যুরা। ২০১৮ সালে আত্মসমর্পণকারী ৩২টি বাহিনীর বহু সদস্য পুনরায় অস্ত্র হাতে ফিরেছে।  

‘দুলাভাই বাহিনী’সহ অন্তত ১৪টি নতুন-পুরোনো দল জেলে, মৌয়াল, বাওয়ালিদের জিম্মি করছে, মুক্তিপণ দাবি করছে ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। একজন জেলে বলছিলেন, মহাজনের কাছ থেকে আগে থেকে টাকা দিয়ে কার্ড  (টোকেন) কিনতে হয়। কার্ড থাকলে দস্যুরা ছাড় দেয়, না থাকলে জিম্মি ও মারধর অবধারিত।

এই কার্ড আসলে আজকের যুগের নতুন কার্তাজ, যেমন একসময় পর্তুগিজরা সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচলের অনুমতিপত্র চালু করেছিল। আমি নৌবাহিনীর মানুষ। সমুদ্রপথের ইতিহাস জানি। ভাস্কো দা গামার পর্তুগিজরা যেভাবে কর ও পাসের (টোকেন) নামে লুটপাট চালাত, সুন্দরবনের বর্তমান দস্যুরা আজ সেই একই কৌশল ব্যবহার করছে। আর দুঃখজনকভাবে, আমাদের রাজনীতিবিদদের চরিত্রও অনেকাংশে এই জলদস্যুদের সঙ্গে মিলে যায়।

শিল্পীর তুলিতে ভাস্কো দা গামা

ইতিহাসে পর্তুগিজরা বলত ‘কার্তাজ’ (টোকেন)  ছাড়া জাহাজ চলবে না। আজকের বনদস্যুরা বলছে ‘কার্ড’ ছাড়া বনে ঢোকা যাবে না। আর রাজনীতিবিদেরা প্রতিনিয়ত ঘোষণা করেন, ‘আমাদের ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়।’ অর্থাৎ বাক্য আলাদা হলেও উদ্দেশ্য এক—দুর্বল জনগণকে বন্দী করে রাখা।

এই শোষণ কৌশলকে টিকিয়ে রাখে আরেকটি ত্রিভুজ। পর্তুগিজদের পাশে ছিল বন্দরের এজেন্টরা, যারা জাহাজ থেকে কর আদায় করত। বনদস্যুদের পাশে আছেন মহাজনরা, যাঁরা টাকা ও সরঞ্জাম সরবরাহ করেন। রাজনীতিবিদদের পাশে আছে দালাল আর কমিশনখোর সিন্ডিকেট, যারা জনগণের ঘামঝরা অর্থকে ভাগ করে শীর্ষে পাঠায়। এ যেন এক অভিন্ন কাঠামো—বন্দুকধারী দস্যু, তদারকি করা মহাজন, আর ওপরে বসা ক্ষমতাধর নেতা। সবাই একই নাটকের চরিত্র, শুধু পোশাক আলাদা।

ভয়ও সব যুগেই একই রকম। সুন্দরবনের জেলে রাতে নদীতে নামতে ভয় পান, পর্তুগিজ যুগে বণিকেরা সমুদ্রযাত্রা করতে ভয় পেতেন, আজ সাধারণ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে ভয় পান। ভয় কখনো বন্দুকের, কখনো মামলার, কখনো দলীয় ক্যাডারের। ফলে মানুষ ভাবে, চুপ থাকাই নিরাপদ। কিন্তু ইতিহাস শিখিয়েছে, নীরবতা শোষকের দাপট আরও বাড়ায়। সব শোষণের মূলে থাকে স্বার্থ। মহাজন বনদস্যুকে অর্থ দেন, কারণ এতে তাঁর ব্যবসা চলে।

পর্তুগিজরা সমুদ্র দখল করেছিল নিজেদের বাণিজ্যের জন্য। রাজনীতিবিদেরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেন নিজেদের ধনভান্ডার ভরাট করতে। জনগণের স্বার্থ থাকে বক্তৃতায়; বাস্তবে কাজ হয় উল্টো পথে।

ফলে দেখা যায় তিন ভিন্ন অবয়বের এক চরিত্র। বনদস্যু বন্দুক ঠেকিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে, পর্তুগিজ কামানের জোরে কর আদায় করত, আর রাজনীতিবিদরা ভোটের মাধ্যমে বৈধতা নিয়ে প্রকল্প কমিশন, ব্যাংক লোন কেলেঙ্কারি, টেন্ডার সিন্ডিকেটে জনগণের অর্থ হাতিয়ে নেন। তিনজনেই একই ভাষায় বলে, ‘আমাদের ছাড়া তোমাদের চলবে না।’ জনগণকে বন্দী করা, সম্পদ শোষণ করা, ভয় দেখিয়ে কর্তৃত্ব কায়েম করা, এটাই অভিন্ন চরিত্র।

বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের প্রকৃত দায়িত্ব হলো আইন প্রণয়ন ও জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবে সংসদ আজ অনেকের কাছে লাভজনক ব্যবসা। মনোনয়ন কেনা, ভোট জালিয়াতি, পেশিশক্তি ও কোটি কোটি টাকার লেনদেনে রাজনীতি কলুষিত। নির্বাচিত হয়ে এমপি তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পের আড়ালে কমিশন, টেন্ডারবাজি ও ঘুষের মাধ্যমে জনগণের সম্পদ শুষে নেন। তাঁদের আচরণ সমুদ্রের জলদস্যুর মতোই, শুধু অস্ত্র ভিন্ন, পোশাক ভিন্ন। সংসদের ভেতরে বসে বৈধতার মুখোশ পরে তাঁরা রাষ্ট্রকে লুট করেন।

সুন্দরবনের দস্যু দয়াল বাহিনীর সদস্যদের আত্মসমর্পনের প্রস্তুতি। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি।

তবে ৫ আগস্ট ২০২৪-এর গণজাগরণ দেখিয়েছে, জনগণ যখন জেগে ওঠে, তখন স্বৈরাচারী শক্তি ভীত হয়। ১৬ বছরের শাসনের পর মানুষ আশা করেছিল মৌলিক পরিবর্তনের। তবে পরিবর্তন দৃঢ় হবে তখনই, যখন জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন হবে এবং প্রতিটি স্তরে জবাবদিহি নিশ্চিত করা যাবে। রাজনৈতিক জাগরণ যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন প্রশাসনিক বিপ্লব। দুর্নীতি শিকড় থেকে নির্মূল করতে প্রশাসনে আনতে হবে সাহসী ও কর্মক্ষম মানুষদের। দ্রুত নিয়োগ, কঠোর শুদ্ধি অভিযান ও স্বচ্ছ জবাবদিহি প্রক্রিয়া দরকার। দুর্নীতি মানেই ‘সর্বনাশ’, এই বার্তা সবার কাছে পৌঁছানো জরুরি।

জাপানে এক বাসচালক মাত্র সাত ডলার আত্মসাৎ করায় চাকরি হারিয়েছেন, পেনশনের ৮৪ হাজার ডলারও কাটা গেছে। শিক্ষা স্পষ্ট, জনস্বার্থে আঘাত মানেই নিজের ভবিষ্যৎ ধ্বংস। আমাদের দেশেও দুর্নীতিবাজদের দ্রুত ও কঠোর শাস্তি দিয়ে জাপানের মতো দৃষ্টান্ত স্থাপন ছাড়া বিকল্প নেই। বিশেষায়িত দুর্নীতি দমন সংস্থা ও দ্রুত-ট্র্যাক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

এই বাস্তবতাকে বোঝাতে বহু গল্প ঘুরে বেড়ায়। এক জেলে বলছিলেন, ‘ডাকাতকে টাকা দিলে অন্তত বনে ঢুকতে পারি, কিন্তু রাজনীতিবিদকে টাকা দিলে ভোটে যাওয়ার সাহসও পাই না।’ কথাটি শুনে হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারিনি। আবার এক বন্ধু মজা করে বলেছিল, ‘ডাকাত গরু চুরি করলে অপরাধ, রাজনীতিবিদ গরু খেলে সেটা উন্নয়ন!’ তিক্ত হলেও বাস্তবতাটা অস্বীকার করা যায় না। বাংলাদেশে রাজনীতি যেন সমুদ্রযাত্রার মতো—ঝড়ের আগে প্রতিশ্রুতি, ঝড় কেটে গেলে ধনভান্ডার গায়েব।

সিঙ্গাপুরের নামকরণের পেছনে থাকা একটি পৌরাণিক কাহিনির কারণে এটিকে ‘লায়ন সিটি’ বা ‘সিংহ নগরী’ বলা হয়, যদিও বাস্তবে সেখানে কোনো সিংহ নেই।  তবে তাদের সিংহ–নেতা ছিলেন লি কুয়ান ইউ, যিনি দুর্নীতি দমন ও কঠোর সুশাসনের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরকে উন্নত দেশে রূপান্তর করেছিলেন।

বাংলাদেশেও কি এমন সিংহ–নেতা আসবেন, যিনি রাজনৈতিক জলদস্যুতা থেকে দেশকে মুক্ত করবেন? সুন্দরবনের দস্যু দমনে যেমন শক্তিশালী অভিযান দরকার হয়েছিল, তেমনি সংসদের দস্যু দমনেও প্রয়োজন আইন, সুশাসন ও জবাবদিহির কঠোর ব্যবস্থা। প্রশ্নটা তাই আজ জ্বলছে, আমরা কি সেই সিংহ–নেতার দেখা পাব, নাকি আবারও জনতার গণজাগরণই এমন নেতৃত্ব জন্ম দেবে?

অবশেষে বলা যায়, সুন্দরবনের দস্যু, পর্তুগিজ জলদস্যু আর বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, তিনজনেই একই ধারার শোষক। নাম ভিন্ন, পোশাক ভিন্ন, কিন্তু চরিত্র অভিন্ন। জনগণকে ভয় দেখিয়ে, জিম্মি করে, সম্পদ লুট করে তারা নিজেদের সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।

১৫০২ সালের ভাস্কো দা গামার হত্যাযজ্ঞ মনে করিয়ে দেয়, জলদস্যুতা কেবল ইতিহাস নয়, আজও আমাদের চারপাশে বিদ্যমান। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান আমাদের শিখিয়েছে—পরিবর্তন সম্ভব, তবে সেটি হতে হবে দ্রুত, সাহসী ও শিকড়-উপড়ানো সংস্কারের মাধ্যমে। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও লিখবে, ‘দস্যুতা গেছে, আবার ফিরে এসেছে।’

  • কমোডর (অব.) জসীম উদ্দীন ভূঁইয়া নৌবাহিনীর সাবেক সহকারী প্রধান ও সহ-উপাচার্য, বিইউপি