মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কথা বলছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে। জাপানে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে, ২৮ জুন ২০১৯
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কথা বলছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে। জাপানে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে, ২৮ জুন ২০১৯

মতামত

ট্রাম্পের চাপের মুখেও কেন ইসরায়েল প্রশ্নে সৌদি যুবরাজের ‘না’

ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক মঞ্চ বরাবরই যুক্তি বা বোঝাপড়ার চেয়ে অভিনয়কৌশলের ওপর বেশি নির্ভর করেছে। বন্ধ দরজার আড়ালে মিত্রদের নতিস্বীকারে রাজি করানো, তারপর ক্যামেরার সামনে তাদের অনুগত ভঙ্গি উপস্থাপন করা তেমনই কৌশল। কিন্তু সেই রীতি ভেঙে পড়ে গত ১৮ নভেম্বর।

আঞ্চলিক গোয়েন্দা সূত্রের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক বারাক রাভিদের বরাতে জানা যায়, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে হোয়াইট হাউসে ডেকে পাঠানো হয় এবং ক্যামেরার সামনে যাওয়ার আগেই সতর্ক করা হয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁকে প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে চাপ দেবেন।

এরপর যা ঘটেছে, তা কূটনীতি নয়, বরং চাপ প্রয়োগের চেষ্টা, একধরনের ‘আচমকা হামলা’, যার মাধ্যমে সৌদি আরবের শাসককে অপমানজনক স্বীকারোক্তিতে বাধ্য করার চেষ্টা করা হয়েছিল; যদিও সালমান তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরিকল্পনাটিও বাজেভাবে ব্যর্থ হয়।

রাভিদের তথ্যমতে, ব্যক্তিগত আলোচনায় সালমান দুটি সত্য তুলে ধরেন। প্রথমত, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া সৌদি জনমত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিপক্ষে। দ্বিতীয়ত, সৌদির শর্ত দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার—ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে সুনির্দিষ্ট নিশ্চয়তাকে পাশ কাটিয়ে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব নয়। মার্কিন কর্মকর্তাদের উত্তরও ছিল স্পষ্ট—এ ধরনের শর্ত পূরণ করা হবে না।
পরে প্রকাশ্য বৈঠকে সালমান ব্যক্তিগত আলোচনার সেই একই অবস্থান হুবহু পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানান। গোপন চাপ প্রয়োগের সেই পরিকল্পনা সবার সামনে ভেস্তে যায়, যা ট্রাম্পের জন্য ছিল বিরক্তি ও বিস্ময়ের কারণ।

ফিলিস্তিন ইস্যুকে পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার জোরালো প্রচেষ্টা ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের। সাংবাদিক বারাক রাভিদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটন ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-কে শান্তিচুক্তি হিসেবে নয়, বরং একধরনের ভূরাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস হিসেবে দেখেছিল; যার লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের আধিপত্য স্থায়ী করে দেওয়া এবং ফিলিস্তিনের দাবিগুলোকে আরও ধামাচাপা দেওয়া।

এদিকে যেকোনো মার্কিন-সৌদি দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তিকে ইসরায়েল গভীর সন্দেহের চোখে দেখছিল। কারণ, তা নাকি তাদের আঞ্চলিক সামরিক একচেটিয়া ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। রাভিদ উল্লেখ করেন, কিছুদিন আগেই ইসরায়েলি কর্মকর্তারা সৌদি আরবকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান দেওয়ার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। কারণ, ‘ইসরায়েলের গুণগত সামরিক সুবিধা বজায় রাখতে হবে’। এমনকি সেই সৌদিদের বিরুদ্ধেও, যাদের সঙ্গে ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইছিল। এই দ্বৈত অবস্থান ছিল প্রকাশ্যেই, একদিকে ইসরায়েল সৌদি আরবের সঙ্গে শান্তি চায়, কিন্তু তাদের সমমানের সামরিক সক্ষমতা দিতে চায় না।

হোয়াইট হাউসের হিসাব-নিকাশ আরও নির্মম মনে হয়েছিল। ট্রাম্পের দল ধরে নিয়েছিল যে জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বৈশ্বিক ক্ষোভের চাপে সালমান নতিস্বীকার করবেন। ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে নিহত ওয়াশিংটন পোস্টের এই সাংবাদিকের হত্যায় সৌদি রাজপরিবারের জড়িত থাকার বিষয়ে সিআইএর তথ্য-উপাত্ত ট্রাম্প প্রকাশ্যে খারিজ করে দেন।

ওয়াশিংটন ধরে নিয়েছিল, দুর্বলতা মানেই নমনীয়তা। তবে তাদের ধারণা ছিল ভুল।
ওয়াশিংটন মনে করেছিল দুর্বলতা মানে নরম হয়ে যাওয়া। ওভাল অফিসে তখন অহংকারই শাসন করছিল। ধারণাটি ভুল ছিল।

সালমানকে ক্যামেরার সামনে অপমান বা নতিস্বীকার—এ দুইয়ের একটিকে বেছে নিতে বাধ্য করার চেষ্টা দাঁড়িয়েছিল পুরোনো সাম্রাজ্যবাদী ধারণার ওপর। এ ধারণা অনুযায়ী, চাপ দিলে দুর্বলতা প্রকাশ পায় এবং দুর্বলতা নতিস্বীকার ডেকে আনে। কিন্তু নভেম্বরের দিনটিতে এই যুক্তি ভেঙে পড়েছিল। সালমান ভীত হননি। তিনি মাথানতও করেননি। তিনি দৃঢ়ভাবে নিজের অবস্থানে ছিলেন।

সালমানকে ক্যামেরার সামনে অপমান বা নতিস্বীকার—এ দুইয়ের একটিকে বেছে নিতে বাধ্য করার চেষ্টা দাঁড়িয়েছিল পুরোনো সাম্রাজ্যবাদী ধারণার ওপর। এ ধারণা অনুযায়ী, চাপ দিলে দুর্বলতা প্রকাশ পায় এবং দুর্বলতা নতিস্বীকার ডেকে আনে। কিন্তু নভেম্বরের দিনটিতে এই যুক্তি ভেঙে পড়েছিল। সালমান ভীত হননি। তিনি মাথানতও করেননি। তিনি দৃঢ়ভাবে নিজের অবস্থানে ছিলেন।

এ ঘটনা সৌদি কূটনীতি নিয়ে প্রচলিত একটি মিথ ভেঙে দেয়। অনেকে ভাবত, রিয়াদ কেবল আমেরিকান শক্তির অনুগত একটি অংশ। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বাস্তবতা ভিন্ন। সৌদি আলোচনা করতে পারে। তারা আপস করতে পারে। দর-কষাকষি করতে পারে। কিন্তু তারা এমন চাপের কাছে নত হবে না, যা ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অবস্থানকে মুছে দিতে চায়।

ওয়াশিংটনের এই কৌশল তাদের আসল উদ্দেশ্যও প্রকাশ করে। ইসরায়েল-সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল না, ছিল রাজনৈতিক প্রদর্শনীর জন্য। ট্রাম্প চাইছিলেন একটি দৃশ্যমান সাফল্য। তিনি চাইছিলেন, একজন আরব নেতা যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবেন। এটি তাঁর টেলিভিশননির্ভর ঐতিহাসিক সাফল্যের মুকুট হয়ে উঠত। ফিলিস্তিনিরা হতো এই প্রদর্শনীর গৌণ শিকার।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ২০২০ সালে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি ইসরায়েলকে ফিলিস্তিন প্রশ্নকে পাশ কাটানোর সুযোগ দেবে। এতে ইসরায়েলকে এই ইস্যু সরাসরি মোকাবিলা করতে হবে না।

সালমান এখনো একটি বিতর্কিত চরিত্র। তবু ঘটনাটি একটি স্পষ্ট সীমানা টেনে দিয়েছে। তাঁর শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে যা–ই মত হোক, ফিলিস্তিন প্রশ্নে তাঁর অবস্থান দীর্ঘদিনের আরব জনমতের সঙ্গে মিলে যায়: রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া স্বাভাবিকীকরণ মানে আত্মসমর্পণ।

সৌদির এই অবস্থান হঠাৎ তাদের দেশীয় রাজনৈতিক দমন বা আঞ্চলিক ভূমিকার দায়মুক্তি এনে দেয় না। কিন্তু হোয়াইট হাউসের ঘটনাটা একটি ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছে যে আরব নেতারা নাকি যথেষ্ট হুমকি বা লোভ দেখালে সব সময়ই মাথা নত করেন।

‘জোরজবরদস্তি মানেই নিয়ন্ত্রণ’—এ ধারণা এখনো সাম্রাজ্যবাদী অহংকারের অতীত চিন্তার অংশ। ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্বকূটনীতিকে রিয়েল এস্টেট দর-কষাকষির মতো দেখেছিল। ধরে নিয়েছিল, চাপ প্রয়োগ করলেই সম্পদ হাতবদল হবে। কিন্তু দেশগুলো কোনো সম্পত্তি নয়, আর নেতারাও যতই বিতর্কিত হোক, তাঁরা ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক মঞ্চের কর্মচারী নন।

এই ‘আচমকা চাপ প্রয়াস’ ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ, তারা মূল বিষয়টি ভুল বুঝেছিল—কোনো আরব নেতা ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্ব পাশ কাটিয়ে ইসরায়েলকে বৈধতা দিতে পারেন না। এটি করলে দেশে এমন প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে, যা কোনো অস্ত্রচুক্তি দিয়েই ঠেকানো সম্ভব হবে না। সৌদি আরব ইসলামের পবিত্রতম স্থানের অভিভাবক, তারা ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রহীনতাকে স্থায়ী করার স্বাক্ষরদাতা হতে পারে না।

হোয়াইট হাউসের ওই ঘটনা সালমানকে কোনো নায়ক বানায়নি, বরং দেখিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের চরম দম্ভের যুগেও সব চাপ প্রয়োগ সফল হয় না।

  • জাসিম আল-আজ্জাবি সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক

    মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত