রংপুর সিটি করপোরেশানের ফটক
রংপুর সিটি করপোরেশানের ফটক

মতামত

রংপুর নামে সিটি, কাজে পৌরসভা!

১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত রংপুর পৌরসভাকে ২০১২ সালে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হয়। তখন বলা হয়েছিল, উত্তরাঞ্চলের এই ঐতিহ্যবাহী নগর হবে পরিকল্পিত উন্নয়ন, আধুনিক সেবা ও নাগরিক সুবিধার এক অনন্য কেন্দ্র।

কিন্তু এক যুগ পেরিয়ে গেলেও প্রায় আট লাখ মানুষের সেই স্বপ্ন আজও অপূর্ণ। কাগজে-কলমে রংপুর সিটি হলেও বাস্তবে নাগরিক জীবন এখনো পৌরসভার সীমায় আবদ্ধ।

বরং নগর হওয়ার পর জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়েছে, হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বেড়েছে যানজট, কমেছে জনমিতিগত সেবার মান। অথচ একসময় রংপুর ছিল বাংলাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল। গুপ্ত, পাল ও সেন রাজারা শাসন করেছেন এ জনপদ; মাহিগঞ্জ ছিল মোগল সাম্রাজ্যের আঞ্চলিক কার্যালয়। ব্রিটিশ আমলে লর্ডদের পদচারণ ছিল এই শহরে। ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায় আঠারো শতকের প্রথমার্ধে রংপুর কালেক্টরেটে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন।

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জাতীয় ইতিহাসের তীর্থভূমি এই নগরে ১৮৩২ সালে রংপুর জিলা স্কুল, ১৮৪৭ সালে ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’ পত্রিকা, ১৮৫৪ সালে পাবলিক লাইব্রেরি এবং ১৯১৮ সালে কারমাইকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও জুলাই আন্দোলনেরও সূতিকাগার রংপুর। ১৯৪৭ সালের আগপর্যন্ত এটি ছিল প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পকেন্দ্র।

এ শহরেরই সন্তান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৯ বছর দেশ শাসন করেছেন। তাঁর দলের প্রার্থীই ছিলেন গত মেয়র। কিন্তু আজ রংপুর শহর নিরানন্দ, সড়কে খানাখন্দ, ফুটপাত দখল, ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল। বর্ষায় ডুবে যায় নগরের বড় অংশ, ড্রেন উপচে পানি পড়ে রাস্তায়, দুর্গন্ধে জীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে। শুষ্ক মৌসুমে ওড়ে ধুলাবালু। সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ; এ কারণে বিদ্যালয়ের শিশুরাও দিনের বেলায় মশার কামড়ে অতিষ্ঠ।

নগরীর বুকচিরে বয়ে যাওয়া শ্যামসুন্দরী খাল এখন ময়লার ভাগাড়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রায় মধ্যযুগীয় পর্যায়ে। সড়কের পাশে আবর্জনার স্তূপ জমে থাকে, নিয়মিত আসে না ময়লার গাড়ি, অনেক ওয়ার্ডে নির্দিষ্ট ডাম্পিং পয়েন্টই নেই। এতে পরিবেশদূষণ বাড়ছে, ছড়াচ্ছে রোগব্যাধি। অথচ ঢাকাসহ অন্য সিটিতে স্মার্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ শুরু হয়েছে, রংপুরে সে আলোচনাও নেই। স্থানীয় পরিবেশবিদেরা বলছেন, শব্দ ও বায়ুদূষণও এখন সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাও নাজুক। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিজেই অসুস্থ—অনিয়ম, দুর্নীতি, আবর্জনা ও দুর্গন্ধে ভরা। কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল নেই। মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যকেন্দ্রের ঘাটতি প্রকট। অধিকাংশ ক্লিনিক ব্যয়বহুল ও নিম্নমানের—অপচিকিৎসায় প্রাণহানি ঘটে প্রায়ই। মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা আজও অধরাই।

রংপুরবাসীর প্রশ্ন, সিটি করপোরেশন হয়েও কেন তারা মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত? রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কিংবা বিনোদন—কোনো ক্ষেত্রেই উন্নয়ন দৃশ্যমান নয়। অথচ রাজধানীসহ অন্যান্য সিটিতে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ বৈষম্য শুধু রংপুর নয়, পুরো উত্তরাঞ্চলের মানুষের মনেও বঞ্চনার বোধ তৈরি করছে।

শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক থেকেও রংপুর পিছিয়ে। উত্তরবঙ্গের শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হলেও এখানে নেই আধুনিক পাঠাগার, থিয়েটার হল, সংস্কৃতিকেন্দ্র বা মানসম্মত পার্ক। শিশু ও তরুণদের নিরাপদ বিনোদনের জায়গাও অপ্রতুল।

সম্প্রতি চিড়িয়াখানায় বিনোদন ট্রেনের চাপায় তিন বছরের শিশুর মৃত্যু কিংবা বিদ্যুতায়িত সড়ক বিভাজকে কিশোরের প্রাণহানি (প্রথম আলো, ৫ অক্টোবর ও ২ নভেম্বর) নগর ব্যবস্থাপনার চরম অব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে। সিটি করপোরেশনের কাজ নাগরিক জীবনে প্রাণ ফেরানো, কিন্তু সেখানে প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে অদক্ষতা ও উদাসীনতা। নগর ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের অভাব প্রকট।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও রংপুরের চিত্র হতাশাজনক। একসময় চিনিকল, বস্ত্রশিল্প ও কৃষিভিত্তিক ছোট কারখানাগুলো এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে সচল রেখেছিল; এখন অধিকাংশই বন্ধ। নতুন কোনো শিল্পাঞ্চল বা বিনিয়োগ প্রকল্প হয়নি। তরুণদের কর্মসংস্থান নেই বললেই চলে। কৃষিভিত্তিক সম্ভাবনাও অনাবিষ্কৃত। সিটি করপোরেশনের রাজস্ব আয় সীমিত, ফলে নিজস্ব উন্নয়ন প্রকল্প নেই। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে রংপুর সিটির জন্য বরাদ্দ ছিল শূন্য। এ কারণে নাগরিক সেবা দিতে গিয়ে নগর প্রশাসনও হিমশিম খায়।

রংপুরবাসীর প্রশ্ন, সিটি করপোরেশন হয়েও কেন তারা মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত? রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কিংবা বিনোদন—কোনো ক্ষেত্রেই উন্নয়ন দৃশ্যমান নয়। অথচ রাজধানীসহ অন্যান্য সিটিতে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ বৈষম্য শুধু রংপুর নয়, পুরো উত্তরাঞ্চলের মানুষের মনেও বঞ্চনার বোধ তৈরি করছে।

রংপুরের এ দুরবস্থার মূল কারণ রাজনৈতিক অবহেলা ও প্রশাসনিক অনীহা। সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরে সমন্বয়ের অভাব যেমন রয়েছে, তেমনি কেন্দ্রীয় পর্যায়েও রংপুরের প্রতি মনোযোগ কম। প্রতিশ্রুতি থাকে, বাস্তবায়ন হয় না। কোনো বড় প্রকল্প নেই, নেই দৃশ্যমান পরিবর্তন।

তবু রংপুরের সম্ভাবনা অগাধ। এটি উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার, কৃষি ও শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র। সঠিক পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও দক্ষ নেতৃত্ব পেলে রংপুর হতে পারে আধুনিক ও বাসযোগ্য নগর। এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান—যেখানে ড্রেনেজ, পানি সরবরাহ, যোগাযোগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের জন্য আলাদা কিন্তু সমন্বিত পরিকল্পনা থাকবে। একই সঙ্গে স্থানীয় নাগরিকদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারি উন্নয়ন–পরিকল্পনায় রংপুরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিল্পাঞ্চল স্থাপন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সংস্কৃতি ও বিনোদন অবকাঠামো গড়ে তোলা—এসব উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি। সবচেয়ে জরুরি হলো, সিটি করপোরেশনকে কাগুজে প্রতিষ্ঠান না রেখে প্রকৃত অর্থে কার্যকর স্থানীয় সরকার সংস্থায় রূপান্তর করা, যাতে তারা নিজেরা নাগরিক সেবা উন্নত করতে পারে।

রংপুর সিটি করপোরেশন কোনো কাগুজে সত্তা নয়—এটি উত্তরাঞ্চলের মানুষের আশা, অধিকার ও সম্ভাবনার প্রতীক। সিটি হওয়ার ১৩ বছর পরও যদি রংপুরবাসী জেলা শহরের সুবিধাও না পায়, তবে সেটি কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের প্রতীকও বটে।

রংপুরবাসী এখন আর প্রতিশ্রুতি নয়, চায় কার্যকর পদক্ষেপ। নামের সিটি নয়, বাস্তবের সিটি—এ প্রত্যাশাই আজ রংপুরের মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত।

  • মাহামুদুল হক: শিক্ষক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

    ই–মেইল: mahmud_raj@yahoo.com