তুলসীগঙ্গা নদীর কচুরিপানা পরিষ্কার করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। নওগাঁ শহরের রজাকপুর এলাকায়
তুলসীগঙ্গা নদীর কচুরিপানা পরিষ্কার করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। নওগাঁ শহরের রজাকপুর এলাকায়

মতামত

নদীর শত্রু যখন কচুরিপানা

আমাদের দেশের নদী ও জলাশয়গুলোর অনেক বড় শত্রুতে পরিণত হয়েছে কচুরিপানা। ছোট-মাঝারি নদীতে এখন এই পানা এমনভাবে জমাট হয়ে থাকে যে সামান্য পানিও দেখা যায় না। নদীর মাছগুলোর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে নদীতে অন্যান্য যেসব জলজ প্রাণী বেড়ে উঠত তা-ও হয় না। অনেক পাখি নদীতে ছোঁ মেরে মাছ শিকার করলেও পানা থাকলে তা সম্ভব নয়।

অনেক জেলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। কচুরিপানায় ভরে গেলে নদী থেকে মাছ ধরতেও পারেন না। এ অবস্থায় নদীতে নৌকা চলে না। নৌকা চলাচল বাধাগ্রস্ত হলে নৌকার যাত্রীদের কোথাও কোথাও অনেক পথে ঘুরে যেতে হয়। ফলে কচুরিপানা এখন অনেকের জীবন-জীবিকার জন্য হুমকি। পরিবেশের জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত ৩০ নভেম্বর ২০২৫ সমকাল পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় অন্তত ৫৮টি নদী ও খাল কচুরিপানার চাদরে ঢেকে গেছে।’ গত জুলাই মাসে আমি খুলনায় গিয়েছিলাম। তখন দেখে এসেছি খুলনায় অনেক নদীতে কচুরিপানার কারণে পানি দেখা যাচ্ছে না।

যশোরের সাগরদাঁড়িতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভিটায় গিয়েছিলাম। সেখানে কবির কপোতাক্ষ নদ দেখলাম। এ নদ নিয়ে কবি বিখ্যাত ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতা লিখেছেন। এই নদে এতটাই কচুরিপানা যে পানার ওপর দিয়ে শিশু-কিশোরেরা হেঁটে পার হচ্ছে। যশোরে ভবদহে শ্রী নদ দেখলাম পানাভর্তি। যশোর জেলার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে ভৈরব নদ। এ নদও কচুরিপানায় ভরা। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের স্মৃতিঘেরা নদী চিত্রা। নড়াইল জেলার সেই চিত্রা নদীও দেখতে গিয়েছিলাম। চিত্রা নদীতে দেখলাম স্রোত আছে। সেই স্রোতে প্রচুর কচুরিপানা ভেসে আসছে। বুঝতে পারি স্রোতে থেমে গেলেই এ নদীও কচুরিপানায় ভরে উঠবে।

নাটোরের কয়েকটি নদী দেখেছি কচুরিপানায় ভরে আছে। বগুড়া ও পাবনার ইছামতী নদীর অবস্থাও তথৈবচ। রংপুরের অসংখ্য নদীও কচুরিপানায় পূর্ণ। রংপুরের খোকসা ঘাঘট, বুড়াইল, শালমারা নদীতে অনেক স্থানে পানি দেখা যায় না। লালনিরহাটের সতী নদী দেখে বোঝার উপায় নেই এটি একটি পানির প্রবাহ। কুড়িগ্রামে বুড়িতিস্তা নদীতে কেবল পানা দেখা যায়। এককথায় বলা যায়, সারা দেশে যে নদীগুলোয় স্রোত নেই সেগুলো এখন কচুরিপানার উৎপাদনকেন্দ্র। যেগুলোতে সামান্য স্রোত আছে, সেগুলোর স্রোত থেমে গেলেই কচুরিপানার উৎপাদনকেন্দ্র হবে।

কচুরিপানা যে একটি সংকটের নাম, এটি আগে মেনে নিতে হবে। যদি সরকার এটাকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত না করে, তাহলে সমস্যা দূরীকরণে কোনো ব্যবস্থাই হবে না। সমকাল পত্রিকায় যে খবর বেরিয়েছে, এর বাস্তবতা উপলব্ধি করলেও সারা দেশে কচুরিপানার ক্ষতির ভয়াবহতা অনুমান করা সম্ভব।

সারা দেশের নদীগুলোর সর্বনাশকারী কচুরিপানা দূরীকরণে বৃহৎ কোনো পদক্ষেপ অতীতে নেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই। যেহেতু প্রতিবছর কচুরিপানায় নদীগুলোর ক্ষতি সাধিত হয় তাই এগুলো ধ্বংস করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। কচুরিপানার যদি কোনো বিশেষ গুণ থাকে, যাতে কচুরিপানার প্রয়োজন আছে তাহলে সেগুলো টিকিয়ে রাখতে কিংবা উৎপাদনের জন্য আলাদা স্থান নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমানে যেভাবে কচুরিপানার বৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে এতে যদি কচুরিপানা দূর করা না যায়, তাহলে তা নদ-নদীনির্ভর জীববৈচিত্র্যের ভীষণ ক্ষতির কারণ হবে। কচুরিপানা একসময় মরে পচে যায়। তখন লম্বা শিকড়যুক্ত কচুরিপানাগুলো নদীর তলদেশে পড়ে থাকে। নদী দ্রুত ভরাট করার ক্ষেত্রেও এসবের দায় আছে।

কচুরিপানা ছোট, সামান্য লতানো গাছ। এই ভেবে যদি আমাদের অবহেলা চলতেই থাকে তাহলে নিশ্চিত সামান্য কচুরিপানা আমাদের অসামান্য ক্ষতি করবেই।

শুধু নদীতে নয় বিলেও প্রচুর কচুরিপানা আছে। বর্ষায় যখন পানি বাড়ে তখন বিলের পানি চলে যায় নদীতে। বিল থেকেও পানির স্রোতে নদীতে চলে যায় কচুরিপানা। ফলে যে জলাশয়ের সঙ্গে নদীর সংযোগ আছে, সেই জলাশয় এবং নদী উভয় স্থান থেকে এসব দূর করতে হবে। এগুলো দূর করতে সামাজিক সচেতনতাও সৃষ্টি করতে হবে। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ হলে কচুরিপানা থেকে সহজে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

কচুরিপানার ফুল মনকে রাঙিয়ে তোলে। এগুলো একটি স্থানে স্তূপ করে রাখলে সেগুলো সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। জেনেছি এ ফুলের একটি অংশ রান্না করে খাওয়া যায়। উপকারের তুলনায় এর ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি।

নদীগুলো সাধারণত অভিভাবকহীন পড়ে থাকে। এগুলোর পরিচর্যা করার কেউ নেই। দখল হলেও কেউ দেখে না, দূষণ হলেও দেখে না। একইভাবে কচুরিপানার ভয়াবহতাও যেন চোখে পড়ছে না। কচুরিপানা থেকে নদীগুলো রক্ষা করার জন্য নির্দিষ্ট দপ্তরকে দায়িত্ব দিতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এই দায়িত্ব পালনকারী প্রতিষ্ঠান হতে পারে। প্রতিবছর পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব দূরীকরণে বাজেট দেবে। কঠোর নজরদারিতে রাখা সম্ভব হলে নদীগুলোকে কচুরিপানা থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

নদীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে কচুরিপানা অন্তরায়। কচুরিপানার বিষয়ে প্রয়োজনে গবেষণা হতে পারে। কোন প্রক্রিয়ায় গেলে এসব একবারেই দূর করা যাবে, সেই চেষ্টাও আমাদের করতে হবে। এসবের বৃদ্ধি অস্বাভাবিক। সামান্য একটি কচুরিপানার লতা কিংবা শিকড়সহ গাছ পানিতে ফেলে রাখলে বিস্ময়করভাবে বৃদ্ধি পেয়ে একটি জলাশয় কিংবা নদী মাত্র কয়েক দিনে ভর্তি করবে।

আমরা ছোটবেলায় কচুরিপানা নিয়ে একটি ধাঁধা শিখেছি। ধাঁধাটি হলো ‘কচুরিপানা প্রতিদিন তার দ্বিগুণ হয়। একটি পুকুরের অর্ধেক কচুরিপানায় পূর্ণ হতে ৪৯ দিন লাগলে সম্পূর্ণ পুকুরটি পানায় পূর্ণ হতে মোট কত দিন লাগবে?’ এর উত্তর ৫০ দিন। অর্থাৎ বাকি এক দিনেই অর্ধেক পুকুর ভরবে। ধাঁধার মতো আক্ষরিকভাবে এক দিনে অর্ধেক না ভরলেও বাকি অর্ধেক পূর্ণ হতে ৪৯ দিন লাগে না। অল্প দিনের মধ্যেই বাকিটাও ভরে।

কচুরিপানা ছোট, সামান্য লতানো গাছ। এই ভেবে যদি আমাদের অবহেলা চলতেই থাকে তাহলে নিশ্চিত সামান্য কচুরিপানা আমাদের অসামান্য ক্ষতি করবেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতায় লিখেছেন, ‘যে নদী হারায় স্রোত, চলিতে না পারে/ সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে।’ আমাদের ছোট নদীগুলোর পানির উৎস কমে যাওয়ার কারণে এগুলোতে স্রোত আর থাকে না। ফলে খুব সহজেই কচুরিপানা এসব নদীতে দ্রুত বংশ বিস্তার করতে পারে। আমরা চাই কুচরিপানামুক্ত নদী, কচুরিপানামুক্ত জলাশয়।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক