গাজীপুরের সংরক্ষিত বনে ফেলা রাখা বর্জ্য
গাজীপুরের সংরক্ষিত বনে ফেলা রাখা বর্জ্য

মতামত

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: বিপর্যয় নাকি জাতীয় শক্তি?

সম্প্রতি মাওনা, গাজীপুর থেকে ঢাকায় ফেরার পথে এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি। রাস্তার দুই পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে গৃহস্থালি বর্জ্য, বাজারের আবর্জনা, প্লাস্টিক, এমনকি শিল্পকারখানার ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্য। চারদিকে দুর্গন্ধ।

গাজীপুরে অসংখ্য মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পকারখানা রয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিরাপদ বর্জ্য নিষ্পত্তি কার্যত অনুপস্থিত। এ অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলা কেবল ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতার নিদর্শন নয়; বরং এটি এমন এক লজ্জাজনক বার্তা দেয় যে কয়েকজন রাজনৈতিকভাবে সুবিধাভোগী মানুষের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও আমরা এখনো সভ্যতার পথে অনেক পিছিয়ে রয়েছি। ফলে পানি ও মাটি দূষিত হচ্ছে, কৃষি-খাদ্যব্যবস্থা ধ্বংস হচ্ছে এবং জনজীবন রোগবালাইয়ের মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়ছে।

এর ফল স্পষ্ট ও ভয়ংকর। বায়ুদূষণ হচ্ছে। দূষিত পানি ডায়রিয়া ও চর্মরোগ ছড়াচ্ছে। প্লাস্টিক পোড়ানোর ধোঁয়া শ্বাসকষ্ট বাড়াচ্ছে। জমে থাকা আবর্জনা ডেঙ্গুর মতো রোগ বহনকারী মশার জন্মক্ষেত্র তৈরি করছে। আমাদের নদী, খাল, হাওর-বাঁওড় এবং কৃষিজমি ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা খাদ্যনিরাপত্তা, পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। শুধু স্বাস্থ্য নয়, এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবও ভয়াবহ।

দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ, বিশেষ করে নারী ও শিশু, জীবিকার তাগিদে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য সংগ্রহে বাধ্য হচ্ছে, যা তাদের স্বাস্থ্য ও মর্যাদাকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। এ অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সামাজিক বৈষম্য বাড়াচ্ছে এবং আমাদের আন্তর্জাতিক পরিসরে একটি অদক্ষ, অগোছালো ও অসভ্য জাতি হিসেবে চিত্রিত করছে, যা বৈশ্বিক পর্যায়ে আমাদের সুনামকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য তৈরি করে। শহুরে এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩৩ হাজার ৫৭৪ টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত হয় (গৃহস্থালি ও অন্যান্য উৎসসহ)। অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, শহরাঞ্চলের কঠিন বর্জ্যের মধ্যে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত জৈব উপাদান থাকে।

সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করলে এ বিশাল পরিমাণ জৈব বর্জ্যই হতে পারে প্রাণ-উপাদান, যেমন কম্পোস্ট, বায়োগ্যাস বা মাটির গুণবৃদ্ধির সার। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা অনির্ধারিত ও অপরিকল্পিত—বর্জ্য পৃথককরণ, সঠিক সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা নেই; অনেকাংশই রাস্তা, খাল, নদী ও জমিতে ফেলা হয়। আর দেরি না করে আমাদের দেশকে নিরাপদ ও টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পথে হাঁটতেই হবে। কারণ, আজকের অপচয় আগামী দিনের বিপর্যয়।

মানুষ এখনো বর্জ্যকে অমূল্য সম্পদ নয়; বরং ফেলে দেওয়ার জিনিস হিসেবে দেখে। বাড়ি থেকে শুরু করে বাজার ও শিল্পক্ষেত্র পর্যন্ত সবার মধ্যে আলাদা করে বর্জ্য ফেলা, পুনর্ব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। জনসচেতনতা, শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলন ছাড়া কেবল আইন ও নীতি দিয়ে এ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শুধু পরিবেশ নয়, মূলত শাসনব্যবস্থার সংকট। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন শক্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং কার্যকর সংগ্রহ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। কিন্তু স্থানীয় ক্ষমতার দুর্বলতা ও জবাবদিহির অভাবে সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।

একই সঙ্গে মানুষের সচেতনতা বাড়ানো ও আচরণগত পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। কারণ, মানুষ এখনো বর্জ্যকে অমূল্য সম্পদ নয়; বরং ফেলে দেওয়ার জিনিস হিসেবে দেখে। বাড়ি থেকে শুরু করে বাজার ও শিল্পক্ষেত্র পর্যন্ত সবার মধ্যে আলাদা করে বর্জ্য ফেলা, পুনর্ব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। জনসচেতনতা, শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলন ছাড়া কেবল আইন ও নীতি দিয়ে এ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

৩১ দফার রাষ্ট্র মেরামতের কাঠামোর আওতায় বিএনপি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাজনিত এ সমস্যাকে একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ঘরবাড়ি, বাজার ও শিল্পকলকারখানার উৎসে বর্জ্য আলাদা করা, শিল্পবর্জ্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা এবং নিরাপদ নিষ্পত্তি ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ কাজে স্বচ্ছতা আনতে হবে ডিজিটাল ট্র্যাকিং ও জনগণের জন্য তথ্য উন্মুক্ত করার মাধ্যমে।

একই সঙ্গে বিএনপির লক্ষ্য হলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে জাতীয় বিপর্যয় থেকে জাতীয় প্রবৃদ্ধির উপায়ে রূপান্তরিত করা, যেখানে জৈব বর্জ্য থেকে উৎপাদিত হবে বিদ্যুৎ ও বায়োগ্যাস, তৈরি হবে জৈব সার, আর প্লাস্টিক ও অন্যান্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ হবে শিল্পের কাঁচামাল। শুধু কঠোর নিয়ন্ত্রণ নয়, বিএনপি সর্বস্তরে ব্যাপক জাতীয় সচেতনতা তৈরি করতে চায়, যাতে গৃহস্থালি থেকে শুরু করে শিল্পক্ষেত্র পর্যন্ত প্রত্যেকে নিরাপদ ও উৎপাদনশীলভাবে সব ধরনের বর্জ্য, এমনকি তরল বর্জ্যও ব্যবস্থাপনা করতে শেখে।

মাওনা থেকে ঢাকার সড়ক কোনোভাবেই আবর্জনার করিডর হতে পারে না। এটি হতে হবে সমাধানের করিডর, যেখানে বর্জ্য সঠিকভাবে সংগ্রহ হবে, শিল্পকারখানাকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে এবং জৈব আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ ও সার তৈরি হবে। যদি আমরা ব্যর্থ হই, খেসারত দিতে হবে রোগ, দূষণ ও কৃষির ক্ষতিতে। যদি সফল হই, বাংলাদেশ দেখাতে পারবে কীভাবে বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতিকে একসঙ্গে এগিয়ে নেওয়া যায়।

পথ দুটি স্পষ্ট। আবর্জনা হয় রোগ ছড়াবে, নয়তো জাতীয় শক্তিতে রূপান্তরিত হবে। বিএনপির ৩১ দফা রূপরেখা এবং তারেক রহমানের দৃষ্টি আমাদের সামনে সেই দিকনির্দেশনা রেখেছে। এখন সিদ্ধান্ত আমাদের।

  • ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং বিশ্বব্যাংকের সাবেক সিনিয়র স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিশেষজ্ঞ