মতামত

জোটের রাজনীতি, কৌশল ও জামায়াতের কৃষ্ণ নন্দী

দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার মধ্যেও বিএনপি যে নির্বাচনী মাঠ সাজানোর কাজ থেকে পিছিয়ে নেই, তার প্রমাণ পাওয়া গেল আরও ৩৬টি আসনে তাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা নিয়ে।

বিএনপির নেতাদের দাবি, দলীয় মনোনয়নপত্র কেনা নিয়ে যে বাণিজ্য হয়, সেটি এড়াতে তাঁরা মনোনয়নপত্র বিক্রি ও জমা দেওয়ার পুরোনো রীতিটি বাদ দিয়েছেন। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিরপেক্ষ সংস্থা দিয়ে প্রতিটি আসনে জনমত যাচাই করার পরই চূড়ান্ত তালিকা করা হয়েছে। তারপরও বিতর্কের অবসান হয়নি। অনেক স্থানে মনোনয়নবঞ্চিত নেতার কর্মী–সমর্থকেরা প্রতিবাদ করেছেন। সড়ক অবরোধ ও হানাহানির ঘটনাও ঘটেছে।

এর আগে দলটির পক্ষ থেকে ২৩৬টি আসনে দলীয় প্রার্থীর কথা জানানো হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, মিত্র দলগুলোকে কিছু আসন ছেড়ে দেওয়া হবে। আর কিছু আসনে অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে প্রার্থীর নাম ঘোষণা স্থগিত রাখা হয়েছিল।

সব মিলিয়ে বিএনপি ২৭২টি আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করল। বাকি থাকে ২৮টি আসন। বিএনপির মিত্র ও জোটসঙ্গী দলের সংখ্যা অনেক। ১২–দলীয় জোট, গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি দল ছাড়াও অনেক দলই বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে আগ্রহী বলে জানা গেছে। যেখানে বিএনপির নিজেরই প্রতিটি আসনে একাধিক যোগ্য প্রার্থী, সেখানে অন্যদের জন্য আসন ছাড়া কঠিন।

তারপরও বিএনপি যাঁদের জন্য আসন ছেড়ে দিতে পারে, তাঁদের মধ্যে অনেকের নাম শোনা যাচ্ছে। যেমন বগুড়া-২ আসনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা-১৭ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ, লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম রব, ঢাকা–১৩ আসনে এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, পটুয়াখালী-৩ আসনে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও ঝিনাইদহ-২ আসনে দলের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। কিন্তু এসব আসনে বিএনপিরই একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী আছেন। অনেকে প্রচারও চালাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত জোটের মীমাংসা বিএনপি কীভাবে করে, সেটিই দেখার বিষয়।

বিএনপি যে একসঙ্গে আন্দোলন, একসঙ্গে নির্বাচন ও একসঙ্গে সরকার গঠনের নীতি নিয়েছিল, সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এত দিন রাজনৈতিক মহলে বিএনপির জোটসঙ্গী হবেন বলে যাঁরা আলোচনায় ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ হতাশ হয়ে বিএনপি বা জামায়াতের বলয়ের বাইরে গিয়ে জোট ও ভোট করার চিন্তা করছেন। নিজেদের মধ্যে আলোচনাও চালাচ্ছেন। আবার অনেকে বলছেন, এই দুই বলয়ের বাইরে গিয়ে জোট করলে নির্বাচনী মাঠে সুফল পাওয়া যাবে না।

জোটে যাওয়া না–যাওয়া নিয়ে সবচেয়ে বেকায়দায় আছে আট মাস আগে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি। তারা এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি জোটগতভাবে নির্বাচন করবে, নাকি আলাদা নির্বাচন করবে। বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী, এনসিপি যাত্রারম্ভের সময় জনমনে যে উদ্দীপনা তৈরি করেছিল, সেটি এখন আর নেই।

বাংলাদেশে জোটের রাজনীতি খুব সফল হয়েছে বলা যায় না। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ত্রিদলীয় জোট হয়েছিল, যা সরকারকে রক্ষা করতে পারেনি। জিয়াউর রহমান গঠিত জাতীয়তাবাদী ঐক্যফ্রন্টের সবাই তাঁর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত থাকেনি।

আশির দশকে এরশাদবিরোধী ১৫–দলীয়, ৭–দলীয় জোটও অটুট থাকেনি। অনেক নেতা দিনে গরম বক্তৃতা দিয়ে রাতে এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন। নব্বইয়ের শেষার্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐকজোট মিলে চারদলীয় জোট হয়। পরে এরশাদ সেই জোট থেকে বেরিয়ে আসেন, তাঁর কোনো কোনো ভগ্নাংশ বিএনপির সঙ্গে থেকে যায়। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে মহাজোট হয়েছিল, তাদের সবাই পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারে জায়গা পায়নি।

জোটের রাজনীতিতে কিছুটা ঝুঁকি ও কিছুটা কৌশল নিতে হয়। বিএনপির ক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও জামায়াতে সেই সমস্যা নেই। জামায়াতের ওই নেতা বলেছেন, তাঁরা যদি সিদ্ধান্ত নেন আমির নির্বাচন করবেন না, সেটিও তিনি মেনে নেবেন। ব্যক্তির চেয়ে দলের স্বার্থ বড়।

সম্প্রতি জামায়াতের এক নেতার সঙ্গে কথা হয় ৮–দলীয় জোট নিয়ে। তিনি বলেছেন, তাঁরা কোনো নির্বাচনী জোট করতে যাচ্ছেন না। তবে আসন সমঝোতা হতে পারে। যেখানে আট দলের অন্য শরিকেরা প্রার্থী দেবে, বিচার করে দেখা হবে তাঁর জেতার সম্ভাবনা কতটা। জামায়াতের প্রার্থীর চেয়ে কেউ বেশি জনপ্রিয় হলে তাঁর জন্য আসন ছেড়ে দেওয়া হবে। বিপরীতে যেখানে জামায়াতের প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা আছে, সেখানে তাঁদের আসন ছেড়ে দিতে হবে।

একই কথা বিএনপির নেতাদেরও। তাঁরা বলেছেন, বিএনপির যোগ্যতর প্রার্থীকে বাদ দিয়ে শরিক দলকে ছেড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখতে হবে, সেখানে তাঁর জিতে আসার সম্ভাবনা কতটা। অন্যথায় সেই আসনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থী জিতে আসবেন এবং বিএনপি আসন হারাবে।

জোটের রাজনীতিতে কিছুটা ঝুঁকি ও কিছুটা কৌশল নিতে হয়। বিএনপির ক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও জামায়াতে সেই সমস্যা নেই। জামায়াতের ওই নেতা বলেছেন, তাঁরা যদি সিদ্ধান্ত নেন আমির নির্বাচন করবেন না, সেটিও তিনি মেনে নেবেন। ব্যক্তির চেয়ে দলের স্বার্থ বড়।

জামায়াতে ইসলামী যে দলের স্বার্থ বড় করে দেখে তার আরেকটি উদাহরণ হলো খুলনা-১ আসনে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বীকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া। হিন্দু–অধ্যুষিত এ আসনে দলটি ডুমুরিয়া উপজেলা হিন্দু কমিটির সভাপতি কৃষ্ণ নন্দীকে চূড়ান্ত প্রার্থী করেছে। এ সিদ্ধান্ত তারা হঠাৎ নেয়নি।

কৃষ্ণ নন্দী জামায়াতের অঙ্গসংগঠন হিন্দু কমিটির ডুমুরিয়া উপজেলা শাখার সভাপতি। তিনি জামায়াতের মনোনয়নের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘১ ডিসেম্বর আমাকে কেন্দ্রে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে জামায়াত আমিরসহ উচ্চপর্যায়ের নেতারা ছিলেন। তাঁরা আমাকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। আমি তাঁদের নির্দেশনা পেয়েছি। এলাকায় গিয়ে কাজ শুরু করব।’

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর এসেছে, তাতে দেখা যায়, কৃষ্ণ নন্দী আওয়ামী লীগের শাসনামলে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছবি এখন ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

১৯৭৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সব নির্বাচনে এই আসন থেকে সংখ্যালঘু প্রার্থীই জিতে এসেছেন। একবার আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা এই আসন থেকে জিতলেও উপনির্বাচনে তাঁর মনোনীত সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রার্থী হেরে গিয়েছিলেন। জয়ী হয়েছিলেন তাঁরই দলের সংখ্যালঘু স্বতন্ত্র প্রার্থী।

এ বাস্তবতা থেকেই সম্ভবত জামায়াতে ইসলামী সনাতন ধর্মের একজন প্রার্থীকেই বেছে নিয়েছে। এটা কি জামায়াতের রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তন, না নিছক ভোটে জেতার কৌশল, তা হয়তো ভবিষ্যতেই জানা যাবে। তবে আমরা নির্বাচনী রাজনীতিতে একটা উদ্বেগজনক প্রবণতা লক্ষ করছি। জামায়াতের মতো ধর্মভিত্তিক দল যখন ধর্মের কথা কম বলে সৎ লোকের শাসনের ওপর জোর দিচ্ছে, তখন মধ্যপন্থী দলগুলো আরও বেশি ধর্মের কথা বলে ভোটারদের মন জয় করতে চাইছে। রাজনীতির এ প্রবণতা মোটেই আমাদের সামনে এগোতে সাহায্য করবে না।

সোহরাব হাসান সাংবাদিক ও কবি

*মতামত লেখকের নিজস্ব