সম্মেলনের ছবিতে একসঙ্গে চীনের সি চিন পিং ও রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ভারতের নরেন্দ্র মোদিকে দেখা যাচ্ছে।
সম্মেলনের ছবিতে একসঙ্গে চীনের সি চিন পিং ও রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ভারতের নরেন্দ্র মোদিকে দেখা যাচ্ছে।

মতামত

ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সাহস নেই মোদির

চীনের তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনটি সারা বিশ্বের মনোযোগে কেড়েছে। বিশ্লেষকদের আলোচনার বড় অংশটি জুড়ে ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি বিষয়ে। সাত বছর পর তিনি চীন সফরে গিয়েছিলেন। সম্মেলনের ছবিতে একসঙ্গে চীনের সি চিন পিং ও রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ভারতের নরেন্দ্র মোদিকে দেখা যাচ্ছে।

এটি দুটি বয়ানকে সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমটি হলো—মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের রপ্তানি পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপ করার পর মোদি চীনের দিকে ঝুঁকছেন। অর্থাৎ ট্রাম্প একজন মার্কিন মিত্রকে মার্কিন প্রতিপক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। দ্বিতীয়টা হলো—তিয়ানজিনে মোদির উপস্থিতি নতুন এক বৈশ্বিক জোটের উত্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে চীন নেতৃত্ব দেবে আর রাশিয়া ও ভারত চীনকে সমর্থন দেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।

আমার মতে, এই দুই সিদ্ধান্তেই তাড়াহুড়া করে পৌঁছানো হচ্ছে। দুই ক্ষেত্রেই বিশ্লেষকেরা ভারতের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। আসল ব্যাপার হচ্ছে ভারতের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

এটা অস্বীকারের উপায় নেই যে ভারতের প্রতি ট্রাম্পের আচরণ অবমাননাকর। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতের রপ্তানি পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, তার পেছনে বড় একটা কারণ তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষোভ।

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি করানোর মিথ্যা কৃতিত্ব দাবি করার ট্রাম্প চাইছিলেন, নরেন্দ্র মোদি প্রকাশ্যে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবে এবং তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সেটা করেছিলেনও, কিন্তু মোদি সেটা করেননি। এতে ট্রাম্প ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।

এরপরই ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্কের খড়্গ নেমে আসে। ভারতের অর্থনীতিকে ‘মৃত অর্থনীতি’ বলে তিনি তাচ্ছিল্য করেন। এতে মোদির পক্ষে দীর্ঘদিন ধরে বলা সেই বক্তব্য, মানে ট্রাম্প তাঁর বিশেষ একজন বন্ধু, এটা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

কয়েক মাস ধরে নয়াদিল্লির কর্মকর্তারা দাবি করে আসছিলেন, এশিয়ায় ট্রাম্পের প্রধান ভরসার জায়গা হলের তাঁদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনকে মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ভারতের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এখন ট্রাম্প দেখিয়ে দিয়েছেন যে মোদি বা ভারতকে আসলে তিনি তোয়াক্কাই করেন না।

এটা মনে করা যৌক্তিক হবে যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কসংক্রান্ত আলোচনাগুলো ভিন্নভাবে এগোলে, মোদি হয়তো তিয়ানজিনে যেতেন না।

এই মুহূর্তে নয়াদিল্লির কূটনীতিক ও লবিস্টরা ওয়াশিংটনে দুই দেশের সম্পর্ক মিটমাটের চেষ্টা করছেন। তারা হয়তো ভেবেছিলেন, তিয়ানজিনে মোদি ও সি চিন পিংয়ের হাসিমুখের ছবি দেখে ট্রাম্প আতঙ্কিত হবেন এবং মার্কিন মিত্র হারানোর শঙ্কায় উদ্বিগ্ন হবেন। কিন্তু মোদির তিয়ানজিন সফর নিয়ে ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া ছিল তাচ্ছিল্যপূর্ণ। তিনি দাবি করেন, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর সব শুল্ক বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছে।

একটা বিষয় হলো, মোদি দীর্ঘদিন ধরেই সি চিন পিংকে এমন সন্দেহের চোখে দেখেছেন, যেটা বৈরিতার কাছাকাছি। ভারতের প্রতি চীনের নীতি নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশে তিনি বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটিতে সফরে করতেও বিরত ছিলেন।

পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দেওয়া এবং ভারতের ভূখণ্ড নিজেদের বলে দাবি করা, সীমান্ত দখল ও সংঘর্ষ—এসব কারণে চীনের প্রতি বৈরি ছিলেন মোদি।

আবার তিয়ানজিন সম্মেলনে আসা অনেক নেতার সঙ্গ পেতেও মোদি মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। যেমন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ কিংবা তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এরদোয়ানকে সম্প্রতি প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছে নয়াদিল্লি। কারণ, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনি প্রকাশ্যে ইসলামাবাদের পক্ষ নিয়েছিলেন।

সম্মেলনে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ দেশের নেতারাই ছিলেন একধরনের স্বৈরশাসক (যেমন ইরানের মাসউদ পেজেশকিয়ান কিংবা বেলারুশের আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কো)।

আসলে স্বৈরশাসকদের সমাবেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি একধরনের গণতান্ত্রিক প্রলেপ দিয়েছিল (ইন্দোনেশিয়ার প্রাবোও সুবিয়ান্তো শেষ মুহূর্তে সফর বাতিল করেছিলেন।) এতে সি চিন পিংয়ের অহং ও ভূরাজনৈতিক উচ্চকাঙ্ক্ষা তৃপ্ত করেছে। ভ্লাদিমির পুতিনও এতে খুশি হয়েছেন নিশ্চয়ই, কারণ, এশিয়ার দুই পরাশক্তিকে কাছাকাছি আনার কৃতিত্ব তিনি দাবি করতে পারেন।

এর ফলে আমেরিকার প্রধান ভরসা থেকে মোদি পরিণত হয়েছেন চীনের ভোজসভায় ‘তৃতীয় সারির অতিথিতে’। তিয়ানজিনে ক্যামেরার সামনে যতই মোদি হাসিমুখে দাঁড়ান না কেন, এই মর্যাদাহানিকে তিনি আড়াল করতে পারেননি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরে গিয়ে পূর্বমুখী হচ্ছে। নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের সেই সামর্থ্য নেই।

সবকিছুর মূলে আছে অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের বার্ষিক রপ্তানি প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি, সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশনের সব সদস্যদেশ মিলিয়ে ভারতের মোট রপ্তানির চেয়ে এর পরিমাণ অনেক বেশি। সি ও পুতিন মোদির সঙ্গে হাসতে পারেন কিন্তু ট্রাম্পের শুল্কের ফলে যে রাজস্ব ক্ষতি হবে, সেটা পূরণ করতে পারবেন না। চীন ও রাশিয়া ভারতের কাছ থেকে আরও কিনতে চায় না, বরং নিজেদের পণ্য আরও বেশি বিক্রি করতে চায়।

এখানে ভূরাজনীতির সমীকরণটাও মুখ্য। চীনা ড্রাগন ও ভারতীয় হাতির বন্ধুত্বের কথা যতই বলা হোক না কেন, বাস্তবতা হলো বেইজিং নয়াদিল্লিকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই দেখে। আর চীন ভারতকে এমন এক প্রতিযোগী হিসেবে দেখে, যাকে মাঝেমধ্যে কঠোরভাবে মোকাবিলা করা দরকার। সে কারণে চীন পাকিস্তানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে থাকবে এবং ভারতের বিশাল ভূখণ্ডের ওপর দাবি চালিয়ে যাবে।

তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক জোট থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না ভারত। এমন সামরিক জোট ভারতের জন্য অস্তিত্বগত নিরাপত্তার বিষয়।

এই কারণগুলোর জন্যই মোদি জানেন যে ওয়াশিংটনের কক্ষপথ থেকে তিনি খুব দূরে সরে যেতে পারেন না। তাঁকে ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য কোনোভাবে মর্যাদা রক্ষার পথ খুঁজে বের করতে হবে। কেননা, ভারতের অর্থনীতি ও নিরাপত্তা এর ওপর নির্ভর করছে।

এই মুহূর্তে নয়াদিল্লির কূটনীতিক ও লবিস্টরা ওয়াশিংটনে দুই দেশের সম্পর্ক মিটমাটের চেষ্টা করছেন। তারা হয়তো ভেবেছিলেন, তিয়ানজিনে মোদি ও সি চিন পিংয়ের হাসিমুখের ছবি দেখে ট্রাম্প আতঙ্কিত হবেন এবং মার্কিন মিত্র হারানোর শঙ্কায় উদ্বিগ্ন হবেন। কিন্তু মোদির তিয়ানজিন সফর নিয়ে ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া ছিল তাচ্ছিল্যপূর্ণ। তিনি দাবি করেন, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর সব শুল্ক বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছে।

এ বিষয়ে সি চিন পিংয়ের নজর এড়িয়ে যাবে না। ভূরাজনৈতিক সমীকরণে সব সময়ই বাস্তবদর্শী চীনা প্রেসিডেন্ট জানবেন যে তাঁর ভোজসভায় মোদির উপস্থিতি ছিল সর্বোচ্চ কৌশলগত সুবিধা আদায়ের জন্য, এটি কোনো সুন্দর বন্ধুত্বের সূচনাবিন্দু নয়।

  • ববি ঘোষ টাইম ম্যাগাজিনের সাবেক পররাষ্ট্রবিষয়ক সংবাদদাতা ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক
    টাইম ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত