
২২ এপ্রিল যশোরে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ‘মব জাস্টিস আর অ্যালাউ (অনুমোদন) করা যাবে না’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম, দেরিতে হলেও সরকারের হুঁশ ফিরে এসেছে এবং মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে তারা কঠোর অবস্থান নেবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যাকে ‘মব জাস্টিস’ বলছেন, সেটা আসলে মব ভায়োলেন্স। রাস্তাঘাটে ঘরে বাইরে কোনো অজুহাত পেলেই একধরনের মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী, দুর্বলের ওপর সবলের সহিংসতা। কবি যেমন বলেছেন, বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে কিন্তু মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত মানুষগুলো এতটাই অসহায় যে থানা পুলিশ কিংবা আদালতেও যেতে ভয় পান।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ওই ঘোষণার পরও মব ভায়োলেন্স বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন স্থানে নারী ও সংখ্যালঘুরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। সেদিন দেখলাম, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একদল লোক বিদ্যালয়ে ঢুকে প্রধান শিক্ষককে হেনস্তা করছেন এবং তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তাঁরা আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারতেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সেই সভায় যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছেন, সেটি হলো ১৫ হাজার বোতল ফেনসিডিল ছেড়ে দিয়ে ৫০০ বোতল ‘রিকভার’ (উদ্ধার) দেখানো। কারা দেখাচ্ছেন? কারা মাদকদ্রব্য উদ্ধার করছেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কেউ পুলিশের লোক, কেউবা র্যাবের।
আওয়ামী লীগ সরকার মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখিয়েছিল, মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বহু মানুষ হত্যা করেছিল। কিন্তু তারপরও দেশ মাদক ও সন্ত্রাসের নিরাপদ ভূমি হওয়ার কারণ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ওই বক্তব্য। তাঁরা ১৫ হাজার বোতল ফেনসিডিল ছেড়ে দিয়ে ৫০০ বোতল ধরেছেন। অর্থাৎ ৩০ ভাগের একভাগ ধরেছেন, ২৯ ভাগই বাজারজাত হয়েছে।
গত সোমবার বরিশালের আগৈলঝাড়ায় র্যাবের মাদকবিরোধী অভিযানের সময় সিয়াম মোল্লা নামে কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হয়। তার আহত রাকিব মোল্লা এখন বরিশালে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। র্যাবের দাবি অনুযায়ী তাঁরা নাকি দুর্ধর্ষ মাদকব্যবসায়ী। র্যাব সদস্যরা যেই মাদকবিরোধী অভিযানে ঘটনাস্থলে গিয়েছেন, অমনি তাদের ওপর হামলা করেছেন ওই দুই শিশু কিশোর। তারা শিশু কিশোরই।
জন্মনিবন্ধনের তথ্য অনুযায়ী নিহত সিয়ামের জন্ম ২০০৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। মৃত্যুর দিন ২১ এপ্রিল তার বয়স হয়েছিল ১৭ বছর ১ মাস ২৮ দিন। আর রাকিবের জন্ম ২০০৭ সালের ১ আগস্ট। সেই হিসাবে তার বয়স ১৭ বছর ৮ মাস ২০ দিন। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী দুজনই শিশু-কিশোর।
অবশ্য র্যাব অভিযানের ‘ন্যায্যতা’ প্রমাণ করতে নিহত সিয়াম মোল্লার বয়স ২২ ও আহত রাকিব মোল্লার বয়স ২১ বছর বলে উল্লেখ করেছে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, ওই দুই শিক্ষার্থী মাদক ব্যবসায়ী কিংবা মাদকাসক্ত ছিল না।
হত্যার প্রতিবাদে উজিরপুরের সাহেবের হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে মানববন্ধন করেছেন এলাকাবাসী ও শিক্ষার্থীরা। নিহত সিয়াম এই বিদ্যালয় থেকে গতবার এসএসসি পাস করে একই এলাকার আইডিয়াল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। আর রাকিব মোল্লা এ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।
সিয়াম মাদক ব্যবসা করত কি করত না, সেটি প্রমাণের পথ র্যাবই বন্ধ করে দিয়েছে। মৃত মানুষ তো আর সাক্ষ্য দিতে পারবে না। র্যাবের দাবি যদি সত্যও ধরে নেওয়া হয়, তাহলেও কি কলেজ পড়ুয়াকে এক কিশোরকে এভাবে গুলি করে হত্যা করা যায়? সিয়ামের মৃত্যুর পর তার বাবা রিপন মোল্লা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা কী করবেন? আমার পোলারে ফিরাইয়্যা দেতে পারবেন? লেইখ্যা কী অইবে, আমি আল্লার কাছে বিচার দিলাম।’
র্যাবের দাবি, মাদক ব্যবসায়ীদের ধরার জন্য র্যাব সদস্যরা অভিযানে গেলে সেখানে মাদক ব্যবসায়ী ১০-১১ জন মিলে তাঁদের ওপর হামলা করেন। এরপর আত্মরক্ষার্থে র্যাব সদস্যরা গুলি করতে বাধ্য হন। তাদের এ সাফাই বক্তব্য আওয়ামী লীগ আমলে বন্দুকযুদ্ধে শত শত মানুষ নিহত হওয়ার কথাই মনে করিয়ে দেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে র্যাব ও পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি করার কথা বলে বন্দুকযুদ্ধে মানুষ মারাকে জায়েজ করতে চায়।
গত বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিলেও কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে মানুষ হত্যা বন্ধ হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও সেই একই আত্মরক্ষার্থে গুলি কিংবা বন্দুকযুদ্ধের বয়ান দেওয়া হয়।
পুলিশের ভাষ্য, গত সোমবার সন্ধ্যায় আগৈলঝাড়ার রত্নপুর ইউনিয়নের মোল্লাপাড়ায় সাদাপোশাকে র্যাব-৮-এর মাদকবিরোধী অভিযানে গুলিবিদ্ধ হয়ে সিয়াম মোল্লা নিহত হয়। তাঁর খালাতো ভাই আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাই মারা গেছে। এতে যতটা না কষ্ট পাচ্ছি, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছি, তাদের দুজনকে মাদক ব্যবসায়ী আখ্যা দেওয়ায়। দয়া করে এটি আপনারা গণমাধ্যমে তুলে ধরুন। তারা শিশু-কিশোর, মাদকাসক্ত ছিল না।’
সিয়াম মাদক ব্যবসা করত কি করত না, সেটি প্রমাণের পথ র্যাবই বন্ধ করে দিয়েছে। মৃত মানুষ তো আর সাক্ষ্য দিতে পারবে না। র্যাবের দাবি যদি সত্যও ধরে নেওয়া হয়, তাহলেও কি কলেজ পড়ুয়াকে এক কিশোরকে এভাবে গুলি করে হত্যা করা যায়?
সিয়ামের মৃত্যুর পর তার বাবা রিপন মোল্লা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা কী করবেন? আমার পোলারে ফিরাইয়্যা দেতে পারবেন? লেইখ্যা কী অইবে, আমি আল্লার কাছে বিচার দিলাম।’
মাদকবিরোধী অভিযানে গুলির ঘটনায় আগৈলঝাড়া থানায় দুটি মামলা হয়েছে। র্যাব-৮-এর পক্ষে জ্যেষ্ঠ ওয়ারেন্ট অফিসার শেখ রিয়াজুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা দুটি করেন। মামলায় আহত রাকিব মোল্লাকে আসামি করা হয়েছে। কিন্তু সিয়াম যে র্যাবের গুলিতে মারা গেল, সে জন্য থানায় কোনো মামলা হলো না। র্যাব বলেছে, দু্ই শিক্ষার্থীকে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত করলেও থানায় তাদের বিরুদ্ধে আগে কোনো অভিযোগ ছিল না।
আগৈলঝাড়ায় র্যাবের হাতে কিশোর সিয়ামের নিহত হওয়ার ঘটনা আমাদের ১৪ বছর আগে ঝালকাঠীর রাজাপুর উপজেলার লিমন হোসেনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। লিমন ২০১১ সালের ২৩ মার্চ মাঠ থেকে গরু আনতে গিয়ে র্যাবের গুলিতে পা হারান। তিনি তখন ছিলেন একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। প্রতিবেশী এক পরিবারের সঙ্গে জমি নিয়ে তাঁদের দ্বন্দ্ব ছিল। ওই পরিবার লিমনের পরিবারকে শায়েস্তা করতে র্যাবকে ব্যবহার করে। র্যাব সদস্যদের এ রকম ভাড়া খাটার আরও অনেক উদাহরণ আছে। সে সময় র্যাবের গুলিতে লিমনের পা হারানোর খবর প্রথম আলোয় ছাপা হলে চারদিকে শোরগোল ওঠে।
র্যাব নিজেদের অপরাধ ঢাকতে লিমনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে। বলা হয়েছিল, লিমন র্যাবকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে বাধা দিয়েছে। সেখানেও র্যাব আত্মরক্ষার্থে গুলি করা হয়েছে বলে দাবি করেছিল।
বর্তমানে গণবিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শিক্ষক লিমন ক্ষমতার পালাবদলের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে র্যাবের সাবেক ৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পায়ের বিনিময়ে কোনো ক্ষতিপূরণ যথোপযুক্ত হয় না। তারপরও দেশের আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ চান তিনি। র্যাবের গুলিতে আহত হয়েছিলেন বলে লিমন মামলা করতে পেরেছেন। কিন্তু র্যারের গুলিতে নিহত সিয়ামের সেই সুযোগও নেই।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যেই মব জাস্টিস বন্ধ করার কথা বলেছেন, সেটা সর্বক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হওয়া উচিত। কেউ অপরাধ করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব তাকে আদালতে সোপর্দ করা। আদালতই তার শাস্তি দেওয়ার মালিক। কিন্তু সেটা না করে তারা যদি নিজেরাই শাস্তির দায়িত্ব নিয়ে নেয়, তাহলে তো আদালত থাকার প্রয়োজন পড়ে না।
আগৈলঝাড়ায় র্যাবের অভিযান ও সিয়ামের নিহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হলে রাজাপুরের লিমনকে গুলি করা কিংবা কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনাহ হত্যার মতো কোনো রহস্য বেরিয়েও আসতে পারে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com