
বেকার তরুণ-তরুণীদের ব্যথা-বেদনা কেউ বুঝতে চান না। বুঝলেও না বোঝার ভান করেন। উল্টো তাঁদের ওপর বোঝা চাপিয়ে দিতে তিলার্ধ কুণ্ঠাবোধ করেন না। একটু মানবিক ও মায়াবী দৃষ্টিতে তাঁদের মলিন মুখের দিকে চাওয়ার যেন কেউ নেই। সবকিছুর দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে ইচ্ছেমতো বাড়ানো হচ্ছে চাকরির আবেদন ফি।
সম্প্রতি রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৫ম থেকে ২০তম গ্রেডে ১৩টি পদে ২১ জন নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির সব পদেই আবেদন ফি সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে দ্বিগুণ থেকে চার গুণ পর্যন্ত বেশি চাওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, পঞ্চম গ্রেডের (প্রথম শ্রেণি) উপপরিচালক (হিসাব) পদে টেলিটকের সার্ভিস চার্জসহ আবেদন ফি চাওয়া হয়েছে ১ হাজার ৩২০ টাকা। নবম গ্রেডের (প্রথম শ্রেণি) পদগুলোর জন্য আবেদন ফি ধরা হয়েছে ১ হাজার ১০০ টাকা, দশম গ্রেডের (দ্বিতীয় শ্রেণি) জন্য ৮৮০ টাকা, ১১তম থেকে ১৬তম গ্রেডের (তৃতীয় শ্রেণি) জন্য ৬৬০ টাকা ও ২০তম গ্রেডের (চতুর্থ শ্রেণি) জন্য টেলিটকের সার্ভিস চার্জসহ আবেদন ফি চাওয়া হয়েছে ৫৫০ টাকা। (সূত্র: প্রথম আলো, ২৪ মার্চ, ২০২৩)।
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চাকরিপ্রার্থীরা। এ ছাড়া গত বছর ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) সহকারী প্রকৌশলী পদে আবেদন ফি চাওয়া হয়েছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা। বর্ধিত এমন ফি বেকারদের ওপর অসহনীয় বোঝা।
দেশে এখন ২৬ লক্ষাধিক বেকার রয়েছেন বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়। বাস্তবে এই সংখ্যা বেশি ছাড়া কম হবে না। নানা সংকট আর চাপের মধ্য দিয়ে এই বেকারদের দিন পার করতে হয়। পরিবার ও সমাজের নানা কটুকথা হজম করে তাঁদের চলতে হয়। আছে ব্যক্তিগত জীবনের হতাশাও। সময় মতো চাকরি না পাওয়ায় অনেকের প্রিয়তমা প্রেমিকাও জীবন থেকে হারিয়ে যায়। কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়ে অনেক তরুণী তাঁর স্বপ্নের মানুষটিকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেন না।
সাধারণত বেশির ভাগ বেকার-যুবক পরিবার থেকে দূরে থেকে চাকরি বা অন্য কোনো কর্মসংস্থানের চেষ্টা চালিয়ে যান। আমাদের দেশের অভিভাবকেরা সন্তান স্নাতক পাস করার পরপরই বাড়ি থেকে আর টাকা দিতে চান না। উল্টো সন্তানের উপার্জনের দিকে মুখিয়ে থাকেন। বাস্তবতা হলো স্নাতক পাস করার পরপরই বেশির ভাগ তরুণের কপালেই চাকরি জোটে না।
গত বছর সরকারি চাকরিতে আবেদন ফি বাড়ানো হয়েছে। গেল বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো অনলাইনের খবরে বলা হয়, সরকারি সব চাকরির (ক্যাডার পদ বাদে) আবেদন ফি পুনরায় নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, দপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরির জন্য এই ফি প্রযোজ্য হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ৯ম গ্রেড বা এর বেশি গ্রেডভুক্ত (নন-ক্যাডার) পদে আবেদন ফি ৬০০ টাকা, ১০ম গ্রেডের পদে আবেদন ফি ৫০০ টাকা, ১১ থেকে ১২তম গ্রেডের জন্য ৩০০ টাকা, ১৩ থেকে ১৬তম গ্রেডের জন্য ২০০ টাকা এবং ১৭ থেকে ২০তম গ্রেডের জন্য ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এমন প্রজ্ঞাপন দেখেই চাকরিপ্রত্যাশীরা ক্ষুব্ধ হন। বিভিন্ন সময় এর প্রতিবাদে তাঁরা মানববন্ধনও করেন। গত ২৫ মার্চ চাকরিতে আবেদনের বয়স বাড়ানো ও আবেদন ফি কমানোর দাবি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন করেছেন চাকরিপ্রার্থীরা। কিন্তু তাঁরা কোনো ফল পাননি। কোনো কোনো বেকার যুবককে আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায়, ‘দেশের এত এত টাকা দুর্নীতি ও লুটপাট হয়, বেকারদের জন্য একটু ছাড় দিলে কী হয়?’
আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকার সময় আবেদন ফি ছাড়াই অর্থাৎ বিনা মূল্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের অনলাইনের আবেদনের সুযোগ করে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তিনি গভর্নর পদ থেকে সরে যাওয়ার পর আবার ব্যাংকে আবেদন ফি নেওয়া শুরু হয়েছে।
ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২০০ টাকা। অবশ্য তাঁর বিনা মূল্যে আবেদনের সুযোগের মডেলটি এখন শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ক্ষেত্রে কার্যকর আছে।
৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা আগামী ১৯ মে। ছয় বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএসে সবচেয়ে কম আবেদন করেছেন। আবেদনকারীর সংখ্যা ৩ লাখ ১৮ হাজার। এবারও হয়তো ১৫ থেকে ২০ হাজার চাকরি প্রার্থী প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন। কিন্তু বাধ্যতামূলক ৭০০ টাকা গুনতে হয়েছে সব আবেদনকারীকেই
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) দফায় দফায় আবেদন ফি নেওয়া ও চাকরি প্রার্থীদের হতাশা-হয়রানি নিয়ে প্রায় দেড় বছর আগে প্রথম আলো অনলাইনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সে সময় শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, 'যারা যেখানে সুযোগ পাচ্ছে ঠকাচ্ছে। দেশে বেকারত্ব একটি সমস্যা। সবার উচিত বেকারদের সহযোগিতা করা। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টোটা। বেকারদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি নেওয়া উচিত নয়। পরীক্ষা খরচের জন্য আবেদন ফি ১০০ টাকা নিলেই হয়। এসব বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কেউ যাতে মানুষকে ঠকাতে না পারে, সে জন্য সরকারকে নজরদারি করতে হবে।'
৪৪তম বিসিএসে মোট আবেদন করেছিলেন ৩ লাখ ৫০ হাজার ৭১৬ জন প্রার্থী। এর মধ্যে ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষার জন্য মনোনীত হন ১৫ হাজার ৭০৮ জন। এই প্রার্থীদের কয়েক দফায় ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষা খরচ বাবদ তাঁদের কাছ থেকে ৭০০ টাকা নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু বাকি ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৮ জন, যাঁরা শুধু প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে ৭০০ টাকা ফি নেওয়া কতটা যৌক্তিক?
প্রিলিমিনারিতে অংশ নেওয়ার জন্য প্রার্থী প্রতি ২০০ কিংবা ৩০০ টাকা পর্যাপ্ত হওয়ার কথা। যাঁরা প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবেন, শুধু সেই সব প্রার্থীর কাছ থেকেই ৭০০ টাকা নেওয়া সমীচীন হতে পারে। কিন্তু যাঁরা শুধু প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের কাছ থেকেও ৭০০ টাকা আবেদন ফি নেওয়ার যুক্তিটা আসলে কী?
৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা আগামী ১৯ মে। ছয় বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএসে সবচেয়ে কম আবেদন করেছেন। আবেদনকারীর সংখ্যা ৩ লাখ ১৮ হাজার। এবারও হয়তো ১৫ থেকে ২০ হাজার চাকরি প্রার্থী প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন। কিন্তু বাধ্যতামূলক ৭০০ টাকা গুনতে হয়েছে সব আবেদনকারীকেই।
বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখতে পারে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (বিপিএসসি)। তা ছাড়া সরকার বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দেয়। দেশের নানা প্রকল্পে ও উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। চাকরিতে আবেদন ফি কমানোর জন্য প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে সরকার বেকারদের জন্য একটু মানবিক হতে পারে না কি?
তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোর সহসম্পাদক
towhidul.islam@prothomalo.com