বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও জ্যারেড কুশনার
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও জ্যারেড কুশনার

মতামত

কুশনার যেভাবে জলদস্যুতার যুগ ফিরিয়ে এনেছেন

১৭ শতকের ক্ল্যাসিক জলদস্যু কেবল সমুদ্রদস্যু ছিল না; তারা ছিল এমন এক ‘হাইব্রিড’ চরিত্র, যারা রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ও অনিয়ন্ত্রিত লুণ্ঠনের মধ্যকার ধূসর অঞ্চলে কাজ করত। তারা শক্তিশালী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যবহার করে ‘লেটার অব মার্ক’ নামে একটি সরকারি অনুমতিপত্র সংগ্রহ করত, যা তাদের লুণ্ঠনকে বৈধতা দিত।

এই অনুমতিপত্র তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের জাহাজ আক্রমণ ও দখল করার ক্ষমতা দিত—এভাবে বৈধ ও অবৈধ জলদস্যুতার মধ্যে একটি সীমানা তৈরি হতো। এর পেছনে আর্থিক প্রণোদনাও ছিল : দখলকৃত সম্পদের বড় অংশ তারা নিজেরা রাখত আর একটি অংশ যেত সরকারের কোষাগারে।

এই রাষ্ট্রীয় অনুমোদিত লুণ্ঠনের প্রথা ১৮৫৬ সালে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু আজ, সেটি আবার ফিরে এসেছে—এবার করপোরেট স্যুট পরে, জ্যারেড কুশনারদের রূপে।

যেভাবে প্রাচীন জলদস্যুরা কোনো দেশের পতাকার আড়ালে লুণ্ঠন চালাত, কুশনার ও তাঁর সমসাময়িকেরা ‘কূটনীতি’ ও ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন’-এর পতাকার
আড়ালে একই কাজ করছেন। মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিন বিষয়ে সক্রিয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা কুশনার নব্য ঔপনিবেশিক কূটনীতির মঞ্চে প্রবেশ করেছেন।

ট্রাম্প প্রশাসনের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কুশনার ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত কুখ্যাত ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ তত্ত্বাবধান করেছেন। এরপর আসে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ (সেপ্টেম্বর ২০২০), যা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মৌলিক প্রশ্নগুলো এড়িয়ে চলে।

২০২৫ সালের আগস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার জামাতাকে আনতেই হয়েছে, কারণ তাঁর মতো বুদ্ধিমান আর কেউ নেই।’ কুশনারের ‘দ্বিতীয় আগমন’ প্রকাশ্যে আসে যখন তিনি (টনি ব্লেয়ারসহ) হোয়াইট হাউসে গাজা-পরবর্তী ‘পুনর্গঠন পরিকল্পনা’ বৈঠকে অংশ নেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমি জ্যারেডকে দিয়েছি কারণ সে বুদ্ধিমান, অঞ্চলটিকে চেনে, মানুষকে জানে, অনেক খেলোয়াড়কে চেনে।’

ট্রাম্প শাসনামলের শুরুর দিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কুশনার বলেছিলেন, ‘আমি তিন বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে পড়াশোনা করছি; ২৫টি বই পড়েছি, অঞ্চলের প্রত্যেক নেতার সঙ্গে কথা বলেছি।’

২০২১ সালের ১৪ মার্চ ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এ প্রকাশিত এক মতামত নিবন্ধে তিনি আরব-ইসরায়েল দ্বন্দ্বকে ‘রিয়েল এস্টেট বিরোধ’ বলে অভিহিত করেন, যা তাঁর অগভীর বোঝাপড়ারই প্রমাণ। তিনি লেখেন, ‘আরব নেতারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টি মেনে নেননি এবং ৭০ বছর ধরে তাকে ঘৃণা করে নিজেদের ঘরোয়া ব্যর্থতা ঢাকতে ব্যবহার করেছেন।’

আরব অঞ্চলের ইতিহাস বা রাজনীতি সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা না থাকা সত্ত্বেও কুশনার নিখাদ স্বজনপ্রীতির জোরে নিজের অবস্থান গড়ে তুলেছেন। এই পারিবারিক প্রভাবই তাঁকে কূটনীতির নামে ‘চুক্তিবাজি’ চালানোর সুযোগ দিয়েছে, যা পরিণত হয়েছে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসায়।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের সার্বভৌম তহবিল থেকে অর্থ পেয়ে তাঁর প্রাইভেট ইকুইটি কোম্পানি অ্যাফিনিটি পার্টনারস এখন জলদস্যুতারই আধুনিক রূপ নিয়েছে।

২০২৫ সালের আগস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার জামাতাকে আনতেই হয়েছে, কারণ তাঁর মতো বুদ্ধিমান আর কেউ নেই।’ কুশনারের ‘দ্বিতীয় আগমন’ প্রকাশ্যে আসে যখন তিনি (টনি ব্লেয়ারসহ) হোয়াইট হাউসে গাজা-পরবর্তী ‘পুনর্গঠন পরিকল্পনা’ বৈঠকে অংশ নেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমি জ্যারেডকে দিয়েছি কারণ সে বুদ্ধিমান, অঞ্চলটিকে চেনে, মানুষকে জানে, অনেক খেলোয়াড়কে চেনে।’

নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কুশনার বলেন, ‘অনেকে ইতিহাসবিদ বা কূটনীতিক হিসেবে এই কাজ করেন, কিন্তু আমরা “ডিল গাই”। এটা অন্য খেলা।’

তাঁর (জ্যারেড) বাস্তব জ্ঞান এসেছে মূলত তাঁর বাবা চার্লস কুশনারের কাছ থেকে, যিনি দশকজুড়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও দক্ষিণপন্থী ইসরায়েলপন্থী প্রচারণার বড় অর্থদাতা।

নিউইয়র্ক টাইমস–এর তথ্যমতে, নেতানিয়াহু একসময় কুশনার পরিবারের নিউ জার্সির বাড়িতেও থেকেছেন। এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, কুশনার ও স্টিভ উইটকফ ‘ইসরায়েলের সঙ্গে শতভাগ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছিলেন’। এটা প্রশ্নহীন পক্ষপাত।

ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁর মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে কুশনারের প্রধান অবদান হলো গাজাকে একটি ‘নতুন এবং মূল্যবান ওয়াটারফ্রন্ট’ হিসেবে পুনর্গঠনের প্রস্তাব; যেখানে ‘পরিষ্কার’ করার নামে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হবে।

অসংখ্য স্বার্থের সংঘাত ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এবং কোনো আনুষ্ঠানিক সরকারি পদ ছাড়াই কুশনার গাজা চুক্তির কেন্দ্রে অবস্থান করে নেন, যা তাঁকে বিপুল অর্থ এনে দিতে পারে। কিন্তু হোয়াইট হাউস মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট অক্টোবরে বলেন, ‘জ্যারেড তাঁর শক্তি ও সময় উৎসর্গ করছেন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায়, এটা অত্যন্ত মহৎ কাজ।’

২০২৫ সালের অক্টোবরে কিরিয়াত গাতে নতুন বেসামরিক–সামরিক সহযোগিতা কেন্দ্র উদ্বোধনকালে কুশনার ঘোষণা করেন, ‘আমি এমন এক নতুন গাজা গড়তে চাই, যেখানে ফিলিস্তিনিরা বসবাস, কাজ ও জীবনের সুযোগ পাবে।’

এ বক্তব্যের জবাবে হারেৎজ পত্রিকার জোশুয়া লাইফার লেখেন, ‘এই তথাকথিত “অর্থনৈতিক শান্তি” আসলে দখল ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা, যা ধরে নেয়, ফিলিস্তিনিদের কিছু জমির টুকরা দিয়ে কেনা যাবে।’

কুশনারের জনসমক্ষে আত্মপ্রদর্শন এক অদ্ভুত নিস্পৃহতার প্রতিমূর্তি, যেন কোনো মোমের মূর্তি। তাঁর মুখে আবেগের কোনো ছাপ নেই; যেন কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে রিয়েল এস্টেটের হিসাব দিচ্ছেন।

এই নতুন বাস্তবতায় ‘শান্তি’ ও ‘যুদ্ধবিরতি’ শব্দগুলো অরওয়েলীয় অর্থে ব্যবহার হচ্ছে। এক রাতেই অক্টোবর মাসে শতাধিক ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি শিশু, নারী, বৃদ্ধ তাঁবুর নিচে বোমায় নিহত হয়েছেন।

গাজাকে নতুন করে ‘হলুদ রেখা’ দিয়ে ভাগ করার যে প্রস্তাব এসেছে, তা অসলো চুক্তির মতো প্রশাসনিক বিভাজনেরই পুনরাবৃত্তি। এতে গাজার অর্ধেকের বেশি অংশ সরাসরি ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে এবং এটি যদি স্থায়ী হয়, তবে তা হবে আরেক দফা দখল, সহিংসতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণহীনতার নতুন অধ্যায়।

জলদস্যুতার যুগ সত্যিই ফিরে এসেছে। এর নেতৃত্বে জ্যারেড কুশনার এবং তাঁর আন্তর্জাতিক সহযোগীরা: টনি ব্লেয়ার, রন ডারমার, স্টিভ উইটকফ প্রমুখ। ভূমি ও সম্পদ দখল এখন আর গোপন নয়; তাঁরা নিজেরাই তা ঘোষণা করছে।

‘ডিল গাই’-এর অভিধানে শান্তি মানে শুধু এক লাভজনক অধিগ্রহণ। লুণ্ঠনই এখন নীতি।

  • ড. সাহার হুনেইদি ফিলিস্তিনি ইতিহাসবিদ ও লেখক।

  • মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মনজুরুল ইসলাম