২৬ টাকায় উৎপাদন করা আলুর কেজি ১০ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হয় কীভাবে?
২৬ টাকায় উৎপাদন করা আলুর কেজি ১০ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হয় কীভাবে?

মতামত

আলুর দাম আসলে কে ঠিক করবে

এক.

আলুর ন্যায্য দাম পাচ্ছে না এদেশের প্রান্তিক কৃষকেরা। এর মধ্যেই আলু, না গণভোট—এই স্লোগান জনপ্রিয় করার চেষ্টা করা হলো। অথচ গণভোট তো আলুর দামের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। আলু আলুর দাম আসলে কে ঠিক করে? কৃষি উপদেষ্টা ৫০ হাজার টন আলু কিনতে চেয়েছিলেন। কিনলে বোঝা যেত, দাম কারা নির্ধারণ করে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সরকার নির্ধারণ করে না। আগেও সরকার দায় নিত না, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা সরকারও এ দায় নেয় না।

দাম নির্ধারণ করেন না কৃষক নিজেও। এ মৌসুমে প্রতি কেজি আলুর পেছনে কৃষকের শ্রম ছাড়াই খরচ পড়েছে ২৬ টাকার আশপাশে। অথচ তা বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকায়। এই দাম আসলে নির্ধারণ করে কে? আন্তর্জাতিক বাজার?

জুলাই অভ্যুত্থানের পর ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অনেক জ্ঞানীগুণীকে উড়িয়ে আনা হলো, কিন্তু কোনো জ্ঞানই কৃষকের পক্ষে গেল না। এত কমিশন হলো, কৃষি কমিশনটাই হলো না। মাওলানা ভাসানীর নাম এত উচ্চারিত হলো, কৃষককে পালনের কথাই কেউ মনে রাখল না।

দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের খবরে এসেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আলু রপ্তানি বেড়েছে চার গুণ।

কৃষি বিভাগ ও কয়েকটি সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে রপ্তানি গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে, ৬২ হাজার ১৩৫ টন পর্যন্ত। তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারও দায়ী নয়।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী বা দোকানিরাই কৃষি পণ্যের দাম নির্ধারণ করেন। দাম নির্ধারণের সময় বিবেচনা করেন উৎপাদন ব্যয়, পরিবহন ব্যয়, কর্মচারী খরচ ও লাভের হার।

কিন্তু এসব বিবেচনা করে ২৬ টাকায় উৎপাদন করা আলুর কেজি ১০ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হয় কীভাবে? তারমানে, কৃষকেরা নামমাত্র দামে ব্যবসায়ীদের হাতে ফসল তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আর ব্যবসায়ীদের লাভ আগের মতোই আছে। এ জন্য আসলে দায়ী কে?

দুই.

উন্নত দেশগুলোয় কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল হলেও সরকারের নীতিমালা, ভর্তুকি ও বাণিজ্যচুক্তির মধ্য দিয়ে তা নিয়ন্ত্রিত হয়। এসব পদ্ধতি একত্রে কৃষিপণ্যের মূল্যনির্ধারণকে স্থিতিশীল রাখে। কৃষকের আর্থিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করে।

বড় কৃষিপ্রধান দেশগুলোয় কৃষক সমবায় ও সংগঠনগুলোকে সরাসরি বিপণনের সুবিধা দেওয়া হয়। এটা মধ্যস্বত্বভোগীদের সংখ্যা কমিয়ে কৃষককে ন্যায্য দাম পেতে সাহায্য করে।

কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ ও সংগ্রহমূল্য নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন দেশে রয়েছে ‘এগ্রিকালচারাল প্রাইস কমিশন’। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন কৃষি মূল্য কমিশন কার্যকর রয়েছে। ভারতের উদাহরণই দেওয়া যাক। সেখানে কৃষি মূল্য কমিশন প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৬৫ সালে। বর্তমানে ২৩টি কৃষিপণ্যের সমর্থন মূল্য নির্ধারণ করে তারা। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বাজারদর যেন নেমে না যায়, সেজন্য সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য কিনে নেয় সরকার।

তারপরও ভারতের কৃষকেরা ১০ বছর ধরে আন্দোলন করছেন ‘মিনিমাম সেলিং প্রাইস’ বা এমএসপির জন্য। শিল্পপতিদের জন্য যেমন আছে এমআরপি, কৃষকের জন্য দরকার এমএসপি। পৃথিবীর বহু দেশে এর সমঝোতা হয় ইউনিয়নের মাধ্যমে।

বাংলাদেশে ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে প্রচলন আছে ধান, চাল ও গমের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণের। এটা সাধারণত উৎপাদন খরচের ওপর ৬ থেকে ১০ শতাংশ মুনাফা দেখিয়ে নির্ধারণ করা হয়। এর পরিধিও সীমিত। মোট উৎপাদনের মাত্র ৪-৫ শতাংশ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হয় উৎপাদন মৌসুমে।

ইউরোপের বহু দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র কৃষককে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেয়, যাতে তাঁরা ন্যায্য দাম পান, উৎপাদনও স্থিতিশীল থাকে। এ ছাড়া কৃষিপণ্যের ভবিষ্যৎ-মূল্য নির্ধারণের জন্য চালু আছে ‘ফিউচার মার্কেট’। ফলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা আগাম চুক্তির মাধ্যমে নির্দিষ্ট মূল্যে পণ্য বিক্রির নিশ্চয়তা পান।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো কৃষকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। ফলে কৃষকেরা উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করলেও ক্ষতির সম্মুখীন হন না।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অনেক জ্ঞানীগুণীকে উড়িয়ে আনা হলো, কিন্তু কোনো জ্ঞানই কৃষকের পক্ষে গেল না। এত কমিশন হলো, কৃষি কমিশনটাই হলো না। মাওলানা ভাসানীর নাম এত উচ্চারিত হলো, কৃষককে পালনের কথাই কেউ মনে রাখল না।

  • নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক

nahidknowledge1 @gmail. com