
যুদ্ধ শেষ হয়েছে—অন্তত গাজাবাসীর তা-ই ধারণা। বিমানের চক্কর থেমেছে। কামানের গর্জন স্তব্ধ। রাত নামলেও গাজা ঘুমায়নি। যেন ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মানুষ উঠে আসছে। যেন মৃতদেহ হঠাৎ পুনর্জীবন পেয়েছে।
তারা ফিরে এল। তারা প্রথমেই বুকে করে নিয়ে এল নিজের মাতৃভূমিকে; তারপর নিজের সামান্য বেঁচে যাওয়া টুকটাক জিনিসপত্র।
বিশ্ব এমন দৃশ্য আগে দেখেনি। পুরুষেরা ঘরবাড়ির দোরগোড়ায় ধুলো ঝাড়ছে। নারীরা সাগরের পানি দিয়ে ভাঙা পাথর ধুচ্ছে। শিশুরা ধ্বংসস্তূপের ফাঁকে দৌড়াচ্ছে। কেউ হারানো বল খুঁজছে। কেউ খুঁজছে আগুন থেকে বেচে যাওয়া কোনো অদগ্ধ বই।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যেন মৃত্যু বদলে গেল জীবনে। ধ্বংস বদলে গেল সৃষ্টিতে। নিস্তব্ধতা বদলে গেল মানুষের কর্মমুখরতায়।
মানবতার এমন পুনর্জন্ম পৃথিবী কমই দেখেছে। মনে হলো, গাজা যেন কবর থেকে উঠে ঘোষণা দিচ্ছে—‘আমি বেঁচে উঠেছি আবারও!’
ষাট হাজারেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছে। দেড় লাখের বেশি লোক জখম হয়েছে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। তবু যারা বেঁচে গেছে, তারা কারও সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করেনি। কারও করুণার আশায় বসে থাকেনি।
যাদের বিশ্বাসঘাতকতা ও উদাসীনতা তাদের একা ফেলে দিয়েছে, তাদের কাছে কোনো কৈফিয়তও তারা চায়নি। তারা ফিরে এসেছে নিজেদের ধ্বংসস্তূপে। হাতে হাত লাগিয়ে গড়ে তুলছে নিজের জীবন।
যেন পাথরগুলোও তাদের হাত ছুঁয়ে বলছে—‘তুমি-ই সত্যিকারের পাথর, তোমার স্থিরতাই আমার শক্তি।’
ভাঙাচোরা ঘরের মাঝে তারা রুয়ে দিচ্ছে আশার বীজ। তাদের এই জীবনের দিকে ফিরে চলা পৃথিবীকে আবারও চমকে দিয়েছে। বাকি বিশ্ব যাকে ‘ফিরে আসা’ বলছে, গাজার মানুষ সেটাকেই বলছে ‘বিজয়’। সেটি তাদের কাছে চুরি যাওয়া অধিকার ফেরত পাওয়ার ঘোষণা।
আরবি এক আশ্চর্য নিখুঁত ভাষা। আরবিতে ‘ফাওজ’ (فوز) এবং ‘নাসর’ (نصر) দুটি শব্দের মানে প্রায় এক। কিন্তু তাদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। ‘ফাওজ’ মানে ‘জয়’ বা ‘ভিক্টরি’। আর ‘নাসর’ মানে ‘বিজয়’ বা ‘ট্রিয়াম্ফ’।
‘ফাওয” মানে এমন এক ধরনের জয়, যেখানে তুমি আগুনের ভেতর থেকেও আত্মাকে অক্ষত রেখে বেরিয়ে আসো। অর্থাৎ, হয়তো তুমি সব হারিয়েছ—ঘরবাড়ি, প্রিয়জন, সম্পদ; কিন্তু তুমি নিজের সম্মান, বিশ্বাস আর মনুষ্যত্বকে হারাওনি। এটা আত্মিক বা নৈতিক বিজয়।
গাজাবাসীরা ধ্বংসস্তূপ থেকে বেঁচে ফিরেছে, মাথা নত করেনি, আশা হারায়নি। এটাই তাদের ‘ফাওয’।
‘নাসর’ মানে হলো বাহ্যিক বিজয়, শত্রুকে পরাস্ত করা, নিজের ইচ্ছা ও শক্তি দিয়ে জয় ছিনিয়ে নেওয়া। এটা হলো যুদ্ধক্ষেত্রের জয়—যেখানে তুমি শত্রুকে দমন করো, তাদের ইচ্ছার বিপরীতে নিজের শর্ত চাপিয়ে দাও।
‘ফাওজ’ আত্মাকে বাঁচায় আর ‘নাসর’ শত্রুকে হারায়। দুটি শব্দই গাজার ক্ষেত্রে খাটে। গাজা ‘ফাওজ’ বা জয় পেয়েছে, কারণ ধ্বংসের পরও গাজা উঠে দাঁড়িয়েছে, হাল ছাড়েনি, মর্যাদা হারায়নি।
গাজা ‘বিজয়ী’ (‘নাসর’ অর্থে) হয়েছে, কারণ তারা শত্রুর ইচ্ছাকে পরাজিত করেছে। ইসরায়েল চেয়েছিল তারা ভেঙে পড়ুক, কিন্তু তারা আরও দৃঢ় হয়েছে।
গাজার ছিল না কোনো যুদ্ধবিমান, ট্যাংক, অস্ত্র, বা কোনো শক্তিধর জোট। ছিল কেবল এই বিশ্বাস—‘যত দিন হৃদয় ধুকধুক করে, তত দিন ভূমি মরে না।’
মাটির বুক থেকে তারা জন্ম নিয়েছে। তারাই সেই মাটি, সেই ধ্বংসস্তূপ, সেই ভগ্নাবশেষ। তারা ফিরে এসেছে উত্তাল ঢেউয়ের মতো, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, আগামী দিনের দিকে।
গাজা না ধৈর্যের চেয়ে বড় কোনো অস্ত্র তুলেছে; না উড়িয়েছে আশার চেয়ে উঁচু কোনো পতাকা। আল্লাহ বলেছেন: ‘কত ক্ষুদ্র এক দল আল্লাহর অনুমতিতে জয়ী হয়েছে বৃহৎ বাহিনীর ওপর। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত ২৪৯)
আসলে তাদের বিজয় এসেছে আল্লাহর কাছ থেকে। মানুষের অস্ত্র থেকে নয়।
শত্রুরা যেটিকে অর্জন ভেবেছে, বাস্তবে তারা তার চেয়েও বেশি হারিয়েছে। তারা হারিয়েছে নিজেদের মুখোশ, নিজেদের মর্যাদা, নিজেদের বয়ান।
আর গাজার পতাকা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিমে; স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে তারা উদ্দাম নাচ নেচে যাচ্ছে।
আজ পৃথিবীর প্রতিটি মুক্ত আত্মা গাজা থেকে এসেছে। সেখানে চামড়ার রং, ধর্ম, ভাষা, জাত—কিছুই বাধা নয়। গাজার এখন নতুন এক ‘পাসপোর্ট’ আছে যা কোনো সরকার দেয়নি। সেই পাসপোর্টের নাম ‘বিজয়’। এটি বহন করে প্রত্যেক মুক্ত, মর্যাদাবান মানুষ যার জন্য লাগে না কোনো ভিসা, কোনো অনুমতি।
গাজার নাম এখন ধ্বনিত হচ্ছে বিশ্বের বড় বড় শহরে, স্টেডিয়ামে, সম্মেলনে, সংবাদমাধ্যমে। অন্যদিকে গাজার শত্রু হারিয়েছে গল্প বলার ক্ষমতা। দশকের পর দশক ধরে গড়ে তোলা ভারসাম্য, প্রভাব, ভাবমূর্তি—সব ভেঙে পড়েছে।
এখন সেই জাহাজের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। এটি নিয়ন্ত্রণ করছে পৃথিবীর মুক্ত মানুষ।
এটাই আল্লাহর বিজয়। যখন তিনি চান, তখন তাঁরই সৈন্যরা সেই জয় এনে দেয়। আসমান-জমিন উভয়েরই সৈন্য তাঁর।
গাজা জিতেছে, কারণ তারা আত্মসমর্পণ করেনি। তারা বিজয়ী, কারণ পৃথিবীর সব বিশ্বাসঘাতকতা, সব অবরোধের পরও তারা মাথা নত করেনি। তাদের পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তবু তারা যায়নি। তাদের উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল, তবু তারা থেকে গেছে। তাদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তবু তারা ভাঙেনি। তাদের প্রতিরোধকে চেপে ধরা হয়েছিল, তবু তারা পিছু হটেনি। তাদের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছিল, তবু তারা নীরব হয়নি।
আর গাজা? সে জিতেছে, কারণ সে ফিরে এসেছে। ফিরে আসাটাই এক মহাবিজয়।
গাজা জিতেছে, কারণ তার অটলতা রাজনীতিকদের নত হতে বাধ্য করেছে। তার মানুষ ফের গড়ে নেওয়াকে বেছে নিয়েছে, কান্নাকে নয়; তার মানুষ বেছে নিয়েছে কাজ, বিলাপকে নয়; তার মানুষ বেছে নিয়েছে আশাকে, হতাশাকে নয়।
গাজা জিতেছে, কারণ তারা আত্মসমর্পণ করেনি। তারা বিজয়ী, কারণ পৃথিবীর সব বিশ্বাসঘাতকতা, সব অবরোধের পরও তারা মাথা নত করেনি। তাদের পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তবু তারা যায়নি।
তাদের উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল, তবু তারা থেকে গেছে। তাদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তবু তারা ভাঙেনি। তাদের প্রতিরোধকে চেপে ধরা হয়েছিল, তবু তারা পিছু হটেনি। তাদের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছিল, তবু তারা নীরব হয়নি।
এরপরও কি তুমি প্রশ্ন করবে—কে জিতল, কে বিজয়ী হলো?
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আবদুর রহমান আল-শাম্মারি সৌদি বংশোদ্ভূত কবি ও লেখক