যুক্তরাজ্য জিমি লাইকে মুক্ত করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। জিমি লাই একজন সংবাদপত্রের মালিক, ব্রিটিশ নাগরিক এবং হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের পরিচিত নেতা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা লোকজনও তাঁর মুক্তির দাবি জানিয়েছে। তবে এসবের পরও বেইজিংয়ের নিয়োগ দেওয়া হংকংয়ের উচ্চ আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেন। গত সপ্তাহে আদালত জানান, তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। এ অভিযোগটি আসলে মিথ্যা। তবু চীনের শাসক সি চিন পিংয়ের চোখে এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কিছু নেই।
চীনের রাষ্ট্রদূতের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রসচিব ইভেট কুপার এই বিচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে নিন্দা করেন। কিন্তু তাঁর এই কঠোর কথায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। চীনের কাছে ব্রিটেনের মতামতের কোনো মূল্য নেই—এটা যেমন স্পষ্ট, তেমনি স্পষ্ট চীনের উদ্ধত আচরণের সামনে যুক্তরাজ্যের দুর্বলতা ও সিদ্ধান্তহীনতা। ১৯৯৭ সালে চীনের কাছে হংকং হস্তান্তরের পর অঞ্চলটির স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা ভেঙে ফেলা সি চিন পিংয়ের কমিউনিস্ট পার্টির ঔদ্ধত্য ও অবিশ্বাসযোগ্যতারই প্রমাণ।
জানুয়ারিতে কিয়ার স্টারমারের বেইজিং ও সাংহাই সফরের আগে জিমি লাইয়ের এ করুণ ঘটনাটি এক অন্ধকার ও অশুভ পটভূমি তৈরি করেছে। ওই সফরের মূল লক্ষ্য বাণিজ্য ও ব্যবসা। কোনো চীনা ভাগ্যগণক হয়তো এটিকে অমঙ্গলজনক বলে মনে করত এবং স্টারমারকে বাড়িতেই থাকতে পরামর্শ দিত। কিন্তু এই মাসে লন্ডনের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে স্টারমার বলেন, সেখানে যাওয়া তাঁর দায়িত্ব। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা দরকার, কারণ দেশটি প্রযুক্তি, বাণিজ্য ও বৈশ্বিক শাসনে একটি নির্ধারণী শক্তি। যদিও তিনি স্বীকার করেন যে চীন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে, তবু তিনি সেই হুমকির গুরুত্ব কিছুটা কমিয়ে দেখান।
ব্রিটেনের নিরাপত্তা ও গণতন্ত্র, বৈশ্বিক ব্যবস্থা এবং জাতীয় আত্মমর্যাদার দিক থেকে দেখলে, এই শোষণমূলক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সঙ্গে ব্যবসা করার মূল্য খুবই বেশি। ভবিষ্যতে কিছু অর্থনৈতিক, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত লাভ হবে এই অনিশ্চিত আশায় এমন সম্পর্ক গড়ে তোলা ব্রিটেনকে নির্ভরশীল করে তুলতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত দেশের সার্বভৌমত্বকেও দুর্বল করতে পারে। স্টারমার বেইজিংয়ে গিয়ে এমন এক ফাঁদে পা দেওয়ার ঝুঁকিতে আছেন, যেমনটি তিনি এ বছর ওয়াশিংটনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাতানো ফাঁদে পড়েছিলেন। ট্রাম্পও একজন শক্তিশালী স্বৈরাচার ও দাদাগিরিপূর্ণ নেতা।
বেইজিং ইতিমধ্যেই অগ্রিম মূল্য চাইছে। তারা টাওয়ার ব্রিজের কাছে একটি বিশাল দুর্গসদৃশ দূতাবাস নির্মাণ করতে চায়। জানুয়ারির মাঝামাঝির মধ্যে যদি অনুমতি না দেওয়া হয়, তবে স্টারমারের এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত না হওয়া চীন সফর বাতিল হয়ে যেতে পারে। তা হলে সেটি হবে অত্যন্ত অপমানজনক এক প্রত্যাখ্যান। আর এতে স্পষ্ট হয়ে যাবে, চীনে রাজনীতি ও নিরাপত্তা কীভাবে একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
চীনের শাসকগোষ্ঠী বাস্তবে ব্রিটেনের অঘোষিত শত্রু। তারা যে হুমকি তৈরি করছে, তার রূপ নানা ধরনের। গুপ্তচরবৃত্তি, সাইবার হামলা এবং বিদেশে থাকা ভিন্নমতাবলম্বীদের ভয়ভীতি দেখানোর বিষয়ে প্রায় প্রতিদিনই সতর্কবার্তা শোনা যায়। শুক্রবার আরও একটি হ্যাকিংয়ের ঘটনা প্রকাশ পায়, এবার পররাষ্ট্র দপ্তরে, যা নাকি চীন করেছে। এমআই ফাইভ জানিয়েছে, চীনা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিয়মিতভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সংসদ ও এমপিদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। তবু হোয়াইটহলে একধরনের অদ্ভুত নিষ্ক্রিয়তা চোখে পড়ে।
যেমন ধরুন, কেন এই শরতে চীনের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত দুই ব্রিটিশ নাগরিকের মামলা হঠাৎ ভেঙে পড়ল, তা এখনো পরিষ্কার নয়। সংসদের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা কমিটি গত সপ্তাহে অভিযোগ করেছে, সরকার চীনকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হিসেবে ঘোষণা দিতে গড়িমসি করছে। আর বেশ রাজনৈতিক গুরুত্বের সঙ্গে জনসমক্ষে প্রথমবার হাজির হয়ে এমআই সিক্সের নতুন প্রধান ব্লেইজ মেট্রেওয়েলি কৌশলে চীন প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান।
মেট্রেওয়েলি যা বলেননি, সেটাই আসল কথা। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব বিশ্বজুড়ে ব্রিটেনের মূল্যবোধ ও স্বার্থকে মৌলিকভাবে চ্যালেঞ্জ করছে। হংকং, শিনজিয়াং ও তিব্বতে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন, খ্রিষ্টান সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন, আগ্রাসী বাণিজ্যনীতি যেমন বিরল খনিজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা এবং ভর্তুকিপ্রাপ্ত স্টিল সস্তায় বাজারে ছাড়ার কৌশল, জাপান, তাইওয়ান ও ফিলিপাইনের প্রতি সামরিক হুমকি, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও ইরানের সঙ্গে অংশীদারত্ব এবং ইউক্রেনে মস্কোর অবৈধ যুদ্ধকে সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমেই এই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে।
স্টারমার নিশ্চয়ই এসব জানেন। তবু তিনি একসঙ্গে দুই দিক সামলাতে চান। তিনি রাজনীতি ও নিরাপত্তাকে ব্যবসা ও বাণিজ্য থেকে আলাদা করতে চান, ঠিক যেমন অনেকেই রাজনীতিকে খেলাধুলা থেকে আলাদা রাখার চেষ্টা করে, যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। স্টারমারের যুক্তি হলো, ‘আমাদের নিরাপত্তা রক্ষা করাই আমাদের প্রথম দায়িত্ব। আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিলে অন্য ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতার সুযোগ তৈরি হয়।’ এ কারণেই কর্মকর্তারা কৃত্রিমভাবে চীনের হুমকিকে কম গুরুত্ব দিয়ে দেখান। তাঁরা আশঙ্কা করেন, সময়ের আগেই সমালোচনা করলে স্টারমারের লক্ষ্য ভেস্তে যেতে পারে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি সরল ও অবাস্তব। বেইজিং যা কিছু করে, তার সবকিছুর সঙ্গেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির হাত জড়িত। চীনের নিরাপত্তাব্যবস্থা, অর্থনীতি ও বাণিজ্য একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত এবং শেষ পর্যন্ত আলাদা করা যায় না। আগের এক ব্রিটিশ সরকার বিষয়টি বুঝেছিল বলেই হুয়াওয়েকে ব্রিটেনের ফাইভ–জি টেলিকম নেটওয়ার্ক থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো এভাবেই কাজ করে। সি চিন পিংয়ের অধীন কেন্দ্রীভূত পার্টির নিয়ন্ত্রণ আরও স্পষ্টভাবে বেড়েছে। স্টারমার যেকোনো চুক্তি করলে তার প্রভাব জাতীয় নিরাপত্তার ওপর পড়বেই।
বেইজিং ইতিমধ্যেই অগ্রিম মূল্য চাইছে। তারা টাওয়ার ব্রিজের কাছে একটি বিশাল দুর্গসদৃশ দূতাবাস নির্মাণ করতে চায়। জানুয়ারির মাঝামাঝির মধ্যে যদি অনুমতি না দেওয়া হয়, তবে স্টারমারের এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত না হওয়া চীন সফর বাতিল হয়ে যেতে পারে। তা হলে সেটি হবে অত্যন্ত অপমানজনক এক প্রত্যাখ্যান। আর এতে স্পষ্ট হয়ে যাবে, চীনে রাজনীতি ও নিরাপত্তা কীভাবে একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
• সাইমন টিসডাল, দ্য গার্ডিয়ানের পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশ্লেষক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত