Thank you for trying Sticky AMP!!

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বনাম সংবিধান মেনে চলা

আগামী নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু, অবাধ ও গণতান্ত্রিক মানসম্পন্ন হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে। তাদের ভাষায় সাংবিধানিকতা থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে এক বৈঠকের পর ওয়েস্টমিনস্টারে কীভাবে নির্বাচন হয়, সাংবাদিকদের কাছে সেই প্রশ্নও তুলেছেন। তিনি ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে সম্ভবত ভুলে গেছেন যে ব্রিটিশ গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীকে কত সহজে জবাবদিহির মুখোমুখি করা যায়, সরকারের বদল ঘটানো যায়। তার জন্য সাংবিধানিকতার প্রশ্ন ওঠে না। কার্যত ব্রিটেনে প্রচলিত অর্থে কোনো সংবিধান নেই, বরং মৌলিক অধিকার ও সরকার পরিচালনাবিষয়ক অনেকগুলো মৌলিক আইন সংবিধানের বিধান সমতুল্য বিবেচিত হয়।

আমাদের দেশে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন যে পর্যায়ে অধঃপতিত হয়েছে, যেভাবে আইনের শাসন নির্বাহীর শাসনে পরিণত হয়েছে, মতপ্রকাশ ও সংগঠন করার স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে, সেখানে সাংবিধানিকতার যুক্তি পরিস্থিতিকে কি স্বাভাবিকভাবেই আরও জটিল করে তুলবে না? আইনশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এখন কথিত সাংবিধানিকতার যুক্তিকে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বিপজ্জনক প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। 

তাঁরা বলছেন, এ কাজে সংবিধানের অসাংবিধানিক সংশোধনীকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সংবিধানের অসাংবিধানিক সংশোধনীর আলোচনায় বাংলাদেশের প্রসঙ্গ, বিশেষত পঞ্চদশ সংশোধনীর বিশ্লেষণ উঠে এসেছে ২০২২ সালের প্রকাশনা দ্য ল অ্যান্ড পলিটিকস অব আনকনস্টিটিউশনাল অ্যামেন্ডমেন্টস ইন এশিয়া বইয়ে একাধিক শিক্ষাবিদ-গবেষকের লেখায়। রাউটলেজের প্রকাশিত বইটিতে এক নিবন্ধে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটির ফেলো রিদওয়ানুল হক ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে আইনে নির্দেশিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সম্পাদিত সংবিধান সংশোধনও অসাংবিধানিক হতে পারে।

বাংলাদেশের অসাংবিধানিক সংশোধনীর রাজনীতি (দ্য পলিটিকস অব আনকনস্টিটিউশনাল অ্যামেন্ডমেন্টস ইন বাংলাদেশ) নিবন্ধে তিনি অষ্টম ও পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন, যার মধ্যে প্রাসঙ্গিক হিসেবে আমি শুধু পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পর্কে তাঁর সারকথা এখানে তুলে ধরছি। প্রথমত, পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক, তার ব্যাখ্যায় তিনি সংশোধনী প্রণয়নের প্রক্রিয়া ও ঘটনাক্রম তুলে ধরে বলেছেন যে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়ী হলেও তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপের কোনো প্রস্তাব ছিল না। ফলে তা ম্যান্ডেটের বাইরে সম্পাদিত কাজ। 

দ্বিতীয়ত, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন প্রশ্নে একটি রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণে প্রণীত ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল। তৃতীয়ত, ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুমোদনে সব দলের ভোটের সুযোগ না থাকলেও সংশোধনীটির নেপথ্যে ছিল সর্বদলীয় সমঝোতা বা মতৈক্য। চতুর্থত, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলোপের সময়ে প্রধান দলগুলোর নেতৃত্বে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে, যার কারণে যুক্তি দেওয়া যায় যে ওই সংশোধনীর প্রতি জনসমর্থন ছিল না।

ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বেআইনি ঘোষণার প্রক্রিয়ায় নির্বাহী বিভাগের প্রভাব কেন অনুভূত হয়, তার ব্যাখ্যাও তিনি ঘটনাক্রমের বিশ্লেষণে তুলে এনেছেন। ত্রয়োদশ সংশোধনীকে হাইকোর্ট বৈধ বলে ঘোষণার পর আপিল পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে থাকলেও আপিল বিভাগ তা হঠাৎ করে শুনানি করার উদ্যোগ নেয় ক্ষমতাসীন দল সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণের পর। এরপর স্বল্পতম সময়ে তার শুনানি সম্পন্ন করা হয়, যাতে অধিকাংশ অ্যামিকাস কিউরির মতামত উপেক্ষিত হয় এবং আপিল বিভাগের ৪-৩ ব্যবধানে সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়ে আদালতের সিদ্ধান্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের সুযোগ দেওয়া হয়নি।

পূর্ণাঙ্গ রায়টি এক বছরের বেশি সময় পর প্রকাশ করায় সংখ্যালঘুর মতামত আলোচিত হওয়ার কোনো সুযোগই মেলেনি। অথচ সংক্ষিপ্ত আদেশের দোহাই দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়ে যায়। আদালত রাজনৈতিক অস্থিরতা এড়াতে পরবর্তী দুটি নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার জন্য যে অভিমত দিয়েছিলেন, তা উপেক্ষিত হওয়াও সংশোধনীটির বৈধতা ক্ষুণ্ন করে।

Also Read: কেমন হবে নির্বাচনকালীন সরকারের চেহারা

পঞ্চদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক গণ্য করার আরেকটি কারণ হিসেবে তিনি এতে সংবিধানের মৌলিক চরিত্র অপরিবর্তনযোগ্য করার অংশটির কথা উল্লেখ করে লিখেছেন যে তাতে এমন কিছু বিবৃতি, দলিল ও ধারণা যুক্ত করা হয়েছে, যা ’৭২-এর মূল সংবিধানে যেমন ছিল না, তেমনই ত্রয়োদশ সংশোধনীর আগেও ছিল না। অথচ সেগুলো জুড়ে দিয়ে তা সংশোধনের ক্ষমতা ভবিষ্যতের সংসদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাঁর মূল্যায়নে অসাংবিধানিক সংশোধনী রাজনৈতিক স্বার্থে রাজনৈতিক দল যেমন করেছে, তেমনই সুপ্রিম কোর্টও ওই প্রক্রিয়ায় অংশীদার হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতার প্রশ্ন ভবিষ্যতে আদালতে উত্থাপিত হলে এসব প্রশ্নের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও উত্তর মিলতে পারে।  

এ ছাড়া লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে (দ্য পলিটিকস অব কনস্টিটিউশনাল অ্যামেন্ডমেন্টস ইন বাংলাদেশ: দ্য কেস অব দ্য নন-পলিটিক্যাল কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট) বাংলাদেশি গবেষক আদিবা আজিজ খান সংবিধানের ১৭টি সংশোধনীর পর্যালোচনা করে উপসংহার টেনেছেন, এসব সংশোধনী আনা হয়েছে রাজনীতির প্রকৃতি পরিবর্তন এবং শাসক ও ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে। পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে তিনি দেখিয়েছেন, সংবিধান সংশোধনের জন্য কীভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়েছে। 

আদিবা পঞ্চদশ সংশোধনী বিষয়ে গঠিত সংসদীয় বিশেষ কমিটির ২৯ মার্চ ২০১১–তে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ সভার কার্যবিবরণী উদ্ধৃত করে বলেছেন যে কমিটির একমাত্র আলোচ্যসূচি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এবং বিষয়টিতে উঁচু মানের বিতর্ক হয়। বিতর্কের পর সব সদস্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার প্রশ্নে সম্মত হন, কিন্তু তিন মাস পর সংসদ অধিবেশনে কমিটির যে প্রতিবেদন পেশ করা হয়, তাতে ওই সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এতে নির্বাহী বিভাগের নেপথ্য প্রভাবের ইঙ্গিত মেলে। ক্ষমতাসীন দল ও জোটের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে বিষয়টিতে আর কোনো অর্থবহ বিতর্ক হয়নি।

অধ্যাপক রিদওয়ানুল হক ও আদিবা আজিজ খান—দুজনই সুপ্রিম কোর্টের সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে দেওয়া অভিমতের কথা তুলে ধরেছেন, যা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে। সম্ভবত তখনকার প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের ভূমিকা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের কারণেই আদালতের গুরুত্বপূর্ণ ওই পর্যবেক্ষণ ও মতামত উপেক্ষিত থেকেছে। ওই পর্যবেক্ষণে তাঁরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করা হলে তা জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে। ‘অন্যথায় বৈধ না হলেও প্রয়োজনীয়তার কারণে বৈধ’ নীতি এবং ‘জনগণের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ আইন’ ও ‘দেশের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ আইন’ বিবেচনায় পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের পক্ষে আদালত মত দিয়েছিলেন।

Also Read: আর নয় ‘অনির্বাচিত’ সরকার

আদালতের পর্যবেক্ষণ ও মতামত উপেক্ষিত হওয়ায় রাজনৈতিক বিরোধ যে তুঙ্গে উঠেছে এবং জনজীবন ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা গুরুতর বিপদে নিপতিত হয়েছে, তা অনস্বীকার্য। ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রতিবেশী দেশ হস্তক্ষেপ করেছে, আর ভূরাজনীতির খেলায় এখন আমাদের সার্বভৌমত্বের ঝুঁকি বেড়েছে। তাহলে সমাধানের জন্য কেন আদালতের ওই অভিমতকে এখনো প্রাসঙ্গিক গণ্য করা ও তা অনুসরণের পথ অনুসন্ধান করা যাবে না? দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার পরামর্শ দশম ও একাদশ সংসদের গণ্ডিতে না ভাবলেই তো সেটা সম্ভব। 

তা ছাড়া খায়রুল হকের উত্তরসূরি একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর রায় লেখা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী বলে ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি স্পষ্ট ভাষায় যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে খায়রুল হকের অবসরের প্রায় ১৬ মাস পরে লেখা ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় কি সংবিধান পরিপন্থী হয়ে যায় না? 

[আগামীকাল পড়ুন: ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রে নির্বাচন হয় যেভাবে]

কামাল আহমেদ সাংবাদিক