চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পাল্লা দিয়ে প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে
চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পাল্লা দিয়ে প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে

মতামত

যুক্তরাষ্ট্র–চীনের মেধাযুদ্ধ বিশ্বের জন্য ভালো, নাকি খারাপ

বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো এখন বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। জার্মানির এক্ৎসেলেন্স-ইনিসিয়াতিভে হোক কিংবা ভারতের ইনস্টিটিউটস অব এমিনেন্স (আইওই)—সব উদ্যোগের লক্ষ্য এক। আর তা হলো এমন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা, যেখানে বিশ্বসেরা মেধাবীরা পড়াশোনা ও গবেষণা করতে আসবেন এবং সেসব গবেষণা উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জন্য এ প্রতিযোগিতার গুরুত্ব আরও বেশি। কারণ, এই দুই দেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক আধিপত্যের লড়াইয়ে রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদার বিষয়টি শুধু সম্মানের নয়, এটি অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবন ঘটায়, উৎপাদনশীলতা বাড়ায় এবং ব্যক্তিগত আয় বাড়াতে সাহায্য করে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাঁরা পাস করেন, তাঁরা সাধারণত বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক বা উদ্যোক্তা হন। একটি দেশের গড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যত বেশি, সেই দেশের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও উৎপাদনশীলতাও তত বেশি হয়।

কয়েক বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের উচ্চশিক্ষা নিয়ে তুলনা করাই যেত না। যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড, হার্ভার্ডসহ অনেক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বসেরা হিসেবে বিবেচিত। এগুলোর মাধ্যমেই গুগল, মেটা, এনভিডিয়া, টেসলা ইত্যাদি কোম্পানি গড়ে উঠেছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক গ্র্যাজুয়েট ছিলেন, যাঁরা মার্কিন নন। যুক্তরাষ্ট্রের এক বিলিয়ন ডলারের স্টার্টআপগুলোর অর্ধেকের বেশি অন্তত একজন অভিবাসী প্রতিষ্ঠাতা দ্বারা গঠিত এবং ২৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠাতাই প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে এসেছিলেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থার বড় শক্তি এবং বিশ্বজুড়ে মেধাবীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের ১৪ শতাংশ এবং আইভি লিগ, এমআইটি বা স্ট্যানফোর্ডে প্রায় ২৮ শতাংশই বিদেশি।

২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে এই বিদেশি শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার অবদান রেখেছেন এবং ৩ লাখ ৭৮ হাজারের বেশি চাকরি টিকিয়ে রেখেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষায় নেতৃত্ব ধরে রাখা এখন আর নিশ্চিত কিছু নয়। কারণ, চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্রুত উন্নতি করছে।

কিউএস ও টাইমস হায়ার এডুকেশন র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী, পিকিং ও সিন সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় এখন শীর্ষ ২০-এ রয়েছে। ২০২৫ সালের নেচার ইনডেক্সে বিশ্বের সেরা ১০টি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের ৮টিই চীনে অবস্থিত; শুধু হার্ভার্ড ও জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সোসাইটি পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে আছে।

স্ট্যানফোর্ডকে অনুকরণ করে তৈরি চীনের চেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয় হ্যাংঝো শহরকে চীনের ‘সিলিকন ভ্যালি’তে রূপান্তর করেছে। সেখানেই ‘ডিপসিক’ নামক শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক কোম্পানি গড়ে উঠেছে।

বিশেষ করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত—এই খাতগুলোতে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান খুবই শক্ত। চীনে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল স্নাতক হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ। চীনে সব স্নাতক ডিগ্রির এক-তৃতীয়াংশই প্রকৌশলে। যুক্তরাষ্ট্রে তা মাত্র ৮ শতাংশ। বর্তমানে ছয় শতাধিক চীনা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক পর্যায়ে এআই পড়ায়। বিশ্বের সেরা এআই গবেষকদের প্রায় অর্ধেকই চীনা এবং তাঁদের অনেকেই এখন চীনে থেকে কাজ করছেন। এ অগ্রগতি হঠাৎ হয়নি।

বিগত তিন দশকের ধারাবাহিক সরকারি পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ কর্মসূচির মাধ্যমেই এটি সম্ভব হয়েছে। চীন ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রভাব বিস্তারকারী শিক্ষা পরাশক্তিতে পরিণত হতে চায়। বিশেষ করে এআই, সেমিকন্ডাক্টর ও রোবোটিকসে তারা পরাশক্তি হতে চায়। তবে চীনের এই পথ সহজ নয়। সত্যিকারের উদ্ভাবনের জন্য দরকার চিন্তার স্বাধীনতা ও একাডেমিক স্বাধীনতা। কিন্তু চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে তা সীমিত।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে একধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত পক্ষপাতের অভিযোগ এনে গবেষণা বাজেট বন্ধ করে দিচ্ছে, পাঠ্যসূচি বদলাতে বলছে এবং বৈচিত্র্যভিত্তিক কর্মসূচি বাতিল করতে চাপ দিচ্ছে।

বিদেশি ছাত্রদের জন্য ভিসা সীমিত করারও চেষ্টা চলছে। এ আক্রমণের কিছুটা প্রতিরোধ হয়েছে, তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই আবার সরকারের দাবির কাছে মাথা নত করেছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার প্রতি আস্থা কমেছে। বিদেশি ছাত্রদের আবেদনও কমে যাচ্ছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ট্রাম্প প্রশাসনের এই শিক্ষাবিরোধী নীতিমালা স্থায়ী হবে না এবং যুক্তরাষ্ট্র আবার শিক্ষার স্বাধীনতা, বৈশ্বিক প্রতিভাকে স্বাগত জানানো ও গবেষণায় সহায়তায় মনোযোগ দেবে। চীন যখন শিক্ষা ও উদ্ভাবনে বিশাল বিনিয়োগ করছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে স্বাভাবিক ধরে না নেওয়া। আশার কথা, এই ‘মেধা প্রতিযোগিতা’ আগামী দশকগুলোতে প্রযুক্তি নেতৃত্ব, অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং ভূরাজনৈতিক প্রভাব নির্ধারণ করে দিতে পারে।

লি জং-হা কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সাবেক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ