‘চিরস্থায়ী যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকা বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালালেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ায় ইসলামিক স্টেট–সংশ্লিষ্ট ঘাঁটিতে বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তুলে নাইজেরিয়া সরকারকে অভিযুক্ত করেন।
ক্রিসমাস ডেতে ট্রাম্প জানান, সোকোতো রাজ্যের বনঘেরা সীমান্ত এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী ‘শক্তিশালী ও প্রাণঘাতী’ হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকা কমান্ড জানায়, ওই হামলায় আইএসের ‘একাধিক’ যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। গিনি উপসাগরে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর একটি জাহাজ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিষ্টান ডানপন্থীদের একটি অংশ আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল দেশটির জটিল নিরাপত্তা সংকটকে সংকুচিতভাবে ধর্মীয় সংঘাত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু ধারাবাহিক নাইজেরীয় সরকারগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোয় হাজারো মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে।
নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের দুর্দশা যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থীদের কাছে একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছে; রক্ষণশীল রাজনীতিক ও অ্যাডভোকেসি গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়া সরকারকে ইসলামপন্থী জঙ্গিদের সহিংসতা সহ্য করার অভিযোগ করছে।
রক্ষণশীল কর্মী চার্লি কার্ক মৃত্যুর আগে বিষয়টি জোরালোভাবে তুলেছিলেন গির্জার উপাসনালয় ও ধর্মীয় বিদ্যালয়ে ইসলামপন্থী হামলার কথা তুলে ধরে। এই বয়ান ট্রাম্পের সমর্থকদের সঙ্গে, বিশেষ করে ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের মধ্যে, গভীরভাবে সাড়া ফেলেছে।
দীর্ঘদিনের লবিংয়ের পর ট্রাম্প প্রশাসন ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। ট্রাম্প পেন্টাগনকে সামরিক বিকল্প প্রস্তুত করতে নির্দেশ দেন এবং হত্যাকাণ্ড চলতে থাকলে ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হস্তক্ষেপের হুঁশিয়ারি দেন।
সোকোতো রাজ্যে সক্রিয় উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার সহযোগিতাকে নাইজেরিয়া স্বাগত জানালেও ধর্মীয় জরুরি অবস্থার দাবির সঙ্গে এই হামলাকে স্পষ্টভাবে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ‘সন্ত্রাসী সহিংসতা যেকোনো রূপেই হোক—খ্রিষ্টান, মুসলমান বা অন্য যেকোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে, তা নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য অপমানজনক।’
নাইজেরিয়ার সহিংসতা ধর্মীয় সীমা ছাড়িয়ে বহুদিকে বিস্তৃত এবং এর একক কোনো কারণ নেই। প্রায় ২২ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে খ্রিষ্টান ও মুসলমানের সংখ্যা প্রায় সমান; জিহাদি হামলা, অপহরণ ও অপরাধমূলক সহিংসতায় উভয় সম্প্রদায়ই লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশন গত বছর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নাইজেরিয়ায় উগ্রবাদী সহিংসতা কয়েকটি রাজ্যে ‘বহুসংখ্যক খ্রিষ্টান ও মুসলমানকে’ প্রভাবিত করেছে।
আমেরিকান এনজিও অ্যাক্লেডের (আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডাটা) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ১১ হাজার ৮৬২টি হামলায় ২০ হাজার ৪০৯ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮৫টি হামলা ও ৩১৭টি মৃত্যু ছিল ‘খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে সংঘটিত ঘটনা’, যেখানে ভুক্তভোগীর খ্রিষ্টান পরিচয় একটি কারণ ছিল। একই সময়ে ১৯৬টি হামলায় ৪১৭ জন মুসলমান নিহত হয়েছেন।
কৃষক ও পশুপালকদের মধ্যে সংঘর্ষের মূল কারণ ভূমি ও পানির বিরোধ; তবে ধর্মীয় ও জাতিগত পার্থক্য এসব সংঘর্ষকে প্রায়ই আরও উসকে দেয়। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, ব্যাপক অপহরণ ও হামলা চালায়; যা মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দুর্বল শাসনব্যবস্থা, দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও বেকারত্ব জিহাদি গোষ্ঠী ও সংগঠিত অপরাধে লোক টানাকে অনেক সহজ করে তোলে।
২০০৯ সাল থেকে নাইজেরিয়া একটি জিহাদি বিদ্রোহের সঙ্গে লড়ছে। এ সংঘাতে অন্তত ৪০ হাজার মানুষ নিহত এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় ২০ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে।
চিবোকের স্কুলছাত্রীদের অপহরণের ঘটনায় বোকো হারাম আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাতি পায়; মিশেল ওবামাসহ অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি তখন তাদের মুক্তির পক্ষে সোচ্চার হন।
এরপর বোকো হারামের ভাঙন ধরা গোষ্ঠীগুলো—যেমন ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স—নাইজার, চাদ ও ক্যামেরুনে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে ব্যাপক অরাজকতা সৃষ্টি হয় এবং আফ্রিকার ভেতরে ও ইউরোপমুখী অভিবাসন বেড়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলাগুলো সম্ভবত লাকুরাওয়া নামের একটি আইএস শাখার বনাঞ্চলীয় ঘাঁটি লক্ষ্য করে করা হয়েছে; গোষ্ঠীটির শিকড় প্রতিবেশী নাইজারে। ২০২৩ সালে নাইজারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর নাইজেরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের তৎপরতা বেড়েছে।
ক্রিসমাস ডের হামলার পর ট্রাম্পের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ‘আরও আসছে’ বলে প্রতিশ্রুতি দেন। তবে উচ্চকণ্ঠ ঘোষণার বিপরীতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি কমেছে, যা ওয়াশিংটনের দীর্ঘমেয়াদি অভিযানের সক্ষমতাকে সীমিত করে।
শুধু বিমান হামলা শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা ও অর্থনৈতিক সংকটে প্রোথিত এ সমস্যার সমাধানে সামান্যই প্রভাব ফেলবে। নাইজেরিয়ার অর্থনীতি তেল থেকে উপার্জিত আয়ের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল; কিন্তু দামের অস্থিরতা ও দুর্বল বৈচিত্র্যকরণের কারণে দ্রুত বাড়তে থাকা জনসংখ্যার চাহিদার সঙ্গে সম্পদ তাল মিলিয়ে বাড়েনি।
নাইজেরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্রিস্টোফার মুসা বলেছেন, সামরিক পদক্ষেপ প্রয়োজনীয় মোট কাজের প্রায় ৩০ শতাংশ; বাকি ৭০ শতাংশ নির্ভর করে উন্নত শাসনব্যবস্থা ও প্রত্যন্ত এলাকায় রাষ্ট্রের উপস্থিতি জোরদারের ওপর।
জেন ফ্ল্যানাগান দ্য টাইমসের আফ্রিকা প্রতিনিধি
দ্য টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ