সালাহউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ
সালাহউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ

বিশ্লেষণ

এই মৃত্যু কি আমরা এড়াতে পারতাম না

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এতগুলো কোমলমতি শিশুর প্রাণহানির ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক। বিমানটি এমন এক স্থানে বিধ্বস্ত হলো, যেখানে ছোট বাচ্চারা ক্লাসরুমে ছিল। মৃত এবং আহত শিশুদের মা-বাবাদের প্রতি আমি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। আহত সবার সুস্থতা কামনা করছি। যে প্রশিক্ষণার্থী চালক বিমানটি চালাচ্ছিলেন, তাঁর মৃত্যুও আমাদের ব্যথিত করেছে।

প্রশ্ন হলো, আমরা এ দুর্ঘটনা ও এতগুলো মৃত্যু এড়াতে পারতাম কি না। হয়তো পারতাম, যদি আমাদের যুদ্ধবিমান উড্ডয়নের জন্য কোনো স্বতন্ত্র রানওয়ে থাকত, যার অবস্থান হতো লোকালয় থেকে দূরে বিস্তীর্ণ মাঠ অথবা চর অঞ্চল অথবা অন্য কোনো জায়গায়। যেমন লালমনিরহাটের পরিত্যক্ত বিমানবন্দরটি আমরা চালু করতে পারতাম। প্রসঙ্গত, পৃথিবীর সব দেশেই প্রশিক্ষণ বিমানের উড্ডয়ন ও ল্যান্ডিং করা হয় নির্জন বা কম বসতিপূর্ণ এলাকায়; সেখানে দুর্ঘটনা ঘটলেও ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম হয়।

যুদ্ধবিমান চালানোর জন্য যে দীর্ঘ রানওয়ে দরকার, তা বর্তমানে চট্টগ্রাম ও সিলেটে আছে। আমাদের বিমানবাহিনী চট্টগ্রাম রানওয়ে ব্যবহার করে, তবে সিলেটে অবস্থিত রানওয়েটি সীমান্ত এলাকা হওয়ায় সুবিধাজনক নয়। ঢাকা একটি জনবহুল শহর, যেখানে আছে ঘন ঘন উঁচু ভবন, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। এমন একটি শহরে যেকোনো দুর্ঘটনা অনেক মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বিমান দুর্ঘটনায় আমরা যে ছোট বাচ্চাদের হারালাম, এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এ ঘটনা থেকে নীতিনির্ধারকেরা শিক্ষা নেবেন কি না, সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর থেকে বিমানটিতে যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলা হয়েছে। এটা তাদের মত হতে পারে; কিন্তু আমি মনে করি, বিমানবাহিনীর তদন্ত ছাড়া বলা যাবে না যে কী কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এটা ঠিক যে বিমানটি অনেক পুরোনো। একটি বিমানের কার্যকাল থাকে ১০ থেকে ১২ বছর। বহু বছর বিমানবাহিনীর জন্য নতুন বিমান কেনা হয়নি। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার দেশ পরিচালনা করেছে। কোনো সরকার তো বলেনি অর্থের অভাব ছিল অথবা আছে। তাহলে বিমানবাহিনীকে যুগোপযোগী করা হলো না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবেন?

এই ট্র্যাজিক ঘটনা, এতগুলো শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু থেকে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শিক্ষা নেবে আশা করি, জাতির কাছে তাদের কথা দিতে হবে—ভবিষ্যতে এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যুদ্ধবিমান চালানো হবে না। অবিলম্বে বিকল্প রানওয়ে প্রতিষ্ঠা করা হবে। সবাই সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় ক্ষতি হতে পারে।

সামরিক বা অন্য যেকোনো বিমান যান্ত্রিক গোলযোগ বা অন্য কারণেও দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে; কিন্তু সংশ্লিষ্ট সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হয়। অতীতের দুর্ঘটনার পর কমিটি যেসব সুপারিশ করেছে, তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে কি না, সেই বিষয়টি তলিয়ে দেখা দরকার।

বেসামরিক বিমানের দুর্ঘটনা ঘটলে যে কমিটি তদন্ত করে, তার সঙ্গে আমি যুক্ত। সামরিক বিমানের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আলাদা কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি যেসব সুপারিশ করে থাকে, সেগুলো বাস্তবায়ন তো মধ্য বা নিম্নস্তরের কর্মকর্তারা করতে পারবেন না। সিদ্ধান্ত আসতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তাঁদের কাছ থেকেই সিদ্ধান্ত আসতে হবে যে কোন বিমান আমরা ব্যবহার করব, নাকি পরিত্যক্ত ঘোষণা করব।

দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সবাই আত্মপক্ষ সমর্থন করে থাকেন। ইঞ্জিনিয়াররা বলবেন, বিমানটি চলাচলের উপযোগী ছিল। পাইলটরা বলবেন, ঠিকমতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থা তো অনেক ক্ষেত্রেই আছে। ঢাকার রাস্তায় যে লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলো চলছে, দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছেন; কিন্তু কর্তৃপক্ষের দিকে থেকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে চালক ও মালিকেরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে থাকেন, বলেন এগুলো উপযুক্ত। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও আমরা ত্রুটিপূর্ণ বাসগুলো ঢাকায় অবাধে চলাচল করতে দেখছি। সরকার যদি কালকেই বলে যে এ ধরনের বাস চালানো যাবে না, বন্ধ হতে বাধ্য।

উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমানবাহিনীর বিধ্বস্ত যুদ্ধবিমান। সোমবার, ২১ জুলাই।

সরকারকে সবার আগে জনগণের নিরাপত্তা দেখতে হবে। রাজা-বাদশাহ সেজে বসে থাকলে হবে না। অস্থায়ীভাবে বা আধাআধিভাবে কিছু করা যাবে না; অন্তত যেখানে জনগণের নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। নিজের পকেট ভর্তি করার চেষ্টা বাদ দিতে হবে। উদ্বেগের বিষয় হলো প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে ঘুষ-দুর্নীতি জেঁকে বসেছে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা যদি বলি, একদল অন্য দলকে সহ্য করতে পারে না। হাসপাতালে যে বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরা ভিড় জমালেন, সেটা চরম দায়িত্বহীনতা। মাইলস্টোন স্কুলের দুর্ঘটনায় সরকার যে এক দিন শোক পালন করেছে, এটা যেন লোকদেখানো না হয়। এই দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের স্বজনদের পাশে সরকারকে দাঁড়াতে হবে, আহত ব্যক্তিদের উন্নত মানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের বলা উচিত, ওই শিশুদের বাঁচাতে পারিনি, এ জন্য তাদের মা-বাবার কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।

এই ট্র্যাজিক ঘটনা, এতগুলো শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু থেকে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শিক্ষা নেবে আশা করি, জাতির কাছে তাদের কথা দিতে হবে—ভবিষ্যতে এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যুদ্ধবিমান চালানো হবে না। অবিলম্বে বিকল্প রানওয়ে প্রতিষ্ঠা করা হবে। সবাই সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় ক্ষতি হতে পারে।

আরেকটি কথা বলব, যেসব পরিবারের শিশু মারা গেছে, তাঁরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, তাঁদের শুশ্রূষা ও সমবেদনা দেওয়াও সরকারের দায়িত্ব। সরকার ইতিমধ্যে আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেছে; আশা করি এটা কথার কথা হবে না। আমরা দুই দিন পর যেন না দেখি মা-বাবাকেই চিকিৎসার ব্যয়ভার নিতে হচ্ছে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবহেলার খবর আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখেছি। এই আহত শিশুদের অভিভাবকদের যেন সে রকম অবস্থার মুখোমুখি হতে না হয়।

আমার শেষ কথা হলো, দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সরকারকে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সময়ক্ষেপণ কোনোভাবেই কাম্য নয়।

  • ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) সালাহউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ, বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত কমিটির প্রধান