মতামত

বাদামি প্রধানমন্ত্রী মানেই কি যুক্তরাজ্যে বর্ণবাদের ইতি

ঋষির নিয়োগ নিয়ে উচ্ছ্বাসকে সাদামাটা বা নির্দোষ ভাবার কোনো সুযোগ নেই। যাঁরা উচ্ছ্বসিত হচ্ছেন, তাঁরা ঔপনিবেশিক রাজনীতির প্রভাবে উচ্ছ্বসিত।
ছবি : রয়টার্স

পূর্ব লন্ডনের অল্ডগেইট ইস্ট স্টেশনের খানিকটা উল্টো দিকে আডলার স্ট্রিটে একটা পার্ক আছে। নাম আলতাব আলী পার্ক। আলতাব আলী ছিলেন এক বাংলাদেশি পোশাকশ্রমিক। বাড়ি সিলেট। ১৯৭৮ সালের ৪ মে এই আডলার স্ট্রিটে তিন কিশোরের হাতে তিনি প্রাণ হারান। তাঁর হত্যার পেছনে মূল কারণ ছিল তাঁর গায়ের বর্ণ। সেই পার্কেই ভাষা শহীদদের জন্য বানানো হয়েছে শহীদ মিনার। বর্ণবাদ বিষয়টা খুবই শক্তিশালী। আমার একটা গবেষণায় উঠে এসেছে, লন্ডনের বাঙালিরা শহীদ মিনারের বদলে সাধারণত এই স্থানকে আলতাব আলী পার্ক নামেই পরিচয় দিতে কিংবা ডাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

যুক্তরাজ্যে বর্ণবাদের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। এরই ধারাবাহিকতায় কিছুদিন আগে ঘিনঘিনে অস্বস্তিদায়ক এবং বর্ণবাদী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে যুক্তরাজ্যের খুবই জনপ্রিয় রেডিও শো এলবিসির উপস্থাপিকা সংগীতা মায়সকাকে। প্রসঙ্গ ঋষি সুনাক। প্রশ্নকারী শ্রোতা ঋষিরই নিজ দল কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য। এমনকি ওনার পিতাও তা–ই। শ্রোতার দাবি, ঋষি আমেরিকান। ব্রিটিশ নন। যুক্তরাজ্যকে ভালোবাসেন না। শেষমেশ বলেই ফেলেছেন, একজন ইংরেজ হিসেবে তিনি তো সৌদি আরব কিংবা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। তবে কেন ৮৫ ভাগ শ্বেতাঙ্গ ইংরেজের দেশে ঋষি প্রধানমন্ত্রী? বরিস জনসন আবার প্রধানমন্ত্রী হলেও ওনার আপত্তি নেই, কারণ বরিস শ্বেতাঙ্গ। যুক্তরাজ্যকে ভালোওবাসেন। উপস্থাপিকা যখন মনে করিয়ে দিলেন যে বরিস জনসনের জন্ম নিউইয়র্কে, তবু বর্ণবাদী শ্রোতা পিছপা হননি। বলেছেন, সাধারণ নির্বাচন হলে ঋষি সুনাক ২০ ভাগ ভোটও পাবেন না। যতই অপছন্দ করা হোক, যুক্তরাজ্যে বর্ণবাদের চেহারা এ রকমই বিপজ্জনক। ওই বর্ণবাদী শ্রোতার মতামতের প্রমাণ কিন্তু জনমত জরিপেও মিলেছে। লিজ ট্রাসের পদত্যাগের পর কনজারভেটিভ বা টরি পার্টির প্রধান হিসেবে জনমত জরিপেও কিন্তু সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন বরিস জনসন।

আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে ঋষি সুনাককে নিজের দলের চরম ডানপন্থীদের কাছে গরম পাতিলের অতি গরম ঢাকনার মতো আচরণ করতে হবে। তাঁকে যেকোনো দশটা সাধারণ টরির চেয়ে বেশি টরি হতে হবে। কিন্তু ঋষির জন্য অপরিবর্তনযোগ্য রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, তিনি যা–ই করেন না কেন, নিজের গায়ের রং এবং নাম তো আর বদলাতে পারবেন না। যদি তিনি জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত টিকেও যান, তবে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে ঋষি সুনাকের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হবে তাঁর নিজেরই গায়ের রং এবং জাতিপরিচয়।

রক্ষণশীলদের দল এই টরি পার্টি। দলে আছে ভূরি ভূরি চরম ডানপন্থী এমপি। এই সব ডানপন্থী আবার ব্যাপক ক্ষমতাবান, যার প্রমাণ লিজ ট্রাসের প্রধানমন্ত্রী হওয়া। ছেলেবুড়ো সবাই জানত, লিজ ট্রাসের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিছকই তামাশা। তাই তো সুপার মার্কেটের লেটুস পাতার আয়ুর সঙ্গে তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের তুলনা করা হয়েছে। বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে লেটুসকে, কারণ লেটুস টিকে গেছে। লিজ ট্রাস টেকেননি। এরপর ঋষির প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা অবধারিত ছিল। কারণ, টরি পার্টির এমপিরা তো বটেই, কোনো এমপিই নিজের চাকরি হারাতে চান না। আর সাধারণ নির্বাচন হলে অনেকেরই চাকরি থাকবে না। জরিপ বলছে, এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীনরা লন্ডনে একটা আসনও পাবেন না। কে হায় নিজে থেকে পরাজিত হতে চায়?
ঋষি মন্দের ভালো। ঋষি সুদর্শন। ঋষি বাদামি। ঋষি ব্রিটেনের রাজার চেয়ে দ্বিগুণ ধনী।

এ রকম অনেক গল্প ইতিমধ্যেই চাউর হয়েছে। ঋষিকে নিয়ে ভারতীয় এবং অভিবাসীদের মধ্যে অনেক উচ্ছ্বাস। কিন্তু এসব উচ্ছ্বাস বা অর্জনের কতটা রাজনৈতিক? এটা কি বর্ণবাদের পরাজয়?

আদর্শবাদীরা এই নিয়োগে আনন্দিত হবেন (ঋষির প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়োগই কোনো বৃহৎ নির্বাচনের অংশ বা ফল নয়)। কিন্তু আগেই বলেছি, বর্ণবাদের চেহারা যুক্তরাজ্যে ভয়ংকর। জনপ্রিয় পত্রিকা ডেইলি মিরর তো শিরোনামই করেছিল, ‘আমাদের নতুন অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, তোমাকে ভোট দিয়েছে কে?’ বাকিদের অনেকে শিরোনাম করেছিল, ঋষির নিজের দলের এমপিদের জন্য করা মন্তব্য ‘এক হও নয় মরো’ দিয়ে। তাঁর এই মন্তব্যেই ফুটে উঠেছে তাঁর আসল অসহায়ত্ব এবং বর্ণবাদী রাজনৈতিক বাস্তবতা।

ঋষির নিজের দলে একতা নেই। দিন পঞ্চাশেক আগেও কেউ তাঁকে চাননি। নিজে রক্ষণশীল দলের নেতা। এই রক্ষণশীলেরা আবার বর্ণবাদের সবচেয়ে কট্টর সমর্থক। সেই কট্টর সমর্থকদের এবারের আক্রমণের লক্ষ্য ঋষি সুনাক। নিজের দলের কট্টর ডানপন্থীদের কাছে ঋষি যে কতটা অসহায়, তার প্রমাণ সুয়েলা ব্রেভারম্যানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বানানো। কিছুদিন আগেই সুয়েলা ব্রেভারম্যানকে লিজ ট্রাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

কারণ, সুয়েলা সরকারের গোপন নথি নিজের ব্যক্তিগত ই-মেইল ব্যবহার করে নিজের দলের এক প্রভাবশালী এমপিকে পাঠিয়েছিলেন, যা মিনিস্ট্রিয়াল কোডের লঙ্ঘন। যাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মজা করে নাম দেওয়া হয়েছে লিকিসু। ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রিত্ব পাওয়ার জন্য কট্টর ডানপন্থীদের সমর্থনের কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি তাই সমর্থনের জন্য সুয়েলাকে কমপক্ষে ছয়বার ফোন করেছেন। এখানে একটা বিষয় খুবই খেয়াল করার মতো। তা হলো, সুয়েলা ব্রেভারম্যানের বর্ণ। বাবা অভিবাসী কেনিয়ান, মা মরিশাসের। তিনি নিজেও বাদামি। কিন্তু কট্টর ডানপন্থী । অভিবাসনবিরোধী।

এটাই যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া নতুন মাত্রা। বর্ণবাদ এবং ভৌগোলিক ঘৃণা যুক্তরাজ্যে এসে নিজেই অন্য রকম বর্ণ ধারণ করেছে। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। বর্ণবাদ এবং অভিবাসন বিরোধের রোগ এখন কেবল শ্বেতাঙ্গদের মধ্যেই সীমিত নয়। সাদা ভিন্ন অন্য বর্ণের মানুষের ভেতরও তা ছড়িয়ে পড়েছে। পেশাদার রাজনীতিকেরা বর্ণবাদ এবং অভিবাসনকে নিজেদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। সংখ্যাগুরু শ্বেতাঙ্গদের তাঁরা বোঝাতে চাইছেন, শ্বেতাঙ্গ স্বার্থ কেবল বাদামিরাই পারে রক্ষা করতে। এ অনেকটা পাতিলের চেয়ে ঢাকনা গরম অবস্থা।

ঋষির নিয়োগ নিয়ে উচ্ছ্বাসকে সাদামাটা বা নির্দোষ ভাবার কোনো সুযোগ নেই। যাঁরা উচ্ছ্বসিত হচ্ছেন, তাঁরা ঔপনিবেশিক রাজনীতির প্রভাবে উচ্ছ্বসিত। এই দলের সবাই মোটামুটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাস পড়েছেন। যাঁরা ক্ষিপ্ত, তাঁদের ক্ষোভও রাজনৈতিক এবং রাজনীতির সঙ্গে আরও জড়িয়ে আছে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বর্ণগরিমা এবং জাতিবিদ্বেষ। এই দলের বেশির ভাগই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাস পড়েননি। কারণ, যুক্তরাজ্যের বিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র-ছাত্রীদের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাস পড়ানো হয় না। যদিও লেবার পার্টির একসময়ের নেতা জেরেমি করবিন বলেছিলেন, নির্বাচনে জয়ী হলে পাঠ্যপুস্তকে তিনি ওপনৈবেশিক ইতিহাস সংযোজন করবেন। জীবনানন্দের ভাষায় বলতে হয়, ‘সেই শুভরাষ্ট্র ঢের দূরে আজ’। করবিন ও তাঁর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি আজ শুধুই পরাজিতের ইতিহাস।

তবে ঋষি সুনাকের এই নিয়োগে কি কোনো ইতিবাচক কিছু নেই? আছে। তবে তা ঋণাত্মকের ধনাত্মক। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, গোটা যুক্তরাজ্যে চরম ডানপন্থীরা  ঋষির প্রধানমন্ত্রী হওয়াকে নিজেদের আদর্শিক ব্যর্থতা হিসেবে প্রচার করবেন এবং করছেন। নিজেদের মধ্যে বিভক্তি বাড়লে একজন বাদামি বর্ণের মানুষই যে ক্ষমতায় বসবেন, এই সত্যকে ঘিরে তাঁরা নিজেদের আরও সংগঠিত করার চেষ্টা করবেন, যা ঋষি সুনাকের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে শঙ্কায় ফেলবে।

আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে ঋষি সুনাককে নিজের দলের চরম ডানপন্থীদের কাছে গরম পাতিলের অতি গরম ঢাকনার মতো আচরণ করতে হবে। তাঁকে যেকোনো দশটা সাধারণ টরির চেয়ে বেশি টরি হতে হবে। কিন্তু ঋষির জন্য অপরিবর্তনযোগ্য রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, তিনি যা–ই করেন না কেন, নিজের গায়ের রং এবং নাম তো আর বদলাতে পারবেন না। যদি তিনি জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত টিকেও যান, তবে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে ঋষি সুনাকের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হবে তাঁর নিজেরই গায়ের রং এবং জাতিপরিচয়।

  • রিনভী তুষার লেখক ও গবেষক
    লেখকের ই-মেইল: tushar.rinve@gmail.com