ট্রাম্প বরাবরই প্রকাশ্যে বর্ণবাদী কথা বলেছেন। এতে অনেক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান নিজেদের বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশে সাহস পেয়েছে।
ট্রাম্প বরাবরই প্রকাশ্যে বর্ণবাদী কথা বলেছেন। এতে অনেক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান নিজেদের বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশে সাহস পেয়েছে।

মতামত

নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের থাবা ও ‘শ্বেতাঙ্গের দায়িত্ব’

১৮৯৯ সালে ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ঠিক আগমুহূর্তে ব্রিটিশ কবি ও সাম্রাজ্যবাদের প্রবল সমর্থক রুডইয়ার্ড কিপলিং যুক্তরাষ্ট্রকে হামলার আহ্বান জানিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটির নাম ‘দ্য হোয়াইট ম্যান’স বারডেন’।

সেখানে রুডইয়ার্ড কিপলিং যুক্তরাষ্ট্রকে ফিলিপাইনে আগ্রাসন চালানোর আহ্বান জানিয়ে লিখেছিলেন—

‘শ্বেতাঙ্গের বোঝা কাঁধে তুলে নাও

শান্তির জন্য বর্বর যুদ্ধ চালাও

অনাহারীর মুখ আহারে ভরে দাও

রোগ–শোক–জ্বরা–ব্যাধির অবসান ঘটাও।’

অর্থাৎ রুডইয়ার্ড কিপলিং বলেছেন, আফ্রিকা ও এশিয়ার ‘অসভ্য’ মানুষকে ‘সভ্য’ করার ‘বোঝা’ বা নৈতিক দায়িত্ব শ্বেতাঙ্গদের কাঁধে নিতে হবে।

‘শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য’ তাদের প্রয়োজনে নিষ্ঠুর যুদ্ধ চালাতে হবে। এসব কৃষ্ণাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ গরিব লোককে খাদ্যসহায়তা দিতে হবে এবং চিকিৎসাবঞ্চিতদের চিকিৎসা দিতে হবে।

পরবর্তী এক দশকে কিপলিংয়ের এই আহ্বান পশ্চিমা বিশ্বের তথাকথিত ‘সভ্যতা বিস্তারের মিশন’-এর মূল সুরে পরিণত হয়েছিল।

এই যুক্তির মাধ্যমেই আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলো দখলের সাম্রাজ্যবাদী প্রতিযোগিতাকে ন্যায্যতা দেওয়া হয়।

‘বর্বর’ জনগোষ্ঠীর যুদ্ধ থামানো ও ‘পথভ্রষ্ট আত্মা’কে উদ্ধার করার অজুহাতে পশ্চিমা শক্তিগুলো তাদের উপনিবেশগুলোর সম্পদ লুট করে।

প্রয়াত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন বলেছিলেন, পশ্চিমাদের ধারণার শক্তি নয়; বরং তাদের নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডই এই সাম্রাজ্য দখল সম্ভব করেছিল।

ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ শুধু বন্দুকের ওপর নির্ভর করেনি। তারা বাইবেলকেও অস্ত্র বানিয়েছিল। তাদের দাবি ছিল,— পৌত্তলিক অবিশ্বাসীদের খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন অনেকটা সেই পথেই হাঁটছেন। তিনি ২৩ কোটি মানুষের দেশ নাইজেরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দিচ্ছেন।

এই দেশ তেল ও খনিজে সমৃদ্ধ। ট্রাম্পের দাবি, তিনি নাইজেরিয়ার খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীকে ‘গণহত্যা’ থেকে বাঁচাতে চান।

পুরোনো সাম্রাজ্যবাদী যুক্তির পুনরাবৃত্তি করে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনে ‘গুলিবর্ষণ করতে করতে’ ওই ‘অপদস্থ দেশে’ ঢুকে ইসলামি সন্ত্রাসীদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করবে।

অথচ বাস্তবতা হলো,— নাইজেরিয়ার জটিল সংঘাতগুলোতে ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে।

শুধু ২০২৫ সালেই নিহত হয়েছে প্রায় ৮ হাজার মানুষ। তবু ট্রাম্প কখনো নাইজেরিয়ার মানুষের জীবন বাঁচানো নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন না। তাঁর প্রথম মেয়াদে তিনি দেশটিকে ‘নোংরা দেশ’ বলে অপমান করেছিলেন। তাঁর প্রশাসন ইউএসএইড ভেঙে দেয়।

সংস্থাটি ২ লাখ ৭০ হাজার নাইজেরিয়াকে জীবনরক্ষাকারী সহায়তা দিত এবং দেশের জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেটের প্রায় ২১ শতাংশ জোগান দিত।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্পের নাইজেরিয়া আক্রমণের হুমকির পেছনে তিনটি সম্ভাব্য কারণ দেখা যায়।

প্রথম কারণ হলো খনিজ সম্পদের লোভ। বিশ্বের বিরল খনিজের প্রায় ৩০ শতাংশ আফ্রিকায় রয়েছে।

জুলাই মাসে হোয়াইট হাউসে যাওয়া পাঁচ আফ্রিকান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ট্রাম্পের আলোচনার মূল বিষয় ছিল খনিজ। কঙ্গো ও রুয়ান্ডার মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে তাঁর প্রচেষ্টার পেছনেও এই খনিজ আগ্রহ কাজ করেছে।

অন্য দেশের সম্পদের দিকে ট্রাম্পের নজর পড়া নতুন নয়। ২০১১ সাল থেকে তিনি ইরাকের তেল লুট করে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন হস্তক্ষেপের খরচ ‘ফেরত’ নেওয়ার কথা বলেছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে তেলসমৃদ্ধ ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে তাঁর বেপরোয়া সামরিক পদক্ষেপ (আন্তর্জাতিক জলসীমায় ভেনেজুয়েলার একটি তেলবাহী জাহাজ জব্দ করা) আসলে জলদস্যুতার শামিল।

নাইজেরিয়া লুটের জন্য উপযুক্ত বলেই মনে হচ্ছে।

দেশটির প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ, যাঁকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রিচার্ড জোসেফ ‘প্রিবেন্ডালিজম’ বলেছেন; অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজের ও ঘনিষ্ঠদের জন্য সম্পদ কুক্ষিগত করছেন।

বর্তমান ও আগের সরকারগুলো সন্ত্রাস দমনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও নাগরিকদের প্রতি নির্মম উদাসীনতা নাইজেরিয়ার গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর সন্দেহ তৈরি করেছে।

দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের লুটপাটে নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী ও পুলিশ ভয়াবহভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। অথচ নব্বইয়ের দশকে লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনে শান্তি রক্ষায় এই সেনাবাহিনী সম্মান অর্জন করেছিল।

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নুহু রিবাদু অভিযোগ করেছেন, সেনা ও পুলিশের সদস্যরা অস্ত্র ‘খারাপ লোকদের’ কাছে বিক্রি করছেন বা ধার দিচ্ছেন।

এমনকি কিছু সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে সন্ত্রাসীদের আঁতাতের সন্দেহও রয়েছে। এসব ব্যক্তির ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলে নাইজেরিয়ায় তা ব্যাপক সমর্থন পেত।

এই অস্থির পরিস্থিতিতে হামলাকারীরা প্রায়ই শাস্তি পায় না। স্থানীয় জনগণকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলেও কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে হয় না।

ফলে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্সের মতো জিহাদি গোষ্ঠীগুলো উত্তর-পূর্ব নাইজেরিয়ায় বছরের পর বছর নির্বিঘ্নে কাজ করে যাচ্ছে।

কিন্তু ট্রাম্প ও অনেকেই যে গুরুত্বপূর্ণ সত্য উপেক্ষা করেন তা হলো, —এই সন্ত্রাসীরা খ্রিষ্টানদের চেয়ে অনেক বেশি মুসলমানকে হত্যা করে।

নাইজেরিয়ার উর্বর মিডল বেল্ট অঞ্চলে আরেকটি ভয়াবহ সংঘাত চলছে। এখানে ফুলানি জাতিগোষ্ঠীর মুসলিম পশুপালক ও প্রধানত খ্রিষ্টান কৃষকদের মধ্যে সহিংসতা হয়েছে।

২০১০ সাল থেকে এতে প্রায় ১২ হাজার মানুষ মারা গেছে। তবে এই সংঘাত ধর্মের কারণে নয়। মূল সমস্যা হলো জমি, চারণভূমি ও পানির অধিকার।

উত্তর-পশ্চিম নাইজেরিয়ায় অপহরণও ব্যাপক আকার নিয়েছে। এটি পরে দেশের অন্য অংশেও ছড়িয়ে পড়েছে। এসব অপরাধের মূল উদ্দেশ্য ডাকাতি ও মুক্তিপণ আদায়।

প্রেসিডেন্ট তিনুবু দাবি করেছেন, ২০২৩ সালের মে মাসে ক্ষমতায় আসার পর তিনি ১৩ হাজার ৫০০-এর বেশি সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে মৃত্যুর সংখ্যা কমেনি।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে, একই সময়ে অন্তত ১০ হাজার ২১৭ জন সন্ত্রাস-সম্পর্কিত সহিংসতায় নিহত হয়েছে।

দ্বিতীয় সম্ভাব্য কারণ হলো —ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের খুশি করতে চাইছেন। এই গোষ্ঠী তাঁর অন্যতম শক্ত সমর্থক।

হেরিটেজ ফাউন্ডেশন ও গেটস্টোন ইনস্টিটিউটের মতো ডানপন্থী মার্কিন থিঙ্কট্যাংক নাইজেরিয়ায় ‘খ্রিষ্টান গণহত্যা’র ভুয়া ধারণা ছড়িয়েছে।

মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজও সম্প্রতি এই বয়ান জোরদার করেছেন। নাইজেরিয়ায় মানবিক হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়ে ট্রাম্প নিজেকে খ্রিষ্টধর্মের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরতে পারেন।

কিছু নাইজেরিয়ান হয়তো এই বিভ্রান্ত ‘সম্রাট সাজা’ ব্যক্তিকে তাদের সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু ট্রাম্প, তাঁর মাগা সমর্থকেরা এবং ইউরোপের জাতিগত জাতীয়তাবাদী মিত্রদের কাছে নাইজেরিয়া কেবল একটি তথাকথিত সভ্যতা মিশনের অংশ।

তৃতীয় কারণ হলো বর্ণবাদী রাজনীতি। ট্রাম্প এখানে ‘শ্বেতাঙ্গ উদ্ধারকর্তা’ চরিত্রে নিজেকে দাঁড় করাচ্ছেন।

এতে তাঁর ‘মাগা’ সমর্থকেরা আরও উজ্জীবিত হয়। ট্রাম্প বরাবরই প্রকাশ্যে বর্ণবাদী কথা বলেছেন। এতে অনেক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান নিজেদের বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশে সাহস পেয়েছে।

শুধু এ বছরই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ নেতৃত্বাধীন সরকারকে শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’ চালানোর মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।

এমনকি কিছু শ্বেতাঙ্গ কৃষককে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি সোমালি অভিবাসীদের ‘আবর্জনা’ বলে অবজ্ঞা করেছেন।

তাঁর নতুন জাতীয় নিরাপত্তাকৌশলে ইউরোপকে অভিবাসন বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে ইউরোপ ‘ইউরোপীয়’ই থাকে।

এই তিনটির যেকোনো একটি বা সব কটির মিলিত প্রভাবই দেখায়, —নাইজেরিয়া আক্রমণের হুমকির পেছনে ট্রাম্পের মানসিকতা সাম্রাজ্যবাদী।

কিছু নাইজেরিয়ান হয়তো এই বিভ্রান্ত ‘সম্রাট সাজা’ ব্যক্তিকে তাদের সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু ট্রাম্প, তাঁর মাগা সমর্থকেরা এবং ইউরোপের জাতিগত জাতীয়তাবাদী মিত্রদের কাছে নাইজেরিয়া কেবল একটি তথাকথিত সভ্যতা মিশনের অংশ।

এই মিশনের লক্ষ্য এক পুরোনো যুগ ফিরিয়ে আনা। আর তা হলো শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান আধিপত্যের যুগ।

  • আদেকিয়ে আদেবাজো প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব স্কলারশিপ-এ অধ্যাপক ও সিনিয়র গবেষণা ফেলো।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ