
ভেনেজুয়েলা ও যুক্তরাষ্ট্র যখন যুদ্ধের প্রান্তসীমায় চলে গেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাতে সরব হয়েছে চীন। বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে ওয়াশিংটনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ, যেমন ভেনেজুয়েলার তেলবাহী ট্যাংকার জব্দ, মাদক পাচারের অভিযোগে নৌযানে হামলা ও ভেনেজুয়েলার উপকূলে নৌ অবরোধ—আমেরিকান একতরফাবাদের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ। এ ধরনের কর্মকাণ্ড অন্য দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের শামিল এবং জাতিসংঘ সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
১৭ ডিসেম্বর ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান গিলের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই যুক্তরাষ্ট্রের ‘একতরফা শক্তিপ্রয়োগের’ বিরোধিতা করেন। একই সঙ্গে তিনি ভেনেজুয়েলার ‘সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় মর্যাদা রক্ষার অধিকারের’ প্রতি চীনের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। কথার খেলার বাইরে ভেনেজুয়েলাকে বাস্তব কোনো সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বেইজিং। ভূরাজনৈতিক ফাঁদে পা দেওয়ার বিষয়ে চীনের সতর্কতা অত্যন্ত স্পষ্ট। এ নিষ্ক্রিয়তায় লাতিন আমেরিকায় চীনের প্রভাবের সীমাবদ্ধতাও তুলে ধরছে।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে চীন লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিস্তার করে চলেছে। চীন আজ দক্ষিণ আমেরিকার শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রদের একটি মেক্সিকোও চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার।
যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহ্যগতভাবে লাতিন আমেরিকাকে তার প্রভাববলয়ের দেশ বলে মনে করে। খুব স্বাভাবিকভাবেই লাতিন আমেরিকায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সন্দিহান ও শত্রুভাবাপন্ন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও একজন প্রকাশ্য চীনবিরোধী। এর আগে তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে ‘দুষ্ট, গণহত্যা চালানো শাসনব্যবস্থা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে চীনবিরোধী কূটনৈতিক অভিযান চালান। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক সীমিত করার চেষ্টা করান রুবিও।
যদিও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সামনে যুক্তরাষ্ট্র কোনো বিকল্প অর্থনৈতিক সহযোগিতার মডেল দিতে পারেনি; বরং শুল্কের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছে। এর মাধ্যমে প্রভাবের লড়াইয়ে ওয়াশিংটন মূলত প্রাধান্য ধরে রেখেছে।
যাহোক যুক্তরাষ্ট্র যদি ভেনেজুয়েলায় সরকার উৎখাত করে, তবে সেটি লাতিন আমেরিকায় চীনের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা উদ্ঘাটন করবে। এমন পরিস্থিতি লাতিন আমেরিকার অনেক দেশকে এটা পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহিত করবে যে একটি আগ্রাসী যুক্তরাষ্ট্রের এত কাছাকাছি অবস্থান করে চীনের সঙ্গে জোট বাঁধা কতটা ভালো সিদ্ধান্ত।
প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় জয় অর্জন করেছে। ট্রাম্প–সমর্থিত রক্ষণশীল নাস্রি আসফুরা হন্ডুরাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতেছেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার এবং তাইওয়ানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
গত এক বছরে ট্রাম্প প্রশাসনের অধীন কয়েকটি লাতিন আমেরিকান দেশ মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছে। চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে পানামা আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ থেকে সরে আসে। এরপর মার্চে পানামা খাল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা হংকংভিত্তিক কোম্পানি ঘোষণা করে যে তারা তাদের অংশের বেশির ভাগ বিক্রি করে দেবে মার্কিন একটি সংস্থার কাছে। ডিসেম্বর মাসে মেক্সিকো ঘোষণা করে যে ১ জানুয়ারি থেকে তারা চীনা পণ্যে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করবে।
ভেনেজুয়েলার ওপর মার্কিন চাপ চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে নয়; বরং এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি জড়িত। রুবিও তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত রাজনৈতিক এজেন্ডা পূরণ করতে চাইছেন। এর লক্ষ্য হচ্ছে ভেনেজুয়েলা ও কিউবা থেকে আসা মার্কিন ভোটারদের সন্তুষ্ট করা।
কারাকাসে বর্তমান শাসনব্যবস্থার যেকোনো পরিবর্তন নিঃসন্দেহে চীনের স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যদিও চীন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর নির্ভরশীল নয় (ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেলের শীর্ষ ১০ সরবরাহকারী দেশের মধ্যে চীন অন্তর্ভুক্ত নয়), তবু যুক্তরাষ্ট্রের ভেনেজুয়েলার তেল ট্যাংকার আটক করার ঘটনা চীনের জ্বালানি কৌশলকে দুর্বল করে।
ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা বৃদ্ধির বিষয়টিকে চীন কেবল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে না, ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখছে। যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, সেই বৃহত্তর পটভূমি থেকে এটা গুরুত্বপূর্ণ। ভেনেজুয়েলার সীমিত অর্থনৈতিক মূল্য ও ভূরাজনৈতিক দূরত্ব বিবেচনা করে চীন সরকার লাতিন আমেরিকার দেশটিকে রক্ষা করার জন্য কোনো সম্পদ ব্যয় করবে না।
যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলায় আক্রমণ করলে চীন সম্ভবত সেটিকে ব্যবহার করবে নিজের বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের কাজে। চীন নিজেকে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করবে। যদিও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়াকে চীন ইতিবাচক বিবেচনা করতে পারে। কিন্তু এটা প্রায় নিশ্চিত যে চীন ভেনেজুয়েলাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না।
যাহোক যুক্তরাষ্ট্র যদি ভেনেজুয়েলায় সরকার উৎখাত করে, তবে সেটি লাতিন আমেরিকায় চীনের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা উদ্ঘাটন করবে। এমন পরিস্থিতি লাতিন আমেরিকার অনেক দেশকে এটা পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহিত করবে যে একটি আগ্রাসী যুক্তরাষ্ট্রের এত কাছাকাছি অবস্থান করে চীনের সঙ্গে জোট বাঁধা কতটা ভালো সিদ্ধান্ত।
ইয়াং শিয়াওটং সিঙ্গাপুরভিত্তিক হরাইজন ইনসাইটস সেন্টারের গবেষক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত