মতামত

মোসাদ ও ইরানের মধ্যে অন্তরালে যে যুদ্ধ চলছে

গোয়েন্দা–দুনিয়ায় ‘সত্য’ সব সময় সন্দেহকে সঙ্গে নিয়ে আসে। ওসব সত্যে কিছুই পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করা হয় না, সেখানে কিছুই চূড়ান্তভাবে শেষ হয় না। নানা গল্প ভেসে ওঠে অর্ধেক গড়া অবস্থায়, কখনো বাড়াবাড়ি রকমের বীরত্ব দিয়ে সাজানো, কখনো আবার প্রোপাগান্ডার সুতায় সেলাই করা।

ইসরায়েল ও ইরানের ক্রমাগত ছায়াযুদ্ধ নিয়ে সম্প্রতি তেহরান দাবি করেছে, তারা বহুদিনের প্রতীক্ষিত পাল্টা আঘাত হেনেছে। তারা নাকি ইসরায়েলের সবচেয়ে সংবেদনশীল পরমাণু চক্রে অনুপ্রবেশ করে গোপন নথির বিশাল ভান্ডার সংগ্রহ করেছে। যার ভেতর রয়েছে বিজ্ঞানীদের তালিকা, স্থাপনার মানচিত্র, অভ্যন্তরীণ নথি। ইরানি টেলিভিশনগুলো এ আলাপকে প্রায় কিংবদন্তিতে রূপ দিয়েছে।

তবে একটি বিষয় নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কোনো পক্ষই পুরো ঘটনার মূল ব্যাপারটা বানিয়ে বলছে না। বহুদিন ধরে আকাশের নয়, আসল যুদ্ধ চলছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ছায়ায়। ধীরে, কাছ থেকে, হিসেবি পদ্ধতিতে। এর আধুনিক ধাপ শুরু হয় ২০১৮ সালে, যখন ইসরায়েলি এজেন্টরা তেহরানের দক্ষিণ প্রান্তের একটি গুদামে প্রবেশ করেন এবং ইরানের গোপন অস্ত্র কর্মসূচি–সম্পর্কিত এক লাখের বেশি নথি নিয়ে আসেন।

এ বিস্ময়কর অভিযান তাঁরা করেছিলেন সাধারণ ছদ্মবেশে। একটি দল পাহারাদারদের ফাঁকি দিয়ে ভবনে ঢোকে, কাগজপত্র ও ডিজিটাল রেকর্ডে ভরা ভারী সিন্দুকগুলো তুলে আনে এবং তেহরান থেকে ‘অদৃশ্য’ হয়ে বেরিয়ে যায়। পরে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা নথিগুলো জনসমক্ষে প্রদর্শন করেন—প্রকৌশল নকশা, সাইটের মানচিত্র, সমরাস্ত্রের নকশা।

ইরানের ভেতরে এরপর ঘটল একের পর এক অদ্ভুত ঘটনা। নাতাঞ্জে বিস্ফোরণ, ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন এলাকার পাশে আগুন, শিল্পকারখানায় এমন সব ‘দুর্ঘটনা’, যা কাকতালীয়ভাবে সব সময়ই ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলোকে আঘাত করে।

শুরুতে তেহরান এসবের জন্য প্রযুক্তিগত ত্রুটিকে দায়ী করেছিল। পরে বিদেশি ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে দোষ দিতে বাধ্য হয়। অনিচ্ছাকৃতভাবে স্বীকার করে যে ইসরায়েলের প্রভাব ইরানের গভীর ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এবং তাদের হয়ে কাজ করা যেসব সূত্র রয়েছে, তাদের পরিচয় কোনো দিনই কোনো অভিযোগপত্রে প্রকাশ পাবে না।

এরপর আসে ২০২০ সালের নভেম্বর মাস। ইরানের অস্ত্রমুখী কর্মসূচির আধ্যাত্মিক স্থপতি হিসেবে পরিচিত মোহসেন ফাখরিজাদে নিহত হন তেহরানের কাছে এক অভিযানে। অভিযানটি এতটাই নিখুঁতভাবে চালানো হয়েছিল যে মনে হচ্ছিল এটি যেন দূর থেকে কোনো যান্ত্রিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। ইরানি কর্মকর্তারা পরে স্বীকার করেন যে স্যাটেলাইট–নিয়ন্ত্রিত একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।

এটি ছিল কঠিন এক বার্তা—ইরান তাদের বিজ্ঞানীদের চারদিকে প্রহরী বসাক, ব্যারিকেড দিক, গাড়ির বহর দিক, তবু নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না।

ছায়াযুদ্ধ এরপর আরও তীব্র ও বিস্তৃত হয়। শুধু গোয়েন্দাগিরি নয়; বরং শুরু হয় একধরনের মিশ্র যুদ্ধ। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি এসে গোয়েন্দা তৎপরতা সরাসরি শক্তিপ্রয়োগের সঙ্গে মিশে যায়। বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি এজেন্টরা ড্রোনের যন্ত্রাংশ ইরানে চোরাই পথে পাঠিয়ে সেখানে গোপন উৎক্ষেপণ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন। সেই মানববিহীন বিমানগুলো ব্যবহার করে ইরানের ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে অচল করা হয়, যাতে পরবর্তী সময়ে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু স্থাপনায় ইসরায়েলের বৃহৎ হামলা সহজ হয়। এ ঘটনাগুলোই পরিণত হয় স্বল্পস্থায়ী, কিন্তু বিপজ্জনক ‘১২ দিনের যুদ্ধ’-এ।

গোয়েন্দা সংঘাতে জয় ঘোষণা করাটা অনেক সময় আসল যুদ্ধে জয়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ইরান তাদের ঘোষণাটি পশ্চিমাদের যাচাইয়ের জন্য দেয়নি। এটি ছিল আঞ্চলিক দর্শকদের জন্য, দেশের মনোবল জোরদারের জন্য এবং প্রতিপক্ষকে সাবধান করার জন্য। বার্তাটি স্পষ্ট ছিল, ‘আড়ালে কেবল তোমরাই কাজ চালাও না।’

ইরানের প্রতিক্রিয়া তখন থেকে দুই দিক দিয়ে এগিয়েছে। নিজ দেশে নিরলস গোয়েন্দা দমন অভিযান এবং বাইরে প্রোপাগান্ডামূলক আক্রমণ। তেহরান জানিয়েছে, তারা মোসাদের সঙ্গে যুক্ত বেশ কিছু অপারেটিভকে আটক করেছে। কয়েকজনকে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়েছে। এসব স্বীকারোক্তি সাধারণত টেলিভিশনে প্রচার করা হয়, কঠোর নিয়ন্ত্রণে উপস্থাপিত হয় এবং স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয় না। তবু এগুলো বুঝিয়ে দেয় যে রাষ্ট্রটি বিশ্বাস করে, তার অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়েছে।

এরপর জুন মাসে আসে ইরানের সবচেয়ে সাহসী দাবি। তারা নাকি গোয়েন্দা যুদ্ধের প্রবাহটাই উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে।

ইরানি কর্মকর্তারা জানান, তাঁদের গোয়েন্দা সদস্যরা ‘লাখ লাখ পৃষ্ঠার’ ইসরায়েলি পরমাণু নথি সংগ্রহ করেছেন। তাঁরা মানচিত্র, কর্মীদের নথি, বাড়ির ঠিকানা, এমনকি নজরদারির ছবি পাওয়ার কথাও জানান।

যদিও এখন পর্যন্ত এমন কোনো নথি প্রকাশিত হয়নি, যা স্বাধীন বিশ্লেষকেরা গোপন বা শ্রেণিবদ্ধ বলে নিশ্চিত করতে পারেন। উন্মুক্ত উৎসে অনুসন্ধান করা সাংবাদিকদের তদন্তে দেখা গেছে, তেহরান যে কিছু ছবি দেখিয়েছে, তার কিছু এসেছে সাধারণভাবে পাওয়া যায় এমন প্রকাশনা বা সম্মেলনের তথ্য থেকে। এসব গবেষণামূলক উপাদান পেতে কোনো সুরক্ষিত পরমাণু স্থাপনায় অনুপ্রবেশের প্রয়োজন ছিল না। ইসরায়েল স্বাভাবিকভাবেই এসব দাবিকে গুরুত্বহীন ভেবে নীরব থেকেছে। মনস্তাত্ত্বিক প্রচারণাকে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার প্রয়োজন তারা অনুভব করেনি।

গোয়েন্দা সংঘাতে জয় ঘোষণা করাটা অনেক সময় আসল যুদ্ধে জয়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ইরান তাদের ঘোষণাটি পশ্চিমাদের যাচাইয়ের জন্য দেয়নি। এটি ছিল আঞ্চলিক দর্শকদের জন্য, দেশের মনোবল জোরদারের জন্য এবং প্রতিপক্ষকে সাবধান করার জন্য। বার্তাটি স্পষ্ট ছিল, ‘আড়ালে কেবল তোমরাই কাজ চালাও না।’

মোসাদ ও ইরানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি একটি স্থায়ী কাঠামো, যা দাঁড়িয়ে আছে তথ্যদাতা সংগ্রহ, দ্বৈত এজেন্ট তৈরি, গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে সাইবার অনুপ্রবেশ, বিদেশে একাডেমিক ভ্রমণে নজরদারি, ক্রয়প্রক্রিয়া ব্যাহত করা এবং দেশে–বিদেশে বিজ্ঞানীদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর মতো কর্মকাণ্ডের ওপর। এসব কাজ ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় নিঃশব্দ হলেও অনেক বেশি কার্যকর।

আগামী দিনের সংঘাত বোমা দিয়ে শুরু হওয়ার আশঙ্কা কম। তা শুরু হবে নীরবে। চুপচাপ ফাইল সংগ্রহ করে, ফোন নেটওয়ার্কের মানচিত্র তৈরি করে, ব্যাংক হিসাব খুঁজে বের করে, সফটওয়্যার ভেঙে দিয়ে, সরবরাহ পথ আটকিয়ে। সিদ্ধান্তমূলক মুহূর্তগুলো রাজধানীর আকাশে নয়, ঘটবে গবেষণাগারে, একাডেমিক সম্মেলনে, টেলিকম ডেটাবেজে, আর বিজ্ঞানীদের মনে, যেখানে তাঁরা ভাববেন, কেউ কি তাঁদের বাড়ির ঠিকানা জানে! গোয়েন্দা তৎপরতার সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিক তার চুরি করা তথ্য নয়; বরং যে আতঙ্ক মানুষের মনে বসিয়ে দেয়, সেটাই।

জাসিম আল-আজ্জাবি সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক

মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত