শীতকাল যতই জাঁকালো হচ্ছে, ইউক্রেনে ততই উৎকণ্ঠা বাড়ছে। গত মাসে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে গঠিত মিত্রদের তথাকথিত জোট ‘কোয়ালিশন অব দ্য উইলিং’ এ ব্যাপারে একমত হয়েছে যে তারা ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদ জোগাড় করবে, যাতে বড় শহরগুলোয় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, ঘরবাড়ি উষ্ণ রাখা যায়। এ উদ্যোগ কিছুটা ফলও দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে! কেননা, এ বছর শীতের মৌসুম স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অল্প কিছুটা দেরিতে (২৮ অক্টোবর) শুরু হয়েছে।
আগামী মাসগুলোয় ইউক্রেনের ঘরবাড়ি উষ্ণ থাকবে, এখন পর্যন্ত সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। রাশিয়ার সেনারা এখনো ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের উদ্দেশ্যে শীত পুরোপুরি নেমে আসার আগেই ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা অকেজো করে দেওয়া।
‘জেনারেল উইন্টার’ বা শীতকাল ছিল নেপোলিয়ন ও হিটলারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাশিয়ার সবচেয়ে বিশ্বস্ত্র মিত্র। সাম্প্রতিক যুদ্ধেও জেনারেল উইন্টার রাশিয়ার হয়ে লড়ছে। আর সেটা শুধু ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নয়, ইউরোপের বিরুদ্ধেও।
যুদ্ধে সরাসরি জয়লাভে ব্যর্থ হয়ে এবং আলটিমেটাম দিয়েও কিয়েভকে নতিস্বীকারে ব্যর্থ হওয়ার পর ভ্লাদিমির পুতিন এখন যুদ্ধের ভারকেন্দ্র ইউক্রেনের জ্বালানি ও সরবরাহ অবকাঠামোর দিকে স্থানান্তর করেছেন। প্রথম দৃষ্টিতে এবারও গত দুই শীতকালের পুনরাবৃত্তি হবে বলে মনে হতে পারে; কিন্তু এবার কৌশলটা পাল্টেছে।
২০২২ ও ২০২৩ সালে রাশিয়া ইউক্রেনকে ‘ঠান্ডায় জমিয়ে আত্মসমর্পণ করাতে’ চেয়েছিল। এই কৌশল ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেনীয়দের মনোবল অক্ষুণ্ন ছিল, অন্ধকার পেরিয়ে আলো ফিরে এসেছিল। এবার পুতিনের হিসাব আলাদা। এবার শুধু ইউক্রেনকে শাস্তি দেওয়া নয়, বরং শীত ও অন্ধকারে মানবিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে ইউরোপকেও অস্থিতিশীল করে তোলা তাঁর লক্ষ্য।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরু হলে লাখ লাখ ইউক্রেনীয় ট্রেন, ব্যক্তিগত গাড়িতে ও হেঁটে পশ্চিমে পালিয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই ছিল ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থীস্রোত। যদি ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়ে, তাহলে নতুন করে আরও বিধ্বংসী হয়ে শরণার্থীঢেউ ফিরে আসতে পারে। এটাই শীতকালকে অস্ত্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে ক্রেমলিনের সবচেয়ে নৃশংস পরিকল্পনা।
বর্তমানে ইউরোপে প্রায় ৫০ লাখ ইউক্রেনীয় শরণার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে জার্মানি ১২ লাখ ও পোল্যান্ড ৯ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। দুটি দেশের নাগরিকেরা শুরু থেকেই ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের প্রতি উদার ছিলেন, কিন্তু যুদ্ধক্লান্তি ধীরে ধীরে জেঁকে বসেছে, জনমতও বদলে যাচ্ছে।
ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমাদের সমস্ত সংহতি থাকা সত্ত্বেও আরেকটি শরণার্থীঢেউ ইউরোপকে ভয়াবহভাবে নাড়া দিতে পারে। সাহায্যের তহবিল যেখানে আগে থেকেই টান ধরেছে, সেখানে ইউরোপের সামনে শুধু অর্থনৈতিক নয়, নৈতিক পরীক্ষাও আসবে। তীব্র শীত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে আসা অসহায় লোকদের ইউরোপীয়রা সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দেবে, নাকি নিজেদের দেশে দেশে বাড়তে থাকা জন–অসন্তোষের মুখে মানবিক দায়িত্ব পালন করবে?
বর্তমানে ইউরোপে প্রায় ৫০ লাখ ইউক্রেনীয় শরণার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে জার্মানি ১২ লাখ ও পোল্যান্ড ৯ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। দুটি দেশের নাগরিকেরা শুরু থেকেই ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের প্রতি উদার ছিলেন, কিন্তু যুদ্ধক্লান্তি ধীরে ধীরে জেঁকে বসেছে, জনমতও বদলে যাচ্ছে।
এ বছরের শুরুতে ইউক্রেন যখন তরুণদের জন্য সীমান্ত পার হওয়ার বিধিনিষেধ শিথিল করেছিল, তখন প্রায় এক লাখ ইউক্রেনীয় পুরুষ পোল্যান্ডে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই জার্মানিতে চলে যান। এতে জনমনে অসন্তোষ তৈরি হয়। অক্টোবরের একটি জরিপে দেখা গেছে, জার্মানদের ৬২ শতাংশ চান, সামরিক বাহিনীতে কাজ করার সক্ষমতা আছে—এমন ইউক্রেনীয় পুরুষদের দেশে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। ৬৬ শতাংশ চান না যে ইউক্রেনীয়রা কোনো সুবিধা পাক। গত বছর জার্মানিতে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জন্য খরচ হয়েছে ছয় বিলিয়ন ইউরো। জার্মানির নতুন রক্ষণশীল সরকার বাজেট কাটছাঁট করার কথা বারবার বলছে।
পোল্যান্ডেও পালিয়ে আসা তরুণ ইউক্রেনীয় পুরুষদের নিয়ে জনমনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, পোল্যান্ডের ২৫ শতাংশ মানুষ ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের ইতিবাচকভাবে দেখছেন, ৩০ শতাংশ নেতিবাচকভাবে এবং ৪১ শতাংশ নিরপেক্ষ। ৫১ শতাংশ মনে করছেন, সরকার তাঁদের জন্য খুব বেশি সহায়তা দিচ্ছে। এক বছর পরও এই নেতিবাচক প্রবণতা সম্ভবত বজায় আছে।
পুতিন এবং তাঁর মিত্র বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কা ভালো করেই জানেন, মরিয়া লোকদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্তের দিকে ঠেলে দেওয়াটা কার্যকর কৌশল। ২০২১ সালে তাঁরা দুজন এ ধরনের ‘হাইব্রিড যুদ্ধের’ পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। বেলারুশ তখন মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার আশ্রয়প্রার্থীদের পোল্যান্ড সীমান্তের দিকে ঠেলে পাঠিয়েছিল।
সে সময় এই সীমান্তগুলোয় হাজার হাজার মানুষ আটকা পড়েছিলেন। সেটি মানবিক সংকট সৃষ্টি ও মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠেছিল। এই শীতে ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামো যদি ধ্বংস হয়, তাহলে লাখ লাখ মানুষ পোল্যান্ড কিংবা রোমানিয়া ও হাঙ্গেরির দিকে ছুটতে থাকবেন। সীমান্ত পেরিয়ে উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড বা ড্রোন আক্রমণের মতো ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও উত্তেজনাপূর্ণ করতে পারে।
রাশিয়ার সেনারা বিদ্যুৎকেন্দ্র, গ্যাস সংরক্ষণাগার ও রেলওয়ে জংশন বোমা মেরে ধ্বংস করছেন। শুধু অবকাঠামো ধ্বংসের জন্য নয়, ইউক্রেনের বাসিন্দাদের পশ্চিমে ঠেলে দেওয়ার জন্যও। কেননা, আতঙ্ক নিজেই একটি অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
সের্গেই মাইডুকভ ইউক্রেনীয় লেখক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত